জামালপুরে গড়ে তোলা হচ্ছে দৃষ্টিনন্দন নগর স্থাপত্য শেখ হাসিনা সাংস্কৃতিক পল্লী। বিনোদন ও সংস্কৃতি চর্চাসহ ইতিহাস ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করতে শহরের প্রাণকেন্দ্র দয়াময়ী এলাকায় সাড়ে ৮ একর জমির উপর ২২৯ কোটি ৩৭ লাখ টাকা ব্যয়ে শেখ হাসিনা সাংস্কৃতিক পল্লী প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
সূত্র জানায়, প্রকল্পটির মূলব্যয় ছিল ১২৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এখন প্রথম সংশোধনী প্রস্তাবে ১০২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা বাড়িয়ে মোট ব্যয় ২২৯ কোটি ৩৭ লাখ টাকা করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ব্যয় বেড়েছে ৮১ দশমিক ১৮ শতাংশ।
এছাড়া ২০১৬ সালের মার্চ থেকে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য ছিল। পরবর্তী সময়ে ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়াই এক বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। কিন্তু এতেও বাস্তবায়ন শেষ না হওয়ায় ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া আরও এক বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়।
এবার প্রথম সংশোধনীতে এক বছর চার মাস মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ধরা হয়েছে। আর শুরু থেকে গত জুন মাস পর্যন্ত প্রকল্পটির অনুকূলে ব্যয় হয়েছে ৯৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। পিইসি সভায় প্রকল্পের আওতায় নতুন প্রস্তাবিত ওয়াটার ফাউন্টেন, ৩-ডি সিনেপ্লেক্স, ৯-ডি থিয়েটার এবং নাগরদোলা অঙ্গ চারটি বাদ দিয়ে ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) পুনর্গঠন করতে বলা হয়। ২০২২ সালের জুন মাসে শেখ হাসিনা সাংস্কৃতিক পল্লীর কাজ সম্পন্ন করতে এগিয়ে চলছে নির্মাণকাজ।
পুরো সাংস্কৃতিক পল্লীকে সাজানো হচ্ছে নানা দৃষ্টিনন্দন আর্কিটেকচারাল ডিজাইনে। বাস্তবায়িত হলে এই সাংস্কৃতিক পল্লী জেলার সব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও বিনোদনের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠবে। এটি হবে দেশসেরা একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।
এখানে থাকবে ২০ হাজার বর্গফুটের আন্ডারগ্রাউন্ড মিউজিয়াম। মিউজিয়ামের দুটি ফ্লোর জুড়ে জেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রতিফলিত হবে। থাকবে বাঙালি জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্যের সবকিছু। এখানে থাকবে মুক্তিযুদ্ধের বিস্তৃত ইতিহাস।
আন্ডারপ্লাস মিউজিয়ামের ছাদের অংশে থাকবে খোলা শহীদ মিনার। শহীদ মিনারের ছাদ ও দেয়ালে থাকবে শহীদদের মোরাল। শহীদ মিনারে যাওয়ার রাস্তা হবে সুদৃশ্য। অসুস্থ মানুষের শহীদ মিনারে যাওয়ার জন্য থাকবে বিশেষ ব্যবস্থা।
শহীদ মিনার ও মিউজিয়ামের পর থাকবে খোলা মাঠ, থাকবে সুদৃশ্য বৃত্তাকার লেক। লেকের চারপাশে ওয়াকওয়ে। লেকের পশ্চিমে থাকবে মুক্ত থিয়েটার মঞ্চ। মঞ্চটি এমনভাবে তৈরি হবে, দেখে মনে হবে এটি পানিতে ভাসছে। লেকের পশ্চিমে থাকবে শিশুদের জন্য চিলড্রেন আর্ট প্লাজা। লেকে থাকবে বোট প্লাজা, রেস্টুরেন্ট। লেকের মাঝখানে থাকবে সুদৃশ্য পায়ে হাঁটার সেতু। পল্লীতে থাকবে দেশের সবচেয়ে বড় ফেরিজ হুইল। এটির ডায়ামিটার হবে ৪৬ মিটার। দেশে এত বড় ফেরিজ হুইল আর কোথাও নেই।
