ভরা বর্ষা মৌসুম চলছে। কিন্তু বরাবরের মতো এবার পর্যটকদের দেখা মিলছে না ‘মিনি কক্সবাজার’ খ্যাত নেত্রকোনার উচিতপুর নৌঘাটে। কমেছে সাধারণ যাত্রীর সংখ্যাও। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে দেখা দিয়েছে এমন সঙ্কট ও নিষ্প্রাণ অবস্থা। ফলে এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে পর্যটন ও ঘাটকেন্দ্রিক স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর। তিন-চার মাসে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে অন্তত সাত-আট কোটি টাকা।
জানা গেছে, নেত্রকোনার মদন উপজেলার একটি বড় নৌঘাটের নাম উচিতপুর। হাওরাঞ্চলের ছোটখাটো একটি নৌবন্দরও বলা যায় এটিকে। প্রতিবছর বর্ষার শুরুতে এ ঘাটটি চালু হয়। তিন-সাড়ে তিনমাস পর বর্ষা শেষ হয়ে গেলে ঘাটের কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায়। সিলেট, আজমিরিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুরি ও মদন ছাড়াও হাওরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকার নৌরুটে এক থেকে দেড় শতাধিক ট্রলার চলাচল করে এখান থেকে। এ কারণে স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রীর ভিড়ে এমনিতেই রমরমা থাকে ঘাটটি।
বছর পাঁচেক ধরে উচিতপুর হয়ে উঠেছে পর্যটনকেন্দ্র। এর কারণ উচিতপুর ঘাটের পর থেকেই বিশাল হাওর এলাকার শুরু। জেলা সদর থেকে সরাসরি সড়কপথে যাওয়া যায় সেখানে। অন্যদিকে উচিতপুর ঘাটের অদূরে বালই নদীর ওপর সড়ক ও জনপথ বিভাগের উদ্যোগে একটি সুদৃশ্য পাকা সেতু নির্মাণের পর ওই জায়গাটি আরও দৃষ্টিনন্দন হয়ে ওঠে। ফলে পর্যটকদের অপার আকর্ষণে পরিণত হয়। লোকমুখে জায়গাটির নাম হয়ে ওঠে ‘মিনি কক্সবাজার’। কারণ উচিতপুর ঘাট থেকে দিগন্তবিস্তৃত হাওরের অপার সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। ঘাট থেকে ট্রলার নিয়ে যে কোন সময় হারিয়ে যাওয়া যায় হাওরের গহীনে। হাওরের উত্তাল ঢেউ ভেদ করে দূরন্ত গতিতে ছুটে চলা ইঞ্জিনচালিত নৌযানের ছাদে দাঁড়ালে যে কারও মনে হয়- এ যেন সত্যিই আরেক সমুদ্র।
তাই প্রতিদিন দূর-দূরান্তের বিভিন্ন জেলা থেকে বাস, ট্রাক, পিকআপ, মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেলে হাজার হাজার ভ্রমণপিপাসু নারী-পুরুষ ছুটে আসেন সেখানে। তাদের ভিড় সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় সেখানকার নৌযান মালিক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের। গেল বছরের (২০২০) ৫ আগস্ট অতিরিক্ত পর্যটকবাহী একটি ট্রলার ডুবে ১৮ জনের প্রাণহানিও ঘটে উচিতপুরে।
এদিকে যাত্রী ও পর্যটকদের ভিড়কে কেন্দ্র করে উচিতপুর নৌঘাটটি ইতিমধ্যে একটি বহুমাত্রিক ব্যবসাকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। মদন উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের শতাধিক ট্রলার মালিক সেখানে ট্রলারের ব্যবসা করছেন। এসব ট্রলার পরিচালনার সঙ্গে জড়িত আছেন আরও প্রায় তিন-চারশ শ্রমিক-কর্মচারী। এছাড়া উচিতপুরে গড়ে ওঠেছে অন্তত ৫০টি ছোট-বড় দোকানপাট। এগুলোর মধ্যে রয়েছে: হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ফাস্টফুড, মনোহারি, চা ও কফির দোকান, টং দোকান, ভ্রাম্যমান দোকান, ফার্মেসি, গাড়ির গ্যারেজ, মিনি পার্ক ইত্যাদি। আছে অনেক রিক্সা, সিএনজি এবং ইজিবাইক চালকও। সরকারি উদ্যোগে উচিতপুর ঘাটে নির্মাণ করা হয়েছে হাওরবিলাস কেন্দ্র। পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন ও ডুবুরি ইউনিট গঠনসহ পর্যটনশিল্প বিকাশে আরও অনেক সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর।
কিন্তু এত আয়োজনের পরও এবারের বর্ষায় উচিতপুর ঘাট যেন নিষ্প্রাণ। এমনিতেই এবার বর্ষার পানি এসেছে একটু দেরিতে। ফলে অনেক দেরিতে শুরু হয়েছে ঘাটের কার্যক্রম। তারওপর আবার করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে চলছে নানা রকম বিধিনিষেধ ও লকডাউন। ফলে কোন পর্যটকের দেখা মিলছে না। নিয়মিত যাত্রীর সংখ্যাও একেবারে কম। ঘাট সংশ্লিষ্টরা জানান, এবার ৮টি রুটে মাত্র ২০টি ট্রলার নিয়মিত চলাচল করছে। আর প্রাইভেট ট্রলার চলছে হাতেগোনা কয়েকটি।
মোহন মিয়া নামে একজন ট্রলার মালিক জানান, উচিতপুর থেকে খালিয়াজুরীর ইছাপুর বাজার পর্যন্ত নিয়মিত একটি যাত্রীবাহী ট্রলার চালান তিনি। একই রুটে গেল বছর প্রতিদিন ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা আমদানি হয়েছে তার। কিন্তু এবার আমদানি হচ্ছে এক থেকে সর্বোচ্চ দেড় হাজার টাকা। অথচ প্রতিদিন ডিজেল, মবিল, ঘাটভাড়া এবং শ্রমিকদের মজুরি বাবদই তার খরচ হচ্ছে সমপরিমাণ টাকা। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘রুটটি (চলাচলের লাইন) হাতছাড়া করতে চাচ্ছি না। তাই লাভ না পেয়েও ট্রলার চালাচ্ছি।’ একই রকম বক্তব্য উচিতপুর-জয়বাংলা রুটে চলাচলরত ট্রলার মালিক সারোয়ার হোসেনেরও। তিনিও বলেন, গত বছর প্রতিদিন যেখানে তিন থেকে চার হাজার টাকা আমদানি হতো, এবার সেখান থেকে অর্ধেকও পাচ্ছি না। ১০-১২ জন যাত্রী নিয়ে ৮০ জনের ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ট্রলারটি চালাতে হচ্ছে।’
‘একদিন সর্বোচ্চ এক হাজার ৭০০ টাকাও পেয়েছি’- যোগ করেন তিনি।
এদিকে প্রাইভেট ট্রলার (নির্ধারিত রুট ছাড়া) চালকদের অবস্থা আরও খারাপ। মুসা মিয়া নামে এক প্রাইভেট ট্রলারের মালিক জানান, অন্যান্য বছর এই ঘাটে অন্তত ৫০-৬০টি প্রাইভেট ট্রলার নিয়মিত চলত। তারা পর্যটকদের নিয়ে হাওরের বিভিন্ন এলাকায় যাওয়া-আসা করতেন। কিন্তু এবার মাত্র ৬-৭টি চলে। তাও কেউই প্রতিদিন ভাড়া পায় না। দুই-তিনদিন অপেক্ষার পর ছোটখাটো একটা ট্রিপ মিলে। চাহিদা না থাকায় ভাড়াও কম। তাই ট্রলারের মালিকরা সবাই এবার মারাত্মক ক্ষতির মুখে।
উচিতপুর নৌঘাটের ইজারা নিয়ে চরম বিপাকে আছেন ইজারাদার লাহুত আকন্দ। তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ঘাটটি প্রতিবছর উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইজারা দেয়া হয়। গত বছর এই ঘাটের ইজারা মূল্য ছিল ২১ লাখ ৪২ হাজার টাকা। কিন্তু গেল কয়েক বছর ভালো লাভ হওয়ায় এবার অনেকে ইজারা নিতে আগ্রহ দেখায়। এ কারণে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নামতে হয়। প্রতিযোগিতার কারণে এবার ইজারা মূল্য বেড়ে দাঁড়ায় ৩২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। তিনি বলেন, ‘জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাত্র তিনমাসের মধ্যে আমাকে এই পরিমাণ টাকা তুলতে হবে। কিন্তু প্রতিদিন আমার আমদানি হচ্ছে মাত্র ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা। এভাবে আমদানি হলে তিনমাসে টাকা উঠবে সর্বোচ্চ ১২ লাখ টাকা। তাই এবার লাভ তো দূরের কথা, উপরন্তু লাখ বিশেক টাকা লোকসান গুনতে হবে। অথচ আমরা অন্তত ৫০ লাখ টাকা তোলার টার্গেট করেছিলাম।’
এদিকে লোকসানের মুখে ঘাটের অন্যান্য ব্যবসায়ীরাও। পাঁচ-ছয় বছর যাবত এই ঘাটে একটি খাবারের হোটেল পরিচালনা করেন স্বপন মিয়া। এবারও হোটেলের ঘরসহ আসবাবপত্র মেরামত করে ব্যবসার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু যাত্রী ও পর্যটক না থাকায় শেষ পর্যন্ত ব্যবসা চালু করেননি। ইদু মিয়া নামে অপর এক হোটেল ব্যবসায়ী বলেন, ‘ব্যবসা বন্ধ রাখলে বসে খেতে হবে। তাই কোনরকমে হোটেলটি চালু রেখেছি। কিন্তু কাস্টমার নেই। সারাদিনে দুই-তিন হাজার টাকাও বেঁচতে পারি না।’
