ডাইং ফ্যাক্টরিতে ব্যবহারের জন্য আমদানি করা ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল সল্ট’কে খাবার লবণ হিসেবে বাজারজাত করছে নারায়ণগঞ্জের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। আমদানীকৃত শিল্প লবণকে সাধারণ খাবার লবণের সঙ্গে মিশ্রনের মাধ্যমে খাবার লবণ হিসেবে বাজারজাত করছে এরা ।
এতে করে সাধারণ মানুষ রয়েছে চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। নারায়ণগঞ্জে থেকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরবরাহ করা এসব লবণ না জেনেই বেশী ব্যবহার করছে ভোক্তারা। অসাধু সিন্ডিকেটের এমন কারসাজিতে দেশে উৎপাদিত লবণের বিক্রি কমে যাচ্ছে। ভরা মৌসুমেও নারায়ণগঞ্জের লবণ মিলগুলো চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। আয় কমে গেছে লবণ শ্রমিকদের।
সংশ্নিষ্টরা বলছেন, এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে কক্সবাজারের কয়েক লাখ লবণ শ্রমিক আর নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা লবণ মিল ও মিলের শ্রমিকদের ওপর।
চিকিৎসকরা বলছেন, শিল্প লবণের কারণে মানবদেহে কিডনী ও লিভার ড্যামেজসহ নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।এ লবণকে মাদকের চেয়েও ক্ষতিকর বিষ বলে মন্তব্য করেছেন লবণ ব্যবসায়ীরা।
নারায়ণগঞ্জ লবণ আড়ৎদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইদুর হক লিপন জানান, চিটাগাংয়ের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রতিদিনই ২০ থেকে ২৫টি ট্রাকভর্তি ইন্ডাস্ট্রিয়াল লবণ নারায়ণগঞ্জে আসছে। পরে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন কারখানায় ও গোডাউনে বস্তা খুলে বিভিন্ন খাবার লবণের ব্র্যান্ডের নামে ছোট ছোট প্যাকেটে ভরে ফেলা হয়। এসব লবণ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়।
লবণ ব্যবসায়িরা বলছেন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল লবণ দেখতে রিফাইন করা খাবার লবণের মতোই সাদা। তাই এটি আমাদনী করার পরপর বস্তা খুলেই ছোট ছোট প্যাকেটে ভরে বাজারজাত করা যায়। রিফাইন করতে হয়না। ফলে রিফাইন করা বাবদ টাকা বেঁচে যায়। ফলে এটি খুচরা বাজারে খাবার লবণের চাইতে কেজি প্রতি দশ থেকে বারো টাকা কমে বিক্রি করা যায়। এসকল লবণ সাধারণত জামালপুর, দিনাজপুর, রংপুরসহ বিভিন্ন মফস্বল এলাকাগুলোতে সরবরাহ করা হয়ে থাকে।
জানা গেছে, এই লবণ মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। দেশি লবণ চাষ করার পর এটির রঙ থাকে লালচে। লবণ মিলে এটি রিফাইন করার পর রঙ সাদা হয়। ইন্ডাস্ট্রিয়াল লবণ বা গ্লোবাল সল্টের সুবিধা হচ্ছে এটি দেখতে রিফাইন করা খাবার লবণের মতোই সাদা। রিফাইন করতে হয় না বলে এটাতে খরচ বেঁচে যায়। এ জন্য খুচরা বাজারে খাবার লবণের চাইতে কেজিপ্রতি ১০ থেকে ১২ টাকা কমে এটা বিক্রি করা যায়। দাম কম হওয়ায় এ লবণ ইতিমধ্যে বাজারে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) হিসাব অনুযায়ী, দেশে ভোজ্য লবণের চাহিদা ১৬ থেকে ১৭ লাখ টন, শিল্প লবণের চাহিদা ৩ লাখ ৮৩ হাজার টন। কিন্তু গত অর্থবছর দেশে শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ১৪ লাখ ৪০ হাজার ৭৫৮ টন লবণ আমদানি হয়েছে।
অর্থাৎ গত অর্থবছরে প্রায় ৪ গুন বেশী ইন্ডাস্ট্রিয়াল সল্ট আমদানি করা হয়েছে। এর মধ্যে সোডিয়াম ক্লোরাইড ৮ লাখ ৯০ হাজার ১৮০ টন, হোয়াইট সোডিয়াম সালফেট ৫ লাখ ২৪ হাজার ৮৪ টন ও সোডিয়াম সালফেটস ২৬ হাজার ৫৩০ টন আমদানি হয়েছে।
বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিল্প লবণের আমদানি আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। চাহিদার দ্বিগুণের বেশি আমদানি হওয়া শিল্প লবণ খোলাবাজারে ভোজ্য লবণ হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারদর অপেক্ষা স্থানীয় বাজারে অপরিশোধিত লবণের মূল্য বেশি হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সোডিয়াম সালফেটের নামে সোডিয়াম ক্লোরাইড আমদানি হচ্ছে। এতে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে।
মিয়ানমার থেকে অপরিশোধিত লবণের অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য উৎসাহিত হচ্ছে। স্থানীয় অসাধু ব্যবসায়ীগণ সোডিয়াম ক্লোরাইডের সঙ্গে সোডিয়াম সালফেট মিশিয়ে বাজারজাত করার ফলে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে।
