পুতিন-ট্রাম্প লড়াই ভেনেজুয়েলায়, কী হবে মাদুরোর?

নতুন পর্বের স্নায়ুযুদ্ধের নতুন ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়াল ল্যাটিন আমেরিকার দেশ ভেনিজুয়েলা। দেশটিতে ক্ষমতাধরদের মধ্যে যে লড়াই শুরু হয়েছে, তা নতুন এক মাত্রা নেবে বলে মনে হচ্ছে। ২৩ জানুয়ারি ভেনিজুয়েলার অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিরোধী দল নিয়ন্ত্রিত জাতীয় পরিষদের নেতা হুয়ান গুইয়াদোকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়ার সময় স্পষ্ট হয়, ল্যাটিন আমেরিকার এই দেশটিতে বড় ধরনের এক সংঘাত শুরু হতে যাচ্ছে। এর মধ্যে ভেনিজুয়েলার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির তেল কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির মাধ্যমে মার্কিন সরকার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর ওপর অর্থনৈতিক চাপ বাড়াচ্ছে। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন জানিয়েছেন, মাদুরোর নিয়ন্ত্রণ থেকে সরে এলে এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার নিন্দা জানিয়েছে রাশিয়া এবং চীন। ভেনিজুয়েলার প্রতিরক্ষামন্ত্রী লোপেজ বলেছেন, ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের’ বিরুদ্ধে লড়াই করতে সেনাবাহিনী প্রাণ দিতে প্রস্তুত। অন্য দিকে, বিরোধী নেতা হুয়ান গুইয়াদো বলেছেন, আমরা এখন স্বৈরশাসনের অধীনে। মাদুরোর পক্ষত্যাগী কিছু সেনা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অস্ত্র চেয়েছে। আর সুপ্রিম কোর্টে গুইয়াদোর সম্পদ জব্দ ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার আর্জি জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল। এসব ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে, ভেনিজুয়েলার অবস্থা একটি সিদ্ধান্তসূচক অবস্থার দিকে যাচ্ছে।

সামরিক হস্তক্ষেপের জল্পনা
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো যুক্তরাষ্ট্র ভেনিজুয়েলার ওপর তেল অবরোধ আরোপ করে দেশটির সব অর্থ সম্পদ আটকে দিয়ে এর কর্তৃত্ব যখন গুইয়াদোকে সমর্পণ করার কথা বলেছে, ঠিক একই সময়ে মাদুরোর পক্ষত্যাগী সেনারা অস্ত্র দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে তাদের পৃষ্ঠপোষকদের প্রতি। ভেনিজুয়েলার আটকে দেয়া অর্থ দিয়েই এখন গুইয়াদো বিদ্রোহকে সশস্ত্র রূপ দিতে অস্ত্র কিনতে পারবেন। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবেশী কলাম্বিয়ায় পাঁচ হাজার মার্কিন সেনা পাঠাতে পারেন বলে খবর বেরিয়েছে। এই খবরে যুক্তরাষ্ট্র ভেনিজুয়েলায় সামরিক অভিযান চালাতে যাচ্ছেন মর্মে জল্পনা তৈরি হয়েছে। যথারীতি এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে রাশিয়া এবং চীন। রাশিয়ার কর্মকর্তারা ভেনিজুয়েলার রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধানে মধ্যস্থতার কথা বললেও দেশটি ভেনিজুয়েলাকে দু’টি অত্যাধুনিক পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম বো¤¦ার সরবরাহ করেছে। এ ধরনের অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান অন্য কোনো দেশকে সরবরাহ করার দৃষ্টান্ত রাশিয়ার জন্য বিরল।

