আসল অভিযুক্তের নাম ছিল আবু সালেক। তার বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংকের সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির অভিযোগে তেত্রিশটি মামলা হয়েছিলো। সেই মামলায় চার্জশিটও হলো আবু সালেককে আসামি করে।
কিন্তু আবু সালেক দেখিয়ে যাকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো তার নাম আসলে জাহালম, পেশায় পাটকল শ্রমিক।
এরপর জাহালম গত তিন বছর ধরে আবু সালেকের অপরাধ আর দুদক ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের ভুলের শিকার হয়ে কারাগারে ছিলেন।
“যতবার আদালতে নিছে, বারবার বলছি স্যার আমি জাহালম, আবু সালেক না। কিন্তু কেউ শোনে নাই আমার কথা। আদালত শুনছে শুধু দুদক আর ব্যাংকের সাক্ষীর কথা। তারা শুধু আমাকে দেখিয়ে বলতো এটাই আবু সালেক,” জাহালম বলছিলেন বিবিসি বাংলাকে।
২০১৬ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি যখন তাকে গ্রেফতার করা হয় – তখন তিনি নরসিংদীর পাটকলে কাজ করছিলেন।
গ্রেফতার করে পাঠিয়ে দেয়া হয় টাঙ্গাইলের নাগরপুর থানায়। পরে সেখান থেকে আদালত হয়ে ঠাঁই হয় তার কারাগারে। এরপর ঠিক তিন বছর পূর্ণ হবার দু’দিন আগে হাইকোর্টের নির্দেশে মুক্তি পেয়ে বাড়িতে ফেরার পর তাকে নিয়ে রীতিমত হুলস্থূল পড়ে যায়।
কারণ ইতোমধ্যেই মানবাধিকার কমিশনের তদন্তেই প্রমাণ হয়েছে জাহালম আবু সালেক নন। বরং নির্দোষ হয়েও জেল খাটছেন তিনি।
পরে একটি টিভি চ্যানেল প্রথম বিষয়টিকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রচার করে। এরপর ঢাকার একটি দৈনিক পত্রিকায় খবরটি প্রকাশিত হলে সেটি হাইকোর্টের নজরে আনেন একজন আইনজীবী।
পরে শুনানি শেষে অর্থ জালিয়াতির অভিযোগে দুদকের করা সব মামলা থেকে জাহালমকে অব্যাহতি দিয়ে রবিবারই তাকে মুক্তির নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট।
এখন খুশি, আনন্দ আর হাসি
তিন বছর পর জেল থেকে মুক্তি পেয়ে ভাইয়ের সাথে মধ্যরাতে বাড়ি ফেরেন সাত বছর বয়সী কন্যা সন্তানের বাবা জাহালম।
“আমার এখন অনেক খুশি লাগতেছে। অনেক খুশী, আনন্দ, হাসি”।
জাহালম তিন বছর জেলখানার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বিবিসি বাংলাকে বলেন, “জেলখানায় কাঁদতে কাঁদতে দিন কেটেছে আমার। মনে হচ্ছিল আর বাইর হইতে পারুম না”।
তিনি বলেন, জেলের জীবন অনেক কষ্টের জীবন। “জেলের জীবন কবরের জীবনের মতো। অনেক কষ্টের। যে গেছে সেই বোঝে কষ্টটা। আর কেউ যেন এমন জেলে না দেয়।”
“আমার জীবন থেকে তিন বছর কেটে গেলো। আমি ক্ষতিপূরণ চাই। যারা জড়িত যারা আমাকে আসামী করল তাদের বিচার হোক। এ ধরনের ঘটনার শিকার যেনো আর কারো জীবনে ঘটে”।
“অনেক কষ্টে ছিলাম জেলে। সেবকের কাজ করতাম। ৪০ জন লোক ছিল ওয়ার্ডে। ওয়ার্ড মুছতাম সকালে। ভাত পানি আনতাম। তাদের চাদর লুঙ্গি ধুয়ে দিতাম একটু ভালো খাবারের আশায়”।
বাড়িতে ফেরা ও দুধ দিয়ে গোসল
জাহালমরা তিন ভাই ও তিন বোন। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে বাড়িতে ফিরতে ফিরতে ভোর প্রায় চারটা। কিন্তু মা মনোয়ারা বেগম তখনো অপেক্ষায়। উচ্ছ্বসিত ছিলেন প্রতিবেশীরাও। গ্রামের মেঠো পথ ধরে তিনি যখন বাড়িতে পৌঁছান তখন তাকে নিয়ে কান্নার রোল মা আর ভাই বোনদের।
সেখানেই দুধ দিয়ে গোসল করিয়ে ঘরে নেয়া হয় তাকে।
আবু সালেককে দেখতে চাই
বিবিসি বাংলাকে জাহালম বলেন, “যেই আবু সালেকের জায়গায় জেল খাটলাম তারে দেখতে চাই আমি। কেউ যদি আমার সামনে আনতো তারে। আমি বলতাম তোর কারণে আমার জীবন থেকে তিনটা বছর গেছে”।
তিনি বলেন যতবার আদালতে গেছি ততবারই বলছি আমি আবু সালেক না। তারা নাকি ছবির সাথে মিল পাইছিলো। অথচ চেহারাতেও কোনো মিল নাই।
কেন তাকেই আবু সালেক বানানো হলো
পাঁচ বছর আগে প্রথম যখন দুদকের চিঠি গিয়েছিল টাঙ্গাইলের বাড়িতে তখন জাহালম তার পাটকলে।
পরে ভাই শাহানূর মিয়ার কাছ থেকে খবর পেয়ে বাড়িতে আসেন জাহালম এবং এরপর দুই ভাই একসাথেই যান দুদক কার্যালয়ে।
সেখানে ব্যাংকের ফরমে ছবি বা স্বাক্ষর কোনো কিছুই মিলেনি সামান্য বাংলা জানা জাহালমের।
কিন্তু সেখানে থাকা ব্যাংক কর্মকর্তারা তাকেই আবু সালেক বলে চিহ্নিত করেন। এরপর আবার ফিরে যান পাটকলের কাজে।
প্রায় দু বছর পর পুলিশ তার খোঁজ শুরু করে। বাড়িতে না পেয়ে কর্মস্থল পাটকল থেকেই তাকে আটক করে স্থানীয় পুলিশ।
তখনই তিনি জানতে পারেন যে দুদক অভিযোগপত্র দিয়ে বলেছে তিনি ১৮ কোটি টাকা আত্মসাতের দায়ে অভিযুক্ত। জাহালমের বিশ্বাস তার গ্রামেরই অনেকে ব্যাংকে কাজ করেন এবং তাদের মধ্যেই একজন এগুলো করে তাকে ফাঁসিয়েছে।
“ওরাই করেছে। ওরাই ব্যাংককে আমার ঠিকানা দিয়েছে। পরে ব্যাংক ও দুদক আমারে জড়াইছে”। তিনি একজন ব্যাংক কর্মকর্তার নামও উল্লেখ করেছেন।
দুদকের তদন্ত কমিটি
কার ভুলে নির্দোষ হয়েও জেল খাটলো জাহালম – সেটি তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছে দুদক। সংস্থাটির চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, দুদকের একজন পরিচালককে প্রধান করে কমিটি করা হয়েছে। তদন্তকারী কর্মকর্তাদের কোনো ভুল থাকলে সেজন্য ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
যদিও জাহালম বিবিসি বাংলাকে বলছেন, “যার ভুলে আমি শাস্তি পেয়েছি তার কঠিন শাস্তি চাই আমি। ব্যাংক আর দুদকের যারা জড়িত তাদের বিচার হোক। আমি ক্ষতিপূরণ চাই”।
সূত্র : বিবিসি