ময়মনসিংহে মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘর উপহারের খবরে খুশি হয়েছিল ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের লোকজন। তবে এসব ঘর পেয়ে এখন উদ্ধেগ আর উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে এসব পরিবারের। তাদের মতে বন্যা হলেই মাটির মধ্যে ঢেবে যাবে ঘর, আর একটু ঝড়ো হাওয়া হলেই উড়ে যাবে টিনের দুর্বল চালা, ভেঙ্গে যাবে ঘর।
গরিবের এ ঘর যেন এখন মৃত্যুকোপে পরিণত হয়েছে। অথচ, এই ঘর পেতে ময়মনসিংহের এসব অসহায় ভূমীহীনদের দিতে হয়েছে দিতে হয়েছে শ্রম ও টাকা। যেসব পরিবার ঘর পেয়েছে সেসব পরিবারকে প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে এসে ইটের সুরকি ভাঙ্গাসহ নানান রকম কাজ করতে হয়েছে। তারপরও নিম্নমানের ঘর উপহার দেয়ায় ক্ষোভ ও হতাশা দেখা দিয়েছে গৃহহীনদের মাঝে।
জানা যায়, ময়মনসিংহে নির্দেশনা অনুযায়ী ৪ হাজার ৭০৮টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের তালিকা করা হয়। প্রথম পর্যায়ে ১৩ উপজেলায় ১ হাজার ৩০৫টি গৃহের অনুমোদন দেওয়া হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে জেলায় আরও ৬৪৫টি ঘর নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, এসব ঘর তৈরিতে নিম্নমানের ইট, বালু, কাঠ ও রড ব্যবহার করা হয়েছে। বারান্দা, পিলারসহ ঘরের বিভিন্ন অংশে ইতোমধ্যে দেখা দিয়েছে ফাটল। টিনের চালায় দুর্বল কাঠ ব্যবহার করায় টিন উপড়ে উঠে যাচ্ছে, বৃষ্টি হলেই ঘরের ভেতর পানি পড়ে ঘরে পানি জমে। পরিবারের সংখ্যার তুলনায় নলকূপের সংখ্যা একেবারেই কম। তাছাড়া যেসব নলকূপ বসানো হয়েছে সেগুলোর গভীরতা কম থাকায় পানিতে আয়রন দেখা দিচ্ছে, তাছাড়া নলকূপ বসানোর পর নলকূপের স্থান পাকা না করায় স্যাঁতস্যাঁতে ও ময়লা জমে তাকে নলকূপের চারদিকে। যা স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এছাড়া এসব আশ্রয়ণ প্রকল্পের এলকায় রাস্তাঘাট খুবই অনুন্নত। জরুরী মুমূর্ষ রোগীকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে যেমন বেগ পেতে হবে ঠিক তেমনি গর্ভবতী নারীদের জন্য চলাচলের রাস্তা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এই ঘর দেয়ার চেয়ে না দেয়াই উত্তম ছিল বলে মনে করছেন ভূমিহীন ও গৃহহীনরা।
ইতোমধ্যে তৈরিকৃত ঘরগুলোতে যেসব পরিবার বসবাস শুরু করেছেন তারা স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিয়ে দু:শ্চিন্তায় রয়েছেন। বেশকিছু টয়লেট কয়েকমাসের ব্যবধানে পরিপূর্ণ হয়েছে। কিন্তু এসব টয়লেটের মলমূত্র কোথায় নিষ্কাশন করা হবে তাও নির্ধারণ করেনি স্থানীয় প্রশাসন।
সরেজমিনে ময়মনসিংহ সদরের চর দক্ষিণপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, দ্বিতীয় ধাপের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলো তৈরি হচ্ছে নিম্ন মানের ইট দিয়ে। প্রতিটি ঘরের ফ্লোর ও ওয়ালে দেয়া হয়েছে ভাঙ্গা ইট। ফ্লোরে দেয়া হচ্ছে না রড। অনেক ঘরের ফ্লোরে ফাঁটল দেখা দিয়েছে। জানালার ওপরে ব্যবহার করা হয়েছে বাহির থেকে জোড়া দেয়া নষ্ট ইট ও সিমেন্টের প্রলেপ। ঘর তৈরি করতে যেসব রাজ মিস্ত্রি চুক্তিভিত্তিক কাজ করছেন তারাও জানিয়েছেন ভাঙ্গা ইট ব্যবহারের কথা।
প্রধানমন্ত্রীর উপহার পেয়ে খুশি হয়েছেন ময়মনসিংহ সদরের চর দক্ষিণপাড়ায় আশ্রয়ণ প্রকল্প-১ এর ঘর নেয়া সঞ্চিতা নামের গৃহহীন নারী। তবে তিনি এমন উপহার চাননি । এই ঘরে ওঠার আগেই নিজের জীবন নিরাপদ ছিল। কিন্তু এই ঘরে আশ্রয় নেয়ার পর থেকে নিজের জীবন নিয়ে টেনশনে থাকেন। কখনও ঝড় এলে উড়ে যেতে পারে টিনের চালা, বৃষ্টির পানিতে ঘর ভিজে যাওয়ার দু:র্বিসহ জীবন যাপেনের কথাও জানান এই নারী। তিনি অভিযোগ করে বলেন, এই ঘর পেতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে তাকে। প্রতিদিন ধোপাখলা থেকে গিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে ইট ভেঙ্গে দিতে হয়েছে। এভাবে কমপক্ষে দশদিন কাজ করেছেন তিনি। তিনি আরও বলেন, জানতে পেরেছি সরকার পরিবহণ খরচের জন্য টাকা বরাদ্ধ দিয়েছিল। কিন্তু আমরা প্রত্যেকটি পরিবারের সদস্যরা অনেক দূর থেকে গিয়ে মালামাল মাথায় করে এনে দিয়েছি। ফ্রি কাজ করে দিয়েছি।