রাশিয়া মাদুরো সরকারের মূল সমর্থক এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভেনিজুয়েলার সাথে তার জ্বালানি ও সামরিক সম্পর্ক অনেক উচ্চপর্যায়ে সম্প্রসারিত করেছে। এর মধ্যে ভেনিজুয়েলার রাজনীতিতে বাইরের হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করেছে কারাকাসের বৃহত্তম ঋণদাতা চীন। চীন রাশিয়া দুই শক্তি মিলেই নিরাপত্তা পরিষদে এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার মতো যুক্তরাষ্ট্রকে কোনো প্রস্তাব নিতে দেয়নি। ভেনিজুয়েলাতে দীর্ঘস্থায়ী সঙ্কট চীনের বড় অঙ্কের বিনিয়োগ এবং ঋণ পরিশোধকে ঝুঁকির মুখে ফেলবে। এর পরও বেইজিং কূটনৈতিক মাধ্যমের বাইরে সামরিকভাবে এই সংঘাতে সম্পৃক্ত না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

পক্ষ-বিপক্ষ
ভেনিজুয়েলায় দীর্ঘ দিন ধরে বামপন্থী শাসন চলে আসছিল উদার গণতান্ত্রিক ধরনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। দেশটির একসময়ের ক্যারিসম্যাটিক বাম নেতা হুগো শ্যাভেজের অকাল মৃত্যুতে তার শাসনের অবসান ঘটার পর উত্তরাধিকারী হিসেবে বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাদুরো ক্ষমতায় আসেন। একসময়ের গাড়ি চালক মাদুরো নিজ প্রতিভাবলে হুগো শ্যাভেজের হাত ধরে ক্ষমতার শীর্ষ স্থানে চলে যান। তবে প্রথম মেয়াদেই তাকে শক্তিশালী বিরোধী পক্ষের কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়। এ সময়ে পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ হারান তিনি।

২০১৮ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় দফা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৬৭ শতাংশ ভোট পেয়ে তিনি জয়ী ঘোষিত হন। তবে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় বিরোধী দলগুলোর ব্যাপক বয়কটের মধ্য দিয়ে। আগের ছয় বছর শেষ হওয়ার পর গত ১০ জানুয়ারি থেকে এই নতুন মেয়াদ শুরু হয়েছে। এই মেয়াদকে অবৈধ ঘোষণা করে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা ও মাদুরোর প্রতিপক্ষ ৩৫ বছর বয়সী হুয়ান গুইয়াদো নিজেকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ঘোষণা করেন। এই ঘোষণার পর বিরোধীদলীয় নেতা হুয়ান গুইয়াদোকে সমর্থন করে স্বীকৃতি দেয় আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, কানাডা, চিলি, কলাম্বিয়া, কোস্টারিকা, ইকুয়েডর, জার্মানি, গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস, পানামা, প্যারাগুয়ে, পেরু, স্পেন, ইসরাইল, যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অন্য দিকে, প্রেসিডেন্ট মাদুরোকে সমর্থন করে বলিভিয়া, চীন, কিউবা, নিকারাগুয়া, রাশিয়া, ইরান, সিরিয়া ও তুরস্ক।

প্রেসিডেন্ট মাদুরো বলেছেন, তার দেশে অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। গুইয়াদো নিজেকে সরকারপ্রধান ঘোষণার আগের দিন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট পেন্সের সাথে কথা বলেছেন, যাতে গুইয়াদোকে বলা হয়েছে তিনি নিজেকে অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করলে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করবে। যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী পদক্ষেপেও এই বিষয়টির প্রমাণ পাওয়া যায়। গুইয়াদোকে স্বীকৃতি দেয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে ওয়াশিংটনে ভেনিজুয়েলার মিশন বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছেন মাদুরো। আর ৭২ ঘণ্টার মধ্যে আমেরিকান কূটনীতিকদের ভেনিজুয়েলা ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। যদিও পরে সিএনএনের সাথে এক সাক্ষাৎকারের সময় পরস্পরের স্বার্থরক্ষার জন্য একটি অফিস রাখা যাবে বলে সম্মত হয়েছেন।

অনিশ্চিত পরিস্থিতি
নতুন পরিস্থিতিতে ল্যাটিন আমেরিকার জ্বালানিসমৃদ্ধ দেশ ভেনিজুয়েলার সামনে একধরনের অনিশ্চিত অবস্থা সৃষ্টি হলো। দেশটির শাসন পরিবর্তনের এজেন্ডা যে যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে, সেটি আগে থেকেই বোঝা যায়। ল্যাটিন আমেরিকায় বাম ধারার সরকার একের পর এক পরিবর্তন করা হয়েছে। এটি করা হয়েছে প্রধানত নির্বাচনকে প্রভাবিত করার টুলসগুলোকে ব্যবহার করে। বিশ্বের বৃহত্তম প্রমাণিত জ্বালানি মজুদের এই দেশটি তেল রফতানিনির্ভর। আর বিশ্ববাজারে এর দাম কমে যাওয়ার কারণে প্রচণ্ড চাপে পড়ে। রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার কারণে দরিদ্রদের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীতে ভর্তুকি দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এতে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যায়। মানুষের দুর্ভোগও বাড়ে একই সাথে। এ অবস্থায় অর্থনৈতিক অবরোধ থেকে শুরু করে সব ধরনের চাপ প্রয়োগ করা হতে থাকে ভেনিজুয়েলার ওপর।

ভেনিজুয়েলায় সমান্তরাল সরকার গঠনের ঘোষণার পর আন্তর্জাতিক চাপ কিছুটা বাড়লেও দেশটিতে মাদুরোর নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত থাকবে বলেই মনে হচ্ছে। মাদুরোকে আট দিনের মধ্যে নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র যেসব দেশে শাসন পরিবর্তন করতে চেয়েছে সেসব দেশে মিডিয়ার প্রচার এবং অর্থনৈতিক উপকরণকে কাজে লাগাতে চেয়েছে। ল্যাটিন আমেরিকার ব্রাজিলসহ বেশ ক’টি দেশে নির্বাচনের মাধ্যমেই বাম ধারার সরকার পরিবর্তন করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু ভেনিজুয়েলা হলো দক্ষিণ আমেরিকার এমন একটি দেশ, যেখানে তীব্র মার্কিনবিরোধী জনমত এবং সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শের প্রভাব রয়েছে। তবে কিউবার কমিউনিজম বা সমাজতান্ত্রিক একদলীয় শাসনের পরিবর্তে ভেনিজুয়েলার শাসনপদ্ধতি উদার গণতান্ত্রিক। এখানে নিয়মিত নির্বাচনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ও সংসদীয় ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে আসছিল। হুগো শ্যাভেজ নির্বাচনে পরাজিত হয়ে ক্ষমতার বাইরেও ছিলেন আবার জনগণের সমর্থনেই ফিরে এসেছেন। ফলে ভেনিজুয়েলার মডেল মধ্যপ্রাচ্যের মিসর বা আলজেরিয়ার সাথে মেলে না। এর ফলে মাদুরো প্রেসিডেন্ট থাকাকালেই তার অধীনে নির্বাচনে সংসদে বিরোধী পক্ষ জয় লাভ করেছে।

নতুন স্নায়ুযুদ্ধ!
মাদুরোর প্রথম দফা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়ও বিরোধী পক্ষ কারচুপির অভিযোগ আনেন। এবার সেই অভিযোগে নির্বাচন বয়কট করে বিরোধী পক্ষ। বিরোধী পক্ষ বিক্ষোভ সমাবেশের মাধ্যমে সরকারকে চাপে ফেলে নতুন নির্বাচনে বাধ্য করতে চাইছে। ভেনিজুয়েলার নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট মাদুরো কতটা কারচুপির জন্য প্রভাব বিস্তার করেছেন, সেটির চেয়ে বড় বিষয় হলো দেশটির সর্বশেষ উন্নয়ন ল্যাটিন আমেরিকায় রুশ-মার্কিন নতুন পর্বের স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা করল বলে মনে হয়। এরকম একটি পরিস্থিতি যে সৃষ্টি হতে যাচ্ছে, তার জন্য মাদুরো ও তার সোশ্যালিস্ট জোট আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। এ জন্য মাদুরো মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্যের বিকল্প যে বলয় রয়েছে, সে বলয়ের দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক জোরালো করেছেন। ইরানের ওপর অবরোধ আরোপের পর যে ক’টি দেশ তেহরানের পাশে দাঁড়িয়েছিল তার মধ্যে একটি হলো ভেনিজুয়েলা। তুরস্কের অর্থনীতির ওপর যে আঘাত স্থানীয় মুদ্রার ওপর চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে করা হয় তখনো মাদুরো দেশটির পাশে দাঁড়ান।

