ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে পাহাড় সমান হয়েছে। অবলোপনসহ এ খেলাপি ঋণ এখন প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যাংক থেকে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়। কিন্তু খেলাপি ঋণের ওপর উচ্চ আদালত থেকে রিট করে আবার নতুন করে ঋণ নেন খেলাপিরা। আবার নতুন ঋণখেলাপি হয়ে যান। এভাবেই কোনো কোনো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে কয়েক হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে। কিছু কিছু বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ নিয়ত করেই খেলাপি হওয়ার জন্য ঋণ নেন। ব্যাংকের অর্থ ফেরত না দেয়ার জন্যই যেন তারা ঋণ নেন। দামি গাড়ি হাঁকান। বিদেশে ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠান। দেশে বিদেশে আলিশান বাড়ি বানান। অথচ বছরের পর পর জনগণের অর্থ পরিশোধ না করে আটকে রাখেন। এবার ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। আশার কথা হলো এ বিষয়ে একই সুরে কথা বলছেন অর্থমন্ত্রী, ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা এমনকি আইন কমিশন পর্যন্ত। এ জন্য বিভিন্ন কৌশল নির্ধারণ করা হচ্ছে।
গতকাল রূপালী ব্যাংকের ব্যবসায়িক সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তাই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, অসাধু ব্যবসায়ী ও ব্যাংকারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। শক্ত ও বড় অনিয়মের বিরুদ্ধে দুর্বল ব্যবস্থা নিলে ব্যর্থ হতে হবে। দুষ্টু চক্রকে কোনোভাবেই ছাড় দেয়া হবে না। তিনি বলেন, মালয়েশিয়াতে ঋণখেলাপিদের তালিকা করা হয়। তাদের তালিকা সরকার বিভিন্ন সংস্থাকে দিয়ে থাকে। যাতে ঋণখেলাপিরা কোন ধরনের সুযোগ সুবিধা না পান। এমনকি দেশের বাইরেও যেতে না পারেন। আমাদেরকেও কঠোর হতে হবে অসাধুদের ব্যাপারে। কারণ অসাধু ব্যবসায়ীরা ঋণ নিয়ে থাকেন ব্যাংকের টাকা পরিশোধ না করার চিন্তা থেকে।
গতকাল বিকেলে খেলাপি ঋণ কমাতে একটি পরামর্শক সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখানে তফসিলি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক-এমডি ও প্রধান নির্বাহীরা ঋণখেলাপিদের আটকাতে বিভিন্ন পরামর্শ তুলে ধরেন। যেখানে বাংলাদেশ আইন কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকসহ কমিশনের সব সদস্য, আদালতের বাইরে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য গঠিত বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টারের (বিয়াক) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ এ (রুমি) আলী উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের সভাপতিত্বে এতে প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিলেন। সাড়ে তিন ঘণ্টা চলে এই উচ্চপর্যায়ের বৈঠক।
বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, এমডিরা বলেন, খেলাপি ঋণ আদায় করতে হলে সামাজিক চাপ তৈরি করতে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশে এমন চর্চা রয়েছে। ঋণখেলাপিরা ব্যাংকের দায় পরিশোধ করবেন না, কিন্তু বিলাসী জীবনযাপন করবেন সেটি যাতে না হয়। তাদের পাসপোর্ট নবায়ন আটকে দেয়া যেতে পারে। দেশের বাইরে যাতে ভ্রমণে যেতে না পারেন। এমনকি দেশের ভেতরে প্লেন টিকিট যাতে কিনতে না পারেন।
ঋণখেলাপিদের সন্তানদের ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ আটকে দেয়া যেতে পারে। তা ছাড়া এসব ব্যক্তি যাতে গাড়ি কিনতে না পারেন, বাড়ি কিনতে না পারেন সেটি কিভাবে করা যায় ভাবার সময় এসেছে।
এমডিদের এই পরামর্শের সাথে একমত আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক। আইনজ্ঞরাও বলছেন, দেশে খেলাপি ঋণ কমাতে চাইলে শক্ত পদক্ষেপ দরকার। তবে সবই নির্ভর করবে সরকারের মনোভাব ও সিদ্ধান্তের ওপর। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া কঠোরভাবে কোনো পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হবে না।
বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আজকে খেলাপি ঋণ নিয়ে আমাদের যে সভাটি হয়েছে সেখানে খেলাপি ঋণ কিভাবে কমানো যায় সেটি উঠে এসেছে। আলোচনা শুরু হলো। আলোচনা চলবে। তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ কমাতে বিদ্যমান আইনগুলো যদি সংস্কার ও যুগোপযোগী করা দরকার পরে সেটি করা হবে। আমরা নিজেরাও পর্যবেক্ষণ করছি এবং ব্যাংকাররাও জানিয়েছেন, ব্যাংক কোম্পানি আইন, অর্থঋণ আদালত আইন ও দেউলিয়া আইনের কিছু বিষয় সংস্কার দরকার। কারণ অনেকেই ব্যাংকের দায় পরিশোধ না করে আদালতে চলে যাচ্ছেন। সেখান থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসছেন।
তফসিলি ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, বৈঠকের উদ্দেশ্য একটাই। খেলাপি ঋণ। এটি সরকার চাচ্ছে কমাতে। আমরাও তাই চাই। কোনো উপায় নেই। এ জন্য পরামর্শক সভা হলো। এরপর আরো সভা হবে। আমরা আমাদের পরামর্শ তুলে ধরেছি। আইনি সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়েছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক, আইন কমিশন, আইন মন্ত্রণালয়, বিচারপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়Ñ সবাই একসাথে কাজ করা হবে। বৈঠক করা হবে। তিনি বলেন, টাকা নিলে ফেরত দিতে হবে এই মানসিকতা তৈরি করতে হবে। ঋণখেলাপিদের সামাজিকভাবে কিভাবে ঠেকানো যায় সেগুলো নিয়ে আলাপ হয়েছে। তবে বিস্তারিত এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে শুরু হলো একটি পদক্ষেপ। আমরা আশাবাদী, নিশ্চয়ই একাট পথ বের করা যাবে। এর আগে শুরু হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, নতুন অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, তার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে আর এক টাকাও খেলাপি ঋণ বাড়বে না। তার এ ঘোষণা বিদ্যমান ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুসারে বাস্তবায়ন করা আদৌ সম্ভব না। কারণ, ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া বেশির ভাগ বড় বড় ব্যবসায়ী ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যাংকঋণ পরিশোধ করছেন না। বিশেষ করে সরকারি ব্যাংক থেকে যারা ঋণ নিয়েছেন, বেশির ভাগেরই একই অবস্থা। ব্যবসায়ীরা ঋণ পরিশোধ না করলে খেলাপি ঋণ কমানো যাবে না। তবে মালয়েশিয়া, চীন, নেপালসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ঋণখেলাপিদের সামাজিকভাবে বয়কটের সিদ্ধান্ত নিলে খেলাপি ঋণ কমে যাবে। তবে এ জন্য প্রয়োজন আইন সংশোধন। এ ক্ষেত্রে সরকারকেই আগে উদ্যোগ নিতে হবে। কেননা ঋণখেলাপিদের অনেকেই আইনপ্রণেতা সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, সরকার সমর্থক ব্যবসায়ী, সাবেক আমলা, ব্যাংকের পরিচালক ও চেয়ারম্যানরা রয়েছেন। এ কারণে সরকারের সদিচ্ছা ছাড়া ঋণখেলাপিদের কোনোভাবেই আটকানো যাবে না।