টানা বৃষ্টিতে ভাসছে সাতক্ষীরা, হাজারো পরিবার পানিবন্দি

সাতক্ষীরার সাত উপজেলার দুইটি পৌরসভার নিম্নাঞ্চলে অতিবৃষ্টির কারণে ভেসে গেছে আমন ধানের বীজতলা, রোপা আমন, পুকুর, মাছের ঘের ও সবজি ক্ষেত। পানি থৈ থৈ করছে ৭৮ ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল।

মঙ্গলবার (২৭ জুলাই) থেকে শুরু হওয়া চারদিনের টানা বৃষ্টিতে ভেসে গেছে ২০ হাজারের মত ঘের। এতে মাছের ক্ষতির পরিমাণ ৫৩ কোটি ৪৯ লাখ টাকা বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। শুক্রবার সকালে রৌদ্র দেখা দেওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বস্তি দেখা গেলেও শনিবার (৩১ জুলাই) সকাল থেকে আবারও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে।

সদর উপজেলার ধুলিহর, ফিংড়ি, ব্রহ্মরাজপুর, লাবসা, বল্লী, ঝাউডাঙা ইউনিয়নের বিল গুলোতে সদ্য রোপা আমন ও বীজতলা পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। পানি অপসারণের কোন পথ না থাকায় বৃষ্টির পানি বাড়িঘরে উঠতে শুরু করেছে। সাতক্ষীরা শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রাণসায়ের খালও পানি টানতে পারছে না। প্লবিত এলাকার কাঁচা ঘরবাড়ি ধসে পড়েছে।

অতিবৃষ্টির ফলে গদাইবিল, ছাগলার বিল, শ্যাল্যের বিল, বিনেরপোতার বিল, রাজনগরের বিল, কচুয়ার বিল, চেলারবিল, পালিচাঁদ বিল, বুড়ামারা বিল, হাজিখালি বিল, আমোদখালি বিল, বল্লীর বিল, মাছখোলার বিলসহ কমপক্ষে ২০টি বিল ডুবে গেছে। এসব বিলের মাছের ঘের ভেসে পানিতে একাকার হয়ে গেছে। বেতনা নদী তীরবর্তী এই বিলগুলির পানি নদীতে নিষ্কাশন হতে পারছে না। এই পানি পৌরসভার ভিতরে ঢুকছে। গ্রামাঞ্চলের সব পুকুর পানিতে তলিয়ে গেছে। বেরিয়ে গেছে শত কোটি টাকার মাছ। সবজি ক্ষেতগুলি ভাসছে পানিতে। মানুষের যাতায়াতও ভোগান্তি বৃদ্ধি পেয়েছে।

বৃষ্টির পানিতে সয়লাব হয়ে গেছে উপকুলীয় উপজেলা শ্যামনগর, কালীগঞ্জ ও আশাশুনিসহ জেলার সাতটি উপজেলা। সেখানে প্রধান রাস্তার ওপর দিয়েও পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এসব এলাকার মাছের ঘেরও তলিয়ে গেছে।

তালা উপজেলার শ্রীমন্তকাটি গ্রামের মো. মতিয়ার মোড়ল ও আলিফ রহমান জানান, অতিবৃষ্টির কারণে ভেসে গেছে মাছের ছোট বড় ঘের ও পুকুর। তলিয়ে গেছে বীজতলাসহ অনান্য ফলস। ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে স্থানীয় কৃষকরা।

আশাশুনির উপজেলার দক্ষিণ দরগাহপুর গ্রামের ঘের ব্যবসায়ী হযরত আলী বিপ্লব ও মো. আব্দুস সাত্তার মোড়ল জানান, তার ২০ বিঘার একটি ঘেরে আমপানে ৫ লাখ, ইয়াসে ২ লাখ টাকার ক্ষতি হয়। এছাড়া গত তিন দিনের অতি বর্ষণে তার ঘের ভেসে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৪ লাখ টাকা।

 

