কলকাতার নগরপাল রাজীব কুমারকে ঘিরে অভূতপূর্ব সাংবিধানিক সংকট পশ্চিমবঙ্গে৷ বিশেষজ্ঞদের মতে, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে টানাপোড়েন নতুন ব্যাপার নয়, তবে চলতি পরিস্থিতির কোনো নজির ভারতের রাজনীতির ইতিহাসে নেই৷
বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তদন্ত চালাচ্ছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই৷ সোমবার সন্ধ্যায় সংস্থার তদন্তকারী অফিসাররা হঠাৎ কলকাতার নগরপালের সরকারি বাসভবনের সামনে উপস্থিত হন৷ তারপর থেকে নাটকীয় পট পরিবর্তন হয়ে চলেছে রাজ্য ও দেশের রাজনীতিতে৷ ধর্নায় বসেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি৷ সুপ্রিম কোর্টে রাজ্যের বিরুদ্ধে মামলা করেছে সিবিআই৷ এর ফলে অভূতপূর্ব সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরি হয়েছে৷ শুধু তাই নয়, এতে কার্যত ‘গৃহযুদ্ধের মতো’ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি যে কার্যত সাংবিধানিক সংকটের দিকে যাচ্ছে, সেটা স্পষ্ট৷ এই ঘটনা অভূতপূর্ব৷ ভারতের পক্ষে বলা যায়, রাষ্ট্র বিপজ্জনক জায়গায় যাচ্ছে৷ ভারতে গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় করবার যে প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে, সেগুলো বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে৷ এ জন্য কেন্দ্রীয় সরকার বা রাজ্য সরকার কোনো-না-কোনোভাবে দায়ী৷”
যুযুধান দু পক্ষ
কলকাতার মেট্রো চ্যানেলে মুখ্যমন্ত্রীর ধর্নাকে ‘অরাজনৈতিক চেহারা’ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে৷ গণতন্ত্র রক্ষার পাশাপাশি দেশের পুলিশ বাহিনীকে বাঁচানোর ডাক দেয়া হয়েছে৷ সেখানে রাজ্যের আইপিএস অফিসাররাসহ শিল্পী-কলাকুশলী অনেকেই উপস্থিত৷ রাজ্য সরকার, তথা শাসকদলের অভিযোগ, কোনো পরোয়ানা ছাড়াই রাজীব কুমারের বাড়ি গিয়েছিল সিবিআই৷অন্যদিকে সিবিআই-এর আঞ্চলিক যুগ্ম অধিকর্তা পঙ্কজ শ্রীবাস্তব গতকালই সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তাদের কাছে সব প্রয়োজনীয় নথি ছিল এবং সব কাগপত্রই তারা দেখিয়েছেন, তাও জোর করে তাদের আটক করা হয়েছে৷ অথচ রাজ্য পুলিশের যুগ্ম পুলিশ সুপার (ক্রাইম) প্রবীণ ত্রিপাঠি বলেছেন, সিবিআই কোনো সঠিক কাগজ দেখাতে পারেনি৷
এক্ষেত্রে যদি ধরে নেয়া হয় পরোয়ানা না নিয়েই গিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা, তাতে কত বড় ভুল হয়? এই প্রশ্নে আইনজীবী এবং কংগ্রেস নেতা অরুণাভ ঘোষের বক্তব্য, ‘‘পরোয়ানা আছে কী নেই, এটা কোনো বিষয় নয় জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে৷ তদন্তের স্বার্থে শুধু জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গেলে তো সার্চ ওয়ারেন্ট দরকার নেই৷”
আইন বিশেষজ্ঞ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য মনে করেন সার্চ ওয়ারেন্ট দেখানো বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া একটি কৌশল মাত্র৷ তিনি বলেন, ‘‘বাড়ি সার্চ করার ক্ষেত্রে সার্চ ওয়ারেন্ট লাগে৷ কথা বলা বা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তা লাগে না৷ নির্দিষ্ট নথি ছাড়া সিবিআই পুলিশ সুপারের বাড়ি গিয়েছে, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়৷”
বেআইনি ও অসংবিধানিক
মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি রোববার রাতে যেভাবে পুলিশ সুপার রাজীব কুমারের বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছিলেন, এবং সেখান থেকে বেনজিরভাবে রাজ্যের বিরোধী নেত্রীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ধর্ণার ডাক দিলেন, সে সম্পর্কে অরুনাভ ঘোষ বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী একটা সাংবিধানিক ক্রাইসিস তৈরি করেছেন৷ উনি খুব ভুল কাজ করেছেন৷ এখন রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না৷” বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যেরও মত, সাংবিধানিক সংকট তৈরি হয়েছে রাজ্যে৷ এক্ষেত্রে সংবিধানের ৩৫৫ ধারা জারি করে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলার নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে৷ এ ক্ষেত্রে হয়তো রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে হবে না৷ ত্রিপুরার প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল বিকাশ ভট্টাচার্যের মতে, ‘‘রাজ্য পুলিশ সিবিআই অফিসারদের আটক করে বেআইনি কাজ করেছে৷ তার থেকেও বেআইনি কাজ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী নিজে ওখানে পৌঁছে কেন্দ্রীয় সংস্থার বিরুদ্ধে প্রেস কনফারেন্স করে৷”
এমন ঘটনা যে ভারতে স্বাধীনতার পর কখনো হয়নি, সে ব্যাপারে একবাক্য সকলের৷ বিকাশরঞ্জন বলেন, ‘‘এমন ঘটনা ভারতে হয়নি৷ পৃথিবীর কোথাও হয়েছে কিনা জানি না৷ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে যে কেন্দ্রীয় গোযেন্দা সংস্থা কাজ করছে, তাদের কাজ করতে দিচ্ছে না রাজ্য পুলিশ৷ সেটা রাজনৈতিকভাবে উদ্বুদ্ধ হয়েই৷ এটা বেআইনি৷ পুলিশ নিজে আইনের রক্ষক হয়ে যেটা করেছে, সেটা বেআইনি৷” প্রশ্ন উঠছে, পুলিশ সুপার, তথা ব্যক্তিমানুষ রাজীব কুমারের দোষ-ত্রুটি থাকতেই পারে, তাঁর ঢাল হয়ে মমতা দাঁড়ালেন কেন? অন্তবর্তী সিবিআই-এর প্রধান নাগেশ্বর রাও সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তথ্যপ্রমাণ লোপাটের অভিযোগ রয়েছে রাজীব কুমারের বিরুদ্ধে৷
এই প্রসঙ্গে বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘আইনের চোখে সবাই সমান৷ তিনি পুলিশ কমিশনার হতে পারেন, রাষ্ট্রপতিও হতে পারেন, যে কোনো বিশিষ্টই হতে পারেন৷ সেই জন্যই তদন্তকারী সংস্থা যখন তাঁর কাছে পৌঁছেছে, তাঁর দায় ছিল, আইন মেনে সেই তদন্ত স্বীকার করা৷ তদন্তকারীদের সাহায্য করা৷ সেটা না করাটাই অপরাধ৷”
সত্যিই সংবিধানের ওপর খাঁড়া?
কেন্দ্র-রাজ্য সস্পর্ক নিয়ে এর আগে বহু ঘটনা ঘটেছে৷ সে সবকে ছাড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের এই ঘটনা যে নজির তৈরি করেছে, তা নিয়ে দ্বিমত নেই কারো৷
বুদ্ধিজীবী মহল থেকে রাজনৈতিক মহল পর্যন্ত সকলেই পুরো ঘটনায় হতবাক৷ অধ্যাপক উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এটা সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে হয়েছে, এখানে সিবিআইকে কী করে আটক করা গেল, সেটা বোঝা যাচ্ছে না৷ সংবিধানে এমন কোনো ঘটনার উল্লেখ নেই৷ সংবিধান যারা লিখেছেন, তারা এটা আঁচ করেননি৷ রাজ্য সরকারও এখন সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হতে পারেন৷ যা হচ্ছে এটা কোনো তরফেই কাম্য নয়৷”
একদিকে মমতার গণতন্ত্র বাঁচানোর ধর্না, অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ সিবিআই। এরই মধ্যে জেলায় জেলায় তৃণমূল সমর্থকেরা মিছিল শুরু করেছে৷ চলছে অবরোধের ঘটনাও৷ সব মিলিয়ে যা চলছে, তা আগে কখনো দেখা যায় নি৷ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক অনিন্দ্য বটব্যাল বললেন, ‘‘এই ঘটনা অভূতপূর্ব৷ যে সময় সিবিআই এই পদক্ষেপ নিলো, সেই সময়টা গুরুত্বপূর্ণ৷ আসন্ন লোকসভার আগেই এই পদক্ষেপ নিয়ে রাজনৈতিক তরজা উঠবে জোর কদমে৷ তবে অস্বীকার করা যাবে না যে, যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর ওপর একটা জোর আঘাত পড়বে এবং অলরেডি সেটা পড়েছে৷ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এটার সমাধানসূত্র কী হতে পারে, সেটাই এখন স্পষ্ট নয়৷”
আপাতত বল এখন সুপ্রিম কোর্টে৷ সোমবার ভারতের সর্বোচ্চ আদালতে রাজ্যের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত অসহযোগিতার অভিযোগ জানিয়েছে সিবিআই৷ আদালত জানিয়েছে, মঙ্গলবার শুনানি হবে এই মামলার৷
সূত্র : ডয়চে ভেলে