ট্যারিফ কমিশন বলছে, কস্টিক সোডার কাঁচামাল হিসেবে আমদানি করা সোডিয়াম সালফেট দেখতে খাওয়ার লবণের মতোই। অসাধু ব্যবসায়ীরা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পরিমাণ সোডিয়াম সালফেট আমদানি করে তার সঙ্গে সাবান, ডিটারজেন্ট পাউডার ও গার্মেন্ট শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে আমদানি করা সোডিয়াম ক্লোরাইড মিশিয়ে বাজারে বিক্রি করছে।
জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জ ও আশেপাশের এলাকায় গড়ে ওঠা বেশীরভাগ লবণের মিলগুলোতে রিফাইন বা পরিশোধনের আধুনিক মেশিনারিজ নেই বললেই চলে। তারা দীর্ঘদিন ধরেই সনাতন পদ্ধতিতে লবণ পরিশোধন করে আসছে। কিন্তু বর্তমানে কমপক্ষে এক ডজন লবণ মিল ইন্ডাষ্ট্রিয়াল সল্ট বা শিল্প লবণকে দেশীয় লবণ বলে বাজারজাত করছে।
নারায়ণগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা মো: এহসানুল হক জানান, ইন্ডাস্ট্রিয়াল লবণ খেলে মানবদেহে কিডনী, লিভারসহ নানা অঙ্গে জটিল রোগ হতে পারে।
নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) সেলিম রেজা জানান, অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। এ বিষয়ে শীঘ্রই জোরালো অভিযান পরিচালনা করা হবে।
নারায়ণগঞ্জ লবণ আড়ৎদার সমিতির সভাপতি মামুন জানান, এই গ্লোবাল লবণ মাদকের চেয়েও ভয়ঙ্কর। মাদক মানুষকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে। কিন্তু এই লবণ বেশীদিন খেলে মানুষ জটিল সব রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ লবণ আড়তদার সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ মোতালিব মিয়া স্বপন জানান, দেশে লবণের ঘাটতি হলে সরকার ঘাটতির পরিমাণ নির্ধারণ করে মিলগুলোকে আমদানির অনুমতি দেয়। গত বছর দেশে পর্যাপ্ত লবণ উৎপাদন হয়েছে। তাই কোনো লবণ আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়নি। তবে দেশের বিভিন্ন শিল্পকারখানার জন্য বিশেষ করে ডাইং কারখানার জন্য লবণ আমদানির অনুমতি রয়েছে। নারায়ণগঞ্জের কয়েকটি লবণ মিল মালিকের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত সেই লবণকেই খাবার লবণ হিসেবে বাজারজাত করছে।
বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি পরিতোষ কান্তি সাহা জানান, খাবার লবণ হচ্ছে সোডিয়াম ক্লোরাইড। এটি সম্পৃক্ত পানি দিয়ে পরিশোধন করা হয়। যা মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর নয়। কিন্তু চীন থেকে শিল্পকারখানার জন্য যে লবণ আনা হচ্ছে, তা হচ্ছে সোডিয়াম সালফেট। এটা এসিড দিয়ে পরিশোধন করা যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। শিল্পকারখানায় ব্যবহার করার মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে আনা হলেও এগুলো খাবার লবণ হিসেবে বাজারজাত করা হচ্ছে।
পরিতোষ কান্তি জানান, বিসিকের হিসাব অনুযায়ী দেশে খাবার ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল লবণের চাহিদা ১৭ লাখ মেট্রিক টন। তবে মিল মালিকদের হিসাব অনুযায়ী, এই চাহিদা ৩১ লাখ মেট্রিক টন। দেশে খাবার ও শিল্পক্ষেত্রে প্রকৃতপক্ষে লবণের চাহিদা কত তাও সঠিকভাবে নিরূপণ করা প্রয়োজন। পাশাপাশি লবণের দাম কম রাখারও ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। দাম ও চাহিদার সমন্বয়ের অভাবেই অসাধু ব্যবসায়ীরা খাবার লবণের নামে কখনও বোল্ডার লবণ আবার কখনও ইন্ডাস্ট্রিয়াল লবণ বাজারজাত করতে পারে।
তার মতে, গত বছর দেশে লবণের পর্যাপ্ত উৎপাদন হয়েছে, এ বছরও হচ্ছে। কিন্তু এখনই অসাধু ব্যবসায়ীদের না ঠেকানো গেলে লাখ লাখ টন দেশীয় লবণ অবিক্রীত থেকে যাবে।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল সল্ট বাজারে প্যাকেটজাত করে বিক্রির অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে জেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালতে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনকে জরিমানা করা হয়েছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের প্রতি নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে। জেলা প্রশাসন, বিএসটিআই, বিসিক যৌথভাবে এর বিরুদ্ধে অভিযান চালাবে। এর সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে।