বছরের পর বছর ব্যাংকব্যবস্থায় আদায় অযোগ্য মন্দ মানের শ্রেণিকৃত খেলাপি ঋণ স্থিতিপত্র (ব্যালেন্স শিট) থেকে বাদ দেয়াকে ঋণ অবলোপন বা রাইট অফ বলে। ঋণ অবলোপনের নীতিমালা শিথিল করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে প্রায় ৮২ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণের বড় একটি অংশ অবলোপন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ নীতিমালা শিথিল করায় ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকির মাত্রা বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকেরা।
তারা জানান, ঋণ আদায় না হলেও কাগজে-কলমে কমে যাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। এতে ঋণ খেলাপিরা আরো উৎসাহিত হবেন। বেড়ে যাবে খেলাপি হওয়ার প্রবণতা। আড়াল হয়ে যাবে ব্যাংকের প্রকৃত চিত্র। ফলে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ প্রকৃতপক্ষে তো কমবেই না বরং আরো কঠিন আকার ধারণ করবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম গতকাল বৃহস্পতিবার নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, ঋণ অবলোপনের নীতিমালা শিথিল করা উচিত হয়নি। কোনো প্রয়োজনও ছিল না। তিনি বলেন, এ নীতিমালা শিথিল করায় ব্যাপক আকারের খেলাপি ঋণ ব্যাংকগুলোর বুকস অব অ্যাকাউন্ট থেকে বের হয়ে যাবে। এতে আপাতত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমে যাবে বলে মনে করা হলেও বরং জটিলতা আরো বেড়ে যাবে। ব্যবসায়ীরা আরো বেশি হারে ঋণ অবলোপনের সুবিধা নেবেন। এতে খেলাপি ঋণের প্রবণতা বেড়ে যাবে। সামগ্রিকভাবে বাড়বে ঝুঁকি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানান, ঋণ অবলোপনের নীতিমালা শিথিল করায় জটিলতা বেড়ে যাবে। ঋণখেলাপিরা উৎসাহিত হবেন। আর ঋণ পরিশোধ না করার প্রবণতা বেড়ে যাবে। আড়াল হয়ে যাবে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র। তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ কমানোর ব্যাপারে নীতিনির্ধারকদের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে।
কেননা, ডাউন পেমেন্ট ছাড়া ঋণ নবায়ন, ঋণ পুনর্গঠনের নামে ব্যবসায়ীদের বড় ধরনের ছাড়, এখন আবার ঋণ অবলোপনের নীতিমালা শিথিল করা সব উদ্যোগই ঋণখেলাপিদের পক্ষে যাচ্ছে। এতে ঋণ পরিশোধ না করার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। আগে ৫ বছর পর্যন্ত খেলাপিদের আটকে রাখা হতো। ফলে এ সময়ের মধ্যে ব্যাংকগুলোর খেলাপিঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হতো। বেড়ে যেতো খেলাপিঋণের হার। এতে করে ব্যাংকগুলোতে খেলাপিঋণ কমানোর নানা উদ্যোগ নেয়া হতো। গ্রাহকদের কাছ থেকে ঋণ আদায়ের নানা কৌশল গ্রহণ করা হতো।
মোট কথা ব্যাংকারদেরও ঋণ আদায়ের একটা তাগিদ ছিল। আর এখন ঋণখেলাপিদের আটকানোর নীতিমালা ৫ বছর থেকে কমিয়ে ৩ বছর করায় ঋণখেলাপিরা আরো উৎসাহিত হবেন। কারণ, তারা কোনো মতে তিন বছর সময় পার করতে পারলেই ঋণ অবলোপন হয়ে যাবে। এতে চলবে মামলার দীর্ঘসূত্রতা। এ সময় তারা আবার নতুন করে ঋণ নিয়ে আবার খেলাপি হবেন।
তিনি জানান, এসব সুবিধা দেয়ায় বেকায়দায় পড়বেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি মানের ব্যবসায়ী উদ্যোক্তারা। কেননা একদিকে তারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করবেন, আর ওই অর্থ চলে যাবে বড় বড় শিল্প গ্রুপের কাছে। আর নানা ধরনের ছাড় পেয়ে তারা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করবেন না। তিনি জানান, নীতিমালা শিথিল করায় ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র আড়াল হয়ে যাবে বৈ অন্য কিছু নয়।
তাহলে খেলাপি ঋণ কমানোর বিকল্প কী ছিল ব্যাংকারদের হাতে এমন এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক এ গভর্নর বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ঋণখেলাপিদের ওপর সামাজিক চাপ সৃষ্টি করতে পারলে খেলাপি ঋণ কমে যেত। যেমন, ঋণখেলাপিদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা, নানা ধরনের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা কমানোসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া যেত। কয়েকদিন যাবত অর্থমন্ত্রীকে এ বিষয়ে সোচ্চার হতে দেখা গেলেও হঠাৎ কেন এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রহণ করল তা বোধগম্য নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ রয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। এর মধ্যে মন্দমানের খেলাপি ঋণ রয়েছে ৮২ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা। আর এ সময়ে অবলোপন করা হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ। অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণ থেকে আদায় বাদে এখন মোট খেলাপি ঋণ রয়েছে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। নীতিমালা শিথিল করায় মন্দ মানের ৮২ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকার বেশির ভাগই অবলোপন হয়ে যাবে। এতে খেলাপি ঋণের হিসাব থেকে আড়াল হয়ে যাবে অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণ।
গত বুধবার এক সার্কুলারের মাধ্যমে ঋণ অবলোপনের নীতিমালা শিথিল করে বাংলাদেশ ব্যাংক। অবলোপনের জন্য এখন আর আগের মতো শতভাগ প্রভিশন লাগবে না। দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ অবলোপনে মামলা করতে হবে না। এতদিন মামলা না করে অবলোপন করা যেত ৫০ হাজার টাকা। যেসব ঋণ বা বিনিয়োগ হিসাবের বকেয়া দীর্ঘদিন আদায় বন্ধ, যা নিকট-ভবিষ্যতে আদায়ের কোনো সম্ভাবনাও নেই, এ ছাড়া তিন বছর মন্দ বা ক্ষতিজনক মানে শ্রেণিকৃত রয়েছে, এসব ঋণ বা বিনিয়োগ ব্যাংকগুলো অবলোপন করতে পারবে। ব্যাংকগুলো এখন মাত্র তিন বছরের মন্দমানের খেলাপি ঋণ ব্যালেন্স শিট থেকে বাদ দিতে পারবে।