আরেক গৃহহীন আব্দুল জব্বার জানান, ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ের এই প্রকল্পের ঘরগুলোর ভিটের নিচে ভালভাবে মাটি ভরাট করা হয়নি। অল্প কয়েকটি ইট দেয়া হয়েছে ভিটায়। ঘরের ভেতর চলাচল করলে ধপধপ শব্দ করে ফ্লোরে। মনে হয় ভিটের নিচে বড় ধরণের ফাঁকা জায়গা রয়েছে। এছাড়া ঘরে যেসব কাঠ ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো খুবই নরম। এক কাঠের সাথে আরেক কাঠের জোড়াও ঠিকমতো নাই। টিনের চালাতে হালকা ধরলেই নড়ে বসে গোটা ঘর। তিনি আরও বলেন, এই ঘরগুলো পেতে প্রত্যেক পরিবারকে প্রায় ৬ হাজার করে টাকা দিতে হয়েছিল ইউনিয়ন ভূমি অফিসের সহকারী কর্মকর্তাকে। এই খবর প্রকাশ হলে ওই কর্মকর্তা কিছু টাকা ফেরত দেন। পরে তাকে অন্যত্র বদলি করা হয়। এছাড়া প্রতি ১৫টি পরিবারের জন্য দুটি নলকূপ থাকলেও পানিতে তেমন স্বাদ নেই। তার মতে, কম গভীরের নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে।
নাম না প্রকাশের শর্তে আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর ঘর তৈরিতে কাজ করছেন এমন এক নির্মাণ শ্রমিক জানান, ২৭ হাজার টাকার চুক্তিতে প্রতিটি ঘর রাজমিস্ত্রির সাথে চুক্তি করা হয়েছে। তবে আরও কিছু টাকা নির্মাণে বাড়ানো হলে ঘরগুলো মজবুত হতো। তবে এখন তৈরি ঘরগুলো খুবই দুর্বল। কোনোমতে শুধু কাজ শেষ করেত আমরা চাপে আছি।
এদিকে কিছুদিন আগে নান্দাইলের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আবেদীন খান তুহিন নিজ এলাকায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর পরিদর্শনে গিয়ে কাজের মান দেখে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। অবহেলায় তৈরি গরিবের এই ঘরগুলোতে সঠিক নজরদারি ছিলনা বলেও জানিয়েছেন তিনি।
এমন ঘটনায় নান্দাইলের এমপি আনোয়ারুল আবেদীন খান তুহিন নিজের ফেসবুক আইডিতে লিখেছিলেন- ‘১০ নম্বর শেরপুর ইউনিয়নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভূমিহীনদের যে ঘর দিয়েছেন, তা পরিদর্শনে যাই। যারা এই ঘরগুলো তদারকি করে বানিয়েছেন, তাদের অনেক গাফিলতি আছে। এখনও বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির ব্যবস্থা হয়নি। সম্পূর্ণ প্রশাসনিক তদারকিতে এই ঘরগুলো নির্মাণ হয়েছে। কোনো জনপ্রতিনিধিকে সম্পৃক্ত করা হয়নি এই নির্মাণকাজে, কিন্তু কেন? এখন এই নিম্নমানের নির্মাণকাজের দায় কে নিবে?’
নান্দাইল উপজেলার ৫ নম্বর গাঙ্গাইল ইউনিয়নের শিয়ালধরা বাজারের কাছে গিয়ে দেখা যায়, পাশের জমির উচ্চতায় পাঁচটি ঘর তৈরি করা হয়েছে। নিম্নমানের কাঠ ব্যবহার করায় নিচের দিকে ঝুলে গেছে কয়েকটি বারান্দা। এক ঘরের চাল অন্য চালের ওপর পড়েছে।
এ ছাড়া ৮ নম্বর সিংরইল ইউনিয়নের বোরাঘাটে ঘর তৈরিতে নিম্নমানের কাঠ ব্যবহার করা হয়েছে। কোনোটির বারান্দা, পিলারে এরই মধ্যে ফাটল ধরেছে। ৯ নম্বর আচারগাঁও ইউনিয়নের চানপুর গ্রামে তৈরি করা ঘরগুলোতেও দেখা দিয়েছে বিভিন্ন স্থানে ফাটল।
এ ছাড়া অন্যান্য উপজেলায় নির্মিত ঘরগুলোর কিছু অংশে ফাটল রয়েছে বলে জানা গেছে। প্রয়োজন মতো নলকূপের ব্যবস্থা না থাকায় পানির জন্যও বেগ পোহাতে হচ্ছে অনেক পরিবারকে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় প্রথম পর্যায়ে ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে দুই শতক খাসজমি প্রদান করে ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়। দুই কক্ষবিশিষ্ট প্রতিটি আধা পাকা ঘরের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা। প্রতি ঘরের জন্য আরও ৪ হাজার টাকা অতিরিক্ত পরিবহণ খরচ ধরা হয়েছে। টিনের চাল, দেয়াল ও মেঝে পাকা বাড়িগুলো সরকার নির্ধারিত নকশায় নির্মাণ হয়। প্রতিটি ঘরে রান্নাঘর, সংযুক্ত টয়লেট, ইউলিটি স্পেসসহ অন্যান্য সুবিধা রয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে তালিকাভুক্ত গৃহহীনদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয় ঘরের চাবি। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় পর্যায়ে জেলায় ৬৪৫টি ঘর নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। এর মধ্যে সদরের ৭৫টি ঘর নির্মাণ শেষের দিকে।
এ ব্যাপারে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ এনামুল হকের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।