তাদের গলায় ঝুলানো চিরকুটে লেখা ছিলো তাদের নাম, কোনো ধর্ষণ মামলার তারা অভিযুক্ত এসব তথ্য। এছাড়া চিরকুটে আরো লেখা ছিল ‘ধর্ষকের ইহাই পরিণতি’ এমন একটি বাক্য।
বাংলাদেশে ধর্ষণের মামলায় অভিযুক্ত তৃতীয় এক ব্যক্তির লাশের গলায় ‘স্বীকারোক্তিমূলক’ চিরকুট লাগানো অবস্থায় পাওয়া গেছে গতকাল শুক্রবার। গত এক মাসের মধ্যে এরকম আরো দুটি ঘটনা ঘটেছে।
এর মধ্যে ঝালকাঠি জেলাতেই পাওয়া যায় দুটি লাশ এবং এগুলো একই ধর্ষণের মামলায় অভিযুক্ত দু’ব্যক্তির।
প্রথমে সজল জমাদ্দারের লাশ পাওয়া যায় ঝালকাঠি জেলার কাঁঠালিয়া উপজেলায় এক ধানক্ষেত থেকে। তার পর ছ’দিনের মাথায় একই ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্ত দ্বিতীয় ব্যক্তি রাকিব মোল্লার লাশ পাওয়া যায় গলায় চিরকুট ঝোলানো অবস্থায় – রাজাপুরে একটি ইটের ভাটার পাশে।
দু’জনেরই গলায় ঝুলানো চিরকুটে লেখা ছিলো তাদের নাম, কোন ধর্ষণ মামলার তারা অভিযুক্ত এসব তথ্য। এছাড়া চিরকুটে আরও লেখা ছিল : ‘ধর্ষকের ইহাই পরিণতি’ এমন একটি বাক্য।
শাহিন জমাদ্দার কিসলু, যিনি নিহত এই দুই ব্যক্তির সম্পর্কে যথাক্রমে মামা ও চাচা হন, তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এফআইআর হওয়ার আগেই সজলের লাশ পাওয়া যায় গত ২৬ জানুয়ারি । আর রাকিব উধাও হয় ২৫ তারিখ নবীনগর থেকে।”
তিনি অভিযোগ করেন – “আমার ভাইগ্না ও ভাতিজাকে নির্যাতন করে মারছে।”
“আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্ত হবে, তদন্তের পর বিচারে দোষী সাব্যস্ত হবে। তখন তাকে ফাঁসি দিক অথবা যাবজ্জীবন দিক সেটা আমরা মেনে নিতে পারি। কিন্তু এভাবে হলে তো আমরা সেটা মেনে নিতে পারি না” – বলেন শাহিন জমাদ্দার।
নিহত দু’জনই পাশের জেলা পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ার বাসিন্দা। তারা দু’জনেই একই এলাকার ১৩ বছর বয়সী এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত। এখন প্রশ্ন উঠছে – একই অপরাধের সাথে যোগসূত্র থাকা দুই অভিযুক্তর লাশ একইভাবে পাওয়া গেল কিভাবে?
ঝালকাঠির পুলিশ বলছে, তারা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছেন, তবে তাদের নিজেদের মনেও এই একই প্রশ্ন।
ঝালকাঠি জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলছেন, “বিষয়টা নিয়ে আমাদেরও একটা প্রশ্ন। কারণ হল এরা আমাদের এই এলাকার কেউ না, এদের বাড়ি এখানে না, এখানকার কোন অপরাধের তারা জড়িত না,তাদের অপরাধের ঘটনাস্থল অন্য জেলায়। এখন আমরাও বোঝার চেষ্টা করছি এই লাশগুলো এখানে কিভাবে আসলো। কারা এগুলো করছে তা আমরা তদন্ত সাপেক্ষে বলতে পারবো।”
বাংলাদেশে গত এক মাসে এ নিয়ে ধর্ষণে অভিযুক্ত তৃতীয় ব্যক্তির লাশ চিরকুট লাগানো অবস্থায় পাওয়া গেল।
প্রথম ঘটনাটি ঘটেছিল ঢাকার কাছে সাভারে। জানুয়ারির ১৮ তারিখ সেখানে ধর্ষণের ‘স্বীকারোক্তিমূলক’ চিরকুট গলায় ঝোলানো অবস্থায় একজন অভিযুক্তর লাশ পাওয়া যায়।
ঝালকাঠির প্রথমটি এবং সাভারের লাশটি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পাওয়া গেছে। সবশেষ শুক্রবার যেটি পাওয়া গেছে সেটির ময়নাতদন্ত চলছে। এমন ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল।
তিনি বলছেন, “এমন ঘটনায় ধর্ষণ তো কমাবেই না বরং এটাকে ঘিরে আরো অপরাধমূলক কাজের জন্ম হতে পারে। রাষ্ট্র যদি এই ধরনের কর্মকাণ্ড তৎক্ষণাৎ তৎপর হয়ে বন্ধ করতে না পারে, তাহলে তারা দায়বদ্ধ থাকবে জনগণের মধ্যে বিচার ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা সৃষ্টির জন্যে। সেটা খুবই একটা অশুভ লক্ষণ।”
তিনি বলছেন, “সাধারণ মানুষ এই ধরনের বিচার বহির্ভূত কর্মকাণ্ড সমর্থন করে যখন আইনের প্রতি সে আস্থা হারায়।”
তিনি আরো বলছেন, “সেই ক্লিন হার্ট অপারেশন থেকে শুরু করে ক্রসফায়ার দেখেছি, এনকাউন্টার বন্দুক-যুদ্ধ দেখেছি। জায়গায় জায়গায় মানুষের লাশ পাওয়া যাচ্ছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এই ধরনের যে আচরণ রয়েছে সেটার সুযোগ নিয়ে বাইরের মানুষ এমন কাণ্ড ঘটাতে পারে এমন আশঙ্কাও তৈরি হয়।”
তিনি বলছেন, একটি সভ্য সমাজে একজন মানুষের বিরুদ্ধে যত দুর্ধর্ষ অপরাধের অভিযোগ উঠুক না কেন, আইনি প্রক্রিয়াতে নিয়ে গিয়েই তাকে শাস্তি দেয়া যেতে পারে। আদালতের দায়িত্ব কার্যকর করার অধিকার কারো নেই।”
এমন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া ও প্রতিহিংসা মূলক আরো ঘটনার জন্ম দিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। তবে সব মিলিয়ে কে এভাবে হত্যা করছে, আর একই পদ্ধতি অবলম্বন করে কেন মরদেহগুলো ফেলে রেখে যাওয়া হচ্ছে – সে নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। সূত্র : বিবিসি