এবারই প্রথম এককালীন ২২ হাজার টাকায় একটি জমি ভাড়া নিয়ে সেখানে ‘মাস্টার বার্গার শপ’ নামে একটি ফাস্টফুডের দোকান শুরু করেছিলেন রূপক মিয়া নামের এক ব্যক্তি। ঘর নির্মাণ ও আসবাবপত্র বাবদ বেশকিছু টাকাও বিনিয়োগ করেছেন তিনি। কিন্তু ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা, লকডাউন ও যাত্রী না থাকায় কাঙ্ক্ষিত ক্রেতা মিলছে না। এ কারণে তিনিও দেখছেন লোকসানের মুখ। একটি গাড়ির গ্যারেজের মালিক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আগে প্রতিদিন এক থেকে দেড়শ মোটরসাইকেল এবং প্রাইভেট কার রাখতাম। অনেক সময় স্থান সঙ্কুলান হতো না। একেকটি মোটরসাইকেল থেকে দৈনিক ভাড়া পেতাম ৩০ টাকা। আর বড় গাড়ি থেকে দেড়শ টাকা। এবার ৫-৬টি মোটরবাইকও আসে না।’
উচিতপুরের অদূরে বালই সেতুর পূর্বদিকে ‘তাসিন ফুডপার্ক’ নামে একটি মিনি পার্ক কাম রেস্টুরেন্ট দিয়েছিলেন রাহি নামের এক যুবক। গেল কয়েক বছর জমজমাট ব্যবসা করেছেন তিনি। অনেকের মতে, উচিতপুরের প্রতি মানুষের আকর্ষণ সৃষ্টির পেছনে পানির ওপর ভাসমান এই পার্কটিও একটি কারণ। উচিতপুরে কেউ গেলে ওই পার্ক না দেখে ফেরেন না। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি তাকেও পার্ক বন্ধ রাখতে বাধ্য করেছে। রাহি বলেন, ‘ব্যবসাটি চালাতে গেলে কয়েক লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। প্রতিমাসে কর্মচারীদেরও দিতে হয় অনেক টাকা। ক্রেতা না থাকলে রিটার্ন আসবে কোত্থেকে?’
পর্যটকদের আনাগোনা না থাকায় এই ঘাট এলাকার মনোহারি ব্যবসায়ী, চা-কফির দোকানদার, টং দোকানদার এবং অন্যান্য ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীদের অবস্থাও তথৈবচ। সবার চোখেমুখেই হতাশার ছাপ। হতাশ মদন-উচিতপুর রুটের রিক্সা, ইজিবাইক এবং সিএনজির চালকরাও। এমনকি নেত্রকোনা-মদন রুটের বাস মালিক-শ্রমিকরাও বর্ষা মৌসুমে উচিতপুরের প্রচুর যাত্রী পেতেন।
এদিকে সরকারি উদ্যোগে সেখানে একটি হাওরবিলাস কেন্দ্র (মিনি পর্যটন কেন্দ্র) নির্মাণ করা হলেও পরিত্যক্ত ভবনের মতো সেটিও উন্মুক্ত পড়ে আছে। কেউ যেন ফিরেও তাকায় না নতুন নির্মিত ওই ভবনটির দিকে। আর করোনা পরিস্থিতির কারণে এটি চালুও করেনি স্থানীয় প্রশাসন।
উচিতপুর ঘাটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নানা শ্রেণি-পেশার লোকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনা পরিস্থিতির কারণে এবারের বর্ষা মৌসুমে এই ঘাটে ট্রলার ব্যবসা, মনোহারি, হোটেল, ফাস্টফুড, চা-কফি, টং দোকান, ভ্রাম্যমাণ দোকান, মিনিপার্ক, যাত্রী পরিবহন এবং ইজারা আদায়- প্রভৃতি সব ব্যবসা খাত মিলিয়ে অন্তত সাত-আট কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। আর এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে গোটা এলাকাটির অন্তত দেড় হাজার মানুষের জীবনব্যবস্থার ওপর। এছাড়া ঘাটটির প্রতি দূরদূরান্তের মানুষের যে আকর্ষণ সৃষ্টি হয়েছিল- তাতেও ভাটা পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
মদন উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) বুলবুল আহমেদ বলেন, ‘পর্যটকদের আগমনকে কেন্দ্র করে আমরা বর্ষার আগেই নৌযান চালকদের প্রশিক্ষণ, নৌ দুর্ঘটনা রোধে সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণ (লাইফ জ্যাকেট, বয়া ইত্যাদি), নৌযানের তালিকা তৈরি, ঘাটের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য সংশ্লিষ্টদের নিয়ে মতবিনিময়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশ মোতায়েন প্রভৃতি কাজগুলো সম্পন্ন করে রেখেছিলাম। কিন্তু করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে সরকার সব ধরনের জনসমাগমের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করায় উচিতপুরেও পর্যটকদের আাসা-যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে।’