মাদুরো তুর্কি অর্থনীতির সহায়তার জন্য বাকিতে ও ডিসকাউন্টে আঙ্কারাকে জ্বালানি তেল সরবরাহের প্রস্তাব করেন। যার প্রতিদান হিসেবে মাদুরোর দুঃসময়ে এরদোগান তার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। তুরস্কের বিশ্লেষকেরা এমনও মনে করেন যে, অর্থনৈতিক খাতে ধস নামিয়ে তুরস্কে সরকারের পরিবর্তন ঘটানোর জন্য যে প্রচেষ্টা যুক্তরাষ্ট্র চালিয়েছে, সেই প্রচেষ্টারই ধারাবাহিকতা এখন ভেনিজুয়েলায়। আর ভেনিজুয়েলায় শাসন পাল্টাতে পারলে এর পরে তুরস্কও তার লক্ষ্যবস্তু হতে পারে। এ অবস্থায় ভেনিজুয়েলাকে সমর্থনের জন্য তুরস্ককে বেশ খানিকটা মূল্যও দিতে হওয়ার ঝুঁকি সত্ত্বেও এরদোগান সেটি নিয়েছেন।

চলমান বিশ্বব্যবস্থার জন্য ভেনিজুয়েলার ঘটনাটি একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করবে বলে মনে হচ্ছে। এককেন্দ্রিক ব্যবস্থার পর ক্রিমিয়া দখল এবং জর্জিয়া অঞ্চলে রাশিয়ান প্রভাব বিস্তারের মধ্য দিয়ে আমেরিকাকে প্রথম চ্যালেঞ্জ করেন পুতিন। ইউক্রেন ও জর্জিয়া ফ্রন্টের এই লড়াইয়ে রাশিয়ার এক ধরনের জয় হয়েছে। এরপর পুতিন হাত বাড়ান মধ্যপ্রাচ্যে। সিরিয়ায় রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপ মাঠের পুরো পরিস্থিতি পাল্টে দেয়। পতনোন্মুখ বাশার আসাদের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় সিরিয়ায়। ইরানে শাসন পরিবর্তনের একাধিক প্রচেষ্টায় তেহরানের পাশে দাঁড়ায় রাশিয়া। পাশ্চাত্যের প্রতি এই চ্যালেঞ্জে চীনের সাথে জোট গঠন করে রাশিয়া। চীনের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক শক্তি এবং রাশিয়া প্রতিরক্ষা সক্ষমতা মিলে একটি চ্যালেঞ্জিং জোট তৈরি হয়। পাশ্চাত্যের এই বিকল্প শক্তি কৌশলগত লড়াইয়ের নতুন কেন্দ্র হিসেবে বেছে নেয় আফগানিস্তানকে। আফগানিস্তানের পরিস্থিতি এখন পরিণতির কাছাকাছি পৌঁছেছে। সেখানে তালেবানের সাথে আলোচনা শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। কাতারের সর্বশেষ আলোচনায় হওয়া খসড়া চুক্তি অনুসারে ১৮ মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র দেশটি থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেবে।

এখনকার স্নায়ুযুদ্ধের সর্বশেষ লড়াইয়ের ক্ষেত্র হলো ভেনিজুয়েলা। কী হতে পারে দেশটিতে এটি একটি বড় প্রশ্ন। এখানে মাদুরোর পতন শুধু একটি দেশের শাসন পরিবর্তনই নয়। এর প্রভাব পড়বে বিশ্বের সর্বত্র। বর্তমান পরিস্থিতির একটি দৃশ্যপট এমন হতে পারে যে, প্রেসিডেন্ট মাদুরোর শাসনকাঠামো ভেঙে পড়ে দেশটিতে আমেরিকান শাসন পরিবর্তন এজেন্ডা বাস্তবায়ন হয়ে গেছে। তেমনটি হলে ল্যাটিন আমেরিকার বাকি দেশগুলোতে বাম শাসনের অবসান ঘটানোর চেষ্টা হবে।