শ্যামনগরের পদ্মপুকুর ইউনিয়ানের ঘের ব্যবসায়ী সোহবার হোসেন জানান, তার ১০০ বিঘার একটি ঘের রয়েছে। সেই ঘের ভেসে গেছে। ক্ষতি হয়েছে কমপক্ষে ৫ লাখ টাকা।

সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির যুগ্ম সদস্য সচিব আলী নূর খান বাবুল জানান, সাতক্ষীরা পৌরসভার অধিকাংশ নিচু এলাকা এখনো পানির নিচে। যত্রতত্র খালে নেটপটা দেওয়া ও অপরিকিল্পিত চিংড়ি ঘেরের ফলে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ফলে সামান্য বৃষ্টিতে তাদের এলাকা তলিয়ে যায়।

তিনি আরও জানান, কয়েক দিনে যে ব্যাপক বর্ষা হয়েছে তাতে চারিদিকে পানি থৈ থৈ করছে। চারিদিক আটকানো, পানি বের হওয়ার সুযোগ নেই। মানুষকে এই ডুবন্ত অবস্থা থেকে উদ্ধারের কোন ব্যবস্থা নেই। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে জেলার হাজারও পরিবার ।

সাতক্ষীরা জেলা ওয়ার্কার্স পাটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভেকোট ফাহিমুল হক কিসলু জানান, পৌরসভায় পানি নিষ্কাশনের যথাযথ ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকার কারণে মানুষ বছরের পর বছর ধরে জলাবদ্ধতায় ভুগছে। টানা বর্ষণে তলিয়ে গেছে পৌরসভার ইটাগাছা, কামাননগর, রসুলপুর, মেহেদিবাগ, রথখোলার বিল, মধুমোল্লারডাঙ্গী, বকচরা, সরদারপাড়া, পলাশপোল, পুরাতন সাতক্ষীরা, রাজারবাগান, বদ্দিপুর কলোনি, ঘুড্ডিরডাঙি ও কাটিয়া মাঠপাড়া, ডেয়ের বিলসহ বিস্তীর্ণ এলাকা।

শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আ ন ম আবু জার গিফারী জানান, পানিবন্দি হয়ে পড়েছে উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের কয়েক হাজার মানুষ। ইতোমধ্যে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা ২০ টন চাল দেওয়া হয়েছে।

সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী রিপন জানান, নিম্নচাপের প্রভাবে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ১৪৩ মি.মি. বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। গত ৫ বছরের মধ্যে এই অঞ্চলে এটাই সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড হয়েছে।

সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরেরর উপ-পরিচালক কৃষিবিদ নূরুল ইসলাম জানান, ভারি বর্ষণে জেলার নিম্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে ১ হাজার ৭০০ হেক্টর জমির রোপা আমন বীজতলার ক্ষতি হয়েছে। ৮৬০ হেক্টর রোপা আমন ধানের ক্ষতি হয়েছে। ৫০০ হেক্টর জমির সবজির ক্ষতি হয়েছে।

সাতক্ষীরা জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ কর্মকর্তা আবু বাসেত জানান, কালীগঞ্জে ঝড়ে ১৯টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্য উপজেলায় ক্ষতির পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।

সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মশিউর রহমান জানান, জেলার আশাশুনি, শ্যামনগর ও কালিগঞ্জ উপজেলার ১৯ হাজার ৪৫৯ টি মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘেরের আয়তন ১২ হাজার ৬৫ হেক্টর । মাছের ক্ষতির পরিমাণ ৫৩ কোটি ৪৯ লাখ টাকা।

সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির আজ (শনিবার) জানান, চলমান অতিবৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা নিরসনে জেলা ব্যাপী ঘেরের সকল অবৈধ নেট-পাটা স্থাপনকারীকে স্ব-উদ্যোগে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নেট-পাটা অপসারণ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্যথায় নেট-পাটা স্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

তিনি জানান, ঘর-বাড়িসহ অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণের কাজ চলছে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে প্রাপ্ত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আজকের মধ্যে পাওয়া যাবে ।

Share this post

scroll to top