এছাড়াও পল্লীর মূল কালচারাল ভবন হবে ১০ তলা। অত্যাধুনিক সব সুবিধাসহ এই ১০ তলা ভবনের গ্রাউন্ড ফ্লোর হবে পার্কিং এরিয়া। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় হবে কনভেনশন হল। এ ছাড়া তৃতীয় তলায় হবে উন্নত মানের রেস্টুরেন্ট। চতুর্থ তলা থেকে দশম তলা পর্যন্ত বরাদ্দ থাকবে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের জন্য। সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো এখানে নিয়মিত সংস্কৃতিচর্চা ও রিহার্সেলের সুযোগ পাবে।
এদিকে গৌরীপুর কাচারী মাঠের পূর্বপাশে হবে আটতলা বাণিজ্যিক ভবন। বাণিজ্যিক ভবনে দেশীয় পণ্য প্রসারে প্রাধান্য দেয়া হবে। পুরো পল্লীতে থাকবে নানা ডিজাইনের বাগান, বসার জায়গা, বিনোদন আর অবসর কাটানোর নানা উপকরণ। এখানে থাকবে বৈশাখী মেলাসহ যে কোনো মেলা করার মতো স্পেস। থাকবে রেস্ট হাউস।
প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ঐতিহ্যবাহী দয়াময়ী মন্দিরের মূল অংশ আদি রূপ ঠিক রেখে পূর্ব অংশে সুদৃশ্য দেয়াল নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। মন্দিরের সামনে এই দেয়ালকে সাজানো হবে চমৎকার ডিজাইনের সব ম্যুরাল দিয়ে। এটি হলে ঐতিহ্যবাহী মন্দিরটি মূল সড়ক থেকে দৃশ্যমান হবে।
জামালপুরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য ধরে রেখে মন্দিরের পাশের বর্তমান কাচারী শাহি জামে মসজিদের স্থলে হবে আটতলা মডেল মসজিদ। মূল কালচারাল ভিলেজ স্থানীয় সরকার বিভাগ বাস্তবায়ন করলেও মডেল মসজিদটি বাস্তবায়ন করবে গণপূর্ত বিভাগ। চারতলা এই মসজিদে থাকবে ইসলামী গবেষণা কেন্দ্র, পাঠাগার ও হলরুম।
এছাড়া গৌরীপুর কাচারীমাঠের পশ্চিমে প্রায় ১৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে অত্যাধুনিক শিল্পকলা একাডেমি। এখানে ৫০০ আসনের মূল অডিটোরিয়াম ছাড়াও তিনতলা ও চারতলা দুটি ভবনে থাকবে প্রশিক্ষণ কক্ষ, আধুনিক গ্রিনরুম ও আর্ট গ্যালারি। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে এটি বাস্তবায়ন করছে গণপূর্ত বিভাগ। সব মিলিয়ে শেখ হাসিনা সাংস্কৃতিক পল্লী বৃহত্তর জামালপুরের মানুষের জন্য হবে সংস্কৃতি ও বিনোদনের প্রাণকেন্দ্র।
ঢাকার বাইরে কোনো জেলাশহরে এমন কেন্দ্র এটিই প্রথম। এটি হবে দেশসেরা অন্যতম একটি সাংস্কৃতিক ও বিনোদন কেন্দ্র। এটি এতটাই দৃষ্টিনন্দন হবে যে, শুধু জেলার নয়, এর আকর্ষণ সারা দেশের মানুষকেই টানবে। এখানকার সৌন্দর্য বিমোহিত করবে তাদের।
প্রকল্পের প্রায় ৯০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। অবকাঠামোগত কাজ শেষ। সামান্য কিছু কাজ বাকি রয়েছে। বাকি কাজ শেষ হলে ২০২২ সালের জুন মাসে শেখ হাসিনা সাংস্কৃতিক পল্লী উদ্বোধনের সম্ভবনা রয়েছে।
শেখ হাসিনা সাংস্কৃতিক পল্লী চালু হলে জামালপুরের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিককর্মীদের সৃজনশীল মেধার বিকাশের ব্যাপক সুযোগ ঘটবে। শিল্পী, কলা-কৌশলীরা তাদের মেধার বিকাশে কাজ করতে পারবে এখানে। এ জেলার ২৬ লাখ মানুষের পাশাপাশি সারা দেশের বিনোদন পিপাসু মানুষ বিনোদনের জন্য ছুটে আসবে দৃষ্টিনন্দন নগর স্থাপত্য শেখ হাসিনা সাংস্কৃতিক পল্লীতে।
জামালপুর এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোখলেছুর রহমান বলেছেন, শেখ হাসিনা সাংস্কৃতিক পল্লীর নির্মান কাজ শেষ পর্যায়ে। বাকি কাজ এগুচ্ছেনা করোনার জন্য। যে কাজ টুকু আছে আশা করছি নিদ্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হবে।