যে মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এক বছর আগে কারাগারে গেছেন, সেই মামলায় গ্রেফতারের দেড় মাসের মাথায় জামিন পেলেও তার মুক্তি মেলেনি। এই মুক্তির পথে বাদ সেধেছে আরো ৩৬ মামলা। একটি মামলায় জামিন হলে, সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে অন্য মামলা। আর এভাবেই কেটে গেছে পুরান ঢাকার পরিত্যক্ত কারাগারে একমাত্র বন্দী হিসেবে বেগম জিয়ার একটি বছর। তার কারাবাস কি আরো দীর্ঘায়িত হবে, নাকি নাটকীয় কোন পথে তার মুক্তি প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে, সে বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত থাকলেও নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলতে পারছেন না। বিএনপির চেয়ারপারসনের মুক্তি কি কেবলই আইনি জটিলতা, নাকি রাজনৈতিক? বিএনপির নেতারা বলছেন, কেবলমাত্র রাজনৈতিক কারণে খালেদা জিয়া মুক্তি পাচ্ছেন না। সরকারই তাকে আটকে রেখেছে, আর সরকারের ‘মর্জি’র উপরই নির্ভর করছে বন্দী থাকা অবস্থায় দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে গণতন্ত্রের ‘মা’ উপাধি পাওয়া খালেদার কাক্সিক্ষত মুক্তি।
খালেদা জিয়ার আইনজীবী প্যানেলের অন্যতম বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ নয়া দিগন্তকে বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তি এখন কোনো আইনি জটিলতার বিষয় নয়, এটি পুরোপুরি রাজনৈতিক। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণেই তিনি মুক্ত হতে পারছেন না। কারণ নিম্ন আদালত প্রশাসনের অধীনেই কাজ করছে।
গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেয় বিশেষ আদালত। ওই দিনই আদালত থেকে সরাসরি কারাগারে পাঠানো হয় তাকে। তখনকার রাজনৈতিক আবহে খালেদা জিয়ার এই দণ্ড অনেকটা অনুমিতই ছিল। মিছিল-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ৮ ফেব্রুয়ারির ওই দিন নেতাকর্মীরা খালেদা জিয়ার গাড়ির পেছনে পেছনে ছুটেছিল পঙ্গপালের মতো। তাদের মুখে সেøাগান ছিল- ‘আমার নেত্রী, আমার মা, বন্দী হতে দেবো না।’
খালেদা জিয়া কারাবন্দী আছেন পুরান ঢাকার পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগারে। যেখানে তিনিই একমাত্র বন্দী। পুরনো এই কারাগারে খালেদা জিয়াকে রাখা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে বিএনপির। কারাগারে যাওয়ার কিছু দিন পরেই খবর আসে তার অসুস্থতার। জানা যায়, গত ৫ জুন কারাগারের ভেতরে খালেদা জিয়া দাঁড়ানো অবস্থা থেকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। এর দুই দিন পরে খালেদা জিয়াকে দেখে এসে তার এক চিকিৎসক ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক এফ এম সিদ্দিকী বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের মাইল্ড স্ট্রোক হয়েছে।
অধ্যাপক এফ এম সিদ্দিকীসহ চার চিকিৎসকের একটি প্রতিনিধিদল বিএনপি চেয়ারপারসনের চিকিৎসা নিয়ে চার পৃষ্ঠার একটি সুপারিশমালা কারা কর্তৃপক্ষকে দিয়েছিলেন। এর মধ্যে বলা হয়েছিলÑ খালেদা জিয়ার পরীক্ষার জন্য প্রসথেসিস কম্পিটেবল এমআরআই মেশিন দরকার। তার ক্যারোপিড ডটলাইট স্টাডি করে ব্রেইনের সার্কুলেশন স্টাডি করা দরকার, নার্ভ কনডাকশন স্টাডি করা প্রয়োজন এবং খালেদা জিয়ার সমস্ত মেটাবলিক প্রফাইল টাইম অ্যান্ড টাইম করা দরকার। এসব সুপারিশের পরেও খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। বিএনপির দাবি ছিলÑ ইউনাইটেড হাসপাতালে বেগম জিয়ার পরীক্ষা-নিরীক্ষার। কিন্তু তা আমলে নেয়া হয়নি। দুইবার তাকে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালে এনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়।
কারাগারে থাকা অবস্থায়ই জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় উচ্চ আদালত তার সাজা আরো ৫ বছর বাড়িয়ে ১০ বছর করেছে। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির আরেকটি মামলায় তার সাজা হয়েছে ৭ বছর।
