দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় আলেম হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর জীবন ছিল ঘটনাবহুল। বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তিনি কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ পদে আসীন হন।
২০২০ সালে হেফাজতের আমির হন জুনায়েদ বাবুনগরী। আমৃত্যু তিনি এই পদে ছিলেন। এর আগে তিনি এ সংগঠনের মহাসচিব পদে ছিলেন। তখন আমির ছিলেন প্রয়াত আল্লামা আহমদ শফী।
বাবুনগরী হেফাজত আমিরের পাশাপাশি চট্টগ্রামের মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষা পরিচালক পদেও ছিলেন।
তিনি বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সহসভাপতি, চট্টগ্রাম নুরানি তালিমুল কুরআন বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং মাসিক মুঈনুল ইসলামের প্রধান সম্পাদক ছিলেন। এ ছাড়া তিনি নাজিরহাট বড় মাদ্রাসার মুতাওয়াল্লি, মাসিক দাওয়াতুল হকের পৃষ্ঠপোষক, ইনসাফ২৪.কম ও কওমিভিশন.কমের প্রধান উপদেষ্টাসহ কয়েকটি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের নেতৃস্থানীয় পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।
জুনায়েদ বাবুনগরী ৫ বছর বয়সে আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া আজিজুল উলুম বাবুনগরে ভর্তি হন। সেখানে তিনি মক্তব, হেফজ ও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন।
এর পর তিনি ভর্তি হন দারুল উলুম হাটহাজারী মাদ্রাসায়। ১৯৭৬ সালে হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স) পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন।
এর পর উচ্চশিক্ষার উদ্দেশে তিনি পাকিস্তান যান। ১৯৭৬ সালে করাচিতে অবস্থিত জামিয়া উলুমুল ইসলামিয়ায় তাখাচ্ছুছাত ফিল উলুমুল হাদিস তথা উচ্চতর হাদিস গবেষণা বিভাগে ভর্তি হন। দুই বছর হাদিস নিয়ে গবেষণা সম্পন্ন করে তিনি আরবি ভাষায় ‘সিরাতুল ইমামিদ দারিমি ওয়াত তারিখ বি শায়খিহি’ (ইমাম দারিমি ও তার শিক্ষকগণের জীবন বৃত্তান্ত) শীর্ষক অভিসন্দর্ভ জমা দেন। এই অভিসন্দর্ভ জমা দেওয়ার পর তিনি জামিয়া উলুমুল ইসলামিয়া থেকে হাদিসের সর্বোচ্চ সনদ লাভ করেন।
কর্মজীবন
১৯৭৮ সালের শেষ দিকে বাবুনগরী দেশে ফিরে বাবুনগর মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন। বাংলাদেশের মাদ্রাসাগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম বাবুনগর মাদ্রাসায় তিনি উচ্চতর হাদিস গবেষণা বিভাগ চালু করেন। ২০০৩ সালে তিনি দারুল উলুম হাটহাজারী মাদ্রাসায় যোগ দেন। পরে তিনি হাটহাজারী মাদ্রাসার সহকারী পরিচালক নিযুক্ত হন।
২০২০ সালের ১৭ জুন মাদ্রাসা কমিটি সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্ত মানতে পারেননি বাবুনগরীর অনুসারীরা।
পরে ১৪ সেপ্টেম্বর হাটহাজারী মাদ্রাসায় ছাত্র আন্দোলনের সূচনা হয়। এই আন্দোলন তীব্র হতে থাকলে ১৭ সেপ্টেম্বর মাদ্রাসার মহাপরিচালক শাহ আহমদ শফী স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে মাদ্রাসার দায়িত্ব মজলিশে শুরাকে দিয়ে দেন। ওই দিনই তিনি ইন্তেকাল করেন। পরে বাবুনগরীসহ তিন সদস্যবিশিষ্ট মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটি গঠিত হয়। বাবুনগরী মাদ্রাসার শায়খুল হাদিস ও শিক্ষা সচিব হিসেবে পদোন্নতি পান।
রাজনৈতিক জীবন
২০১০ সালে বাবুনগরীকে মহাসচিব করে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর সংগঠনটির আমির মৃত্যুবরণের পর ১৫ নভেম্বর সংগঠনের একটি কেন্দ্রীয় সম্মেলনের মাধ্যমে সর্বসম্মতিক্রমে তিনি আমির নির্বাচিত হন। এ ছাড়া চলতি বছরে ২৫ এপ্রিল হেফাজতের আহ্বায়ক কমিটির আহ্বায়ক এবং সর্বশেষ ৭ জুন তিনি হেফাজতের আমির নিযুক্ত হন।
আরবি, উর্দু ও বাংলায় তার রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৩০টি। দারুল উলুম নাদওয়াতুল উলামার আরবি পত্রিকা আল বাসুল ইসলামি, দারুল উলুম দেওবন্দের মাসিক পত্রিকা আদ দায়ী, দারুল উলুম হাটহাজারীর মাসিক আল মুঈনসহ বিভিন্ন সাময়িকীতে তার অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। কাতারের আল আরব পত্রিকায় তার দীর্ঘ সাক্ষাৎকার ছাপানো হয়েছিল। এ ছাড়া তিনি ইনসাফ২৪.কম, কওমিভিশন.কমের প্রধান উপদেষ্টা ও মাসিক দাওয়াতুল হকের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
তার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে— সিরাতুল ইমামিদ দারিমি ওয়াত তারিখ বি শায়খিহি, তালিমুল ইসলাম, বাড়াবাড়ি ছাড়াছাড়ির কবলে শবেবরাত, ইসলামে দাড়ির বিধান, তাওহিদ ও শিরক: প্রকার ও প্রকৃতি, মুকাদ্দিমাতুল ইলম: তাফসির, হাদিস, ফিকাহ, ফতোয়া, আকাবিরে দেওবন্দের সিলসিলায়ে সনদ।
বাবুনগরী ৫ মেয়ে ও ১ ছেলে রেখে গেছেন।
বাবুনগরী ১৯৫৩ সালের ৮ অক্টোবর চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থানার বাবুনগর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আবুল হাসান ও মাতা ফাতেমা খাতুন। হারুন বাবুনগরী তার নানা। মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী তার মামা, যিনি হেফাজতের প্রধান উপদেষ্টা।