বেগম জিয়াকে কারাগারে নেয়ার পর থেকে বিএনপি তার মুক্তির জন্য মানববন্ধন, কালো পতাকা প্রদর্শন, অবস্থান কর্মসূচি, অনশন, স্মারকলিপি দেয়ার মতো শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করে আসছিল। তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এ ধরনের কোনো কর্মসূচি রাখেনি বিএনপি। নির্বাচনের পরেও এখন পর্যন্ত ‘অর্থপূর্ণ’ কোনো কর্মসূচি দেয়া হয়নি। আজ দলটি প্রতিবাদ সভা করবে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে। কাল সারা দেশে প্রতিবাদ সমাবেশের কর্মসূচি রয়েছে।
বিএনপির নেতারা বলেছেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি এখন তাদের প্রধান এজেন্ডা। তবে কর্মসূচি দেয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা সংযত হয়ে চলতে হচ্ছে। নেতাকর্মীরা মামলা-হামলায় জর্জরিত থাকায় তাদেরকে হুট করে এখন আরো ঝামেলায় ফেলা যাবে না। এ কারণে সময় নিয়ে ধারাবাহিক কর্মসূচির কথা ভাবা হচ্ছে।
খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বলেছেন, বিধি অনুযায়ী খালেদা জিয়া জামিন পাওয়ার অধিকার রাখেন, কিন্তু আইন নিজস্ব গতিপথে চলতে পারছে না। অদৃশ্য শক্তি খালেদা জিয়ার মুক্তির লাগাম ধরেছে।
খালেদা জিয়ার অন্যতম আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেয়া হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এবং প্রতিহিংসার কারণে। তাই যে মামলাগুলো তার বিরুদ্ধে দেয়া হয়েছে তার মুখ্য উদ্দেশ্য তাকে জনসম্মুখে হেয়প্রতিপন্ন করা এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা। কেন না একটি পরিত্যক্ত জেলে, নিতান্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তাকে রাখা হয়েছে। তার চিকিৎসার কোনো সুব্যবস্থা নেই।
খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আইনি প্রক্রিয়ায় তাকে মুক্ত করা যাবে না। কেন না আমাদের নি¤œ আদালত থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সবাই কর্তৃত্ববাদী সরকারের আজ্ঞাবহ।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি সভাপতি ও খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, সরকার বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে জেলে আটক করে রেখেছে। তার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ৩৭টি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলার মধ্যে তিনটি বাদে সব মামলায় তিনি জামিনে আছেন। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও কুমিল্লার একটি হত্যা মামলায় তার জামিন নেয়া বাকি আছে। এ ছাড়া অন্য মামলায় তিনি জামিনে আছেন।
জয়নুল আবেদীন বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য আমরা আইনগতভাবে লড়ে যাচ্ছি। তাকে মুক্ত করার জন্য আইনগতভাবে যা যা করার আমরা করব। ইনশাআল্লাহ আমরা তাকে কারাগার থেকে মুক্ত করে আনব।
এদিকে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা রয়েছে, বিএনপির সংসদে যাওয়ার শর্তে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়া হতে পারে। তবে এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। অবশ্য সরকারের তরফ থেকে বারবার বিএনপিকে সংসদে যাওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে। সম্প্রতি জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপিকে সংসদে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। বিএনপিকে সিদ্ধান্ত বদলের অনুরোধ জানিয়ে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সংখ্যায় কম হলেও বিএনপির বিজয়ীদের সংসদে যাওয়া উচিত। এখন পর্যন্ত বিএনপির সিদ্ধান্ত হচ্ছে, তাদের দলের কেউ সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেবেন না।