সমঝোতায় সমাধান?
যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটি’র প্রফেসর এমেরিটাস নোয়াম চমস্কিসহ ৭০ জন বরেণ্য বুদ্ধিজীবীর বক্তব্যে ভেনিজুয়েলা সঙ্কটের মূল একটি বিষয় উঠে এসেছে। এক খোলা চিঠিতে তারা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ভেনেজুয়েলাকে সঙ্কটের চূড়ায় ঠেলে দিয়েছে। হুয়ান গুইয়াদোকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন সুস্পষ্টভাবে ভেনিজুয়েলার সঙ্কটকে তীব্র করেছে। তারা ভেনিজুয়েলা সেনাবাহিনীকে বিভক্ত ও জনগণের মেরুকরণকে আরো তীব্র করতে কোনো একটি পক্ষকে বেছে নিতে বাধ্য করছে। এর সুস্পষ্ট এবং অনেক সময় বর্ণিত লক্ষ্য হলো নিকোলাস মাদুরোকে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত করা।

খোলা চিঠিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ভেনিজুয়েলার সরকার এবং বিরোধীদের মধ্যকার আলোচনায় সমর্থনের আহ্বান জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘ওই আলোচনার লক্ষ্য হবে দেশটির বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার যথার্থ সমাধান খোঁজা। ভেনিজুয়েলার কোনো পক্ষই সহজেই অপর পক্ষকে খারিজ করতে পারে না। এমন পরিস্থিতিতে আলোচনাই সমাধানের একমাত্র পথ। আর এই আলোচনা হতে হবে ভেনিজুয়েলার জনগণ, এই অঞ্চল এবং জাতীয় সার্বভৌমত্বের নীতির ভিত্তিতে।’

ভেনিজুয়েলার পরিস্থিতিকে সমাধানের দিকে নিয়ে যেতে হলে এই সমঝোতা হতে হবে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া-চীনের মধ্যে। তারা ভেনিজুয়েলার অভ্যন্তরীণ পক্ষগুলোর মধ্যে সমঝোতার ব্যবস্থা করে দিতে পারে। এই সমঝোতার আওতায় একটি মধ্যমেয়াদি নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকতে পারে। কিন্তু তা না করে যুদ্ধ ও সংঘাতের মধ্যে সমাধানের পথ খোঁজা হলে এই সংঘাত ল্যাটিন আমেরিকার অন্যান্য দেশে এমনকি আমেরিকান উপমহাদেশেও ছড়িয়ে যেতে পারে। এর আগে সামরিক অভিযান বা শক্তি প্রয়োগের কৌশলে শাসন পরিবর্তনের একাধিক প্রচেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র্র সফল হয়নি।

এখানে অর্থনৈতিক অবরোধ ও সামরিক উপায়ে যে সমাধানের চেষ্টার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, তাতে রাশিয়া-চীন বসে থাকবে না। রুশ বার্তা সংস্থা স্পুটনিককে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে নিকোলাস মাদুরোর বক্তব্যেও বিষয়টি স্পষ্ট। এই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট পুতিন সর্বদা সর্বক্ষেত্রে আমাদের সহায়তা করছেন এবং এ জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক পর্যায়ে তিনি আমাদের সমর্থন দিয়েছেন। কয়েক দিন আগে তিনি আমাকে বলেছিলেন, আমরা অর্থনীতি, বাণিজ্য, তেল, গ্যাস, সামরিকবিষয়ক তথা সব এলাকায় সহযোগিতাকে জোরদার করব। সামরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে, আমাদের সর্বোচ্চ স্তরের রাশিয়ান সরঞ্জাম আছে; সবচেয়ে আধুনিক অস্ত্রব্যবস্থা এখন ভেনিজুয়েলায় রয়েছে। আমরা রাশিয়া থেকে আকাশ প্রতিরক্ষা, আর্টিলারি এবং রকেট প্রযুক্তি উন্নত করার জন্য আরো সহযোগিতা নেয়ার পরিকল্পনা করেছি।’ চলমান উত্তেজনাকর সময়ে মাদুরোর এই বক্তব্যে স্পষ্ট ভেনিজুয়েলায় আমেরিকা সামরিক অভিযান চালালে সেখানে রুশ সমরাস্ত্র ও সামরিক উপদেষ্টাদের মোকাবেলা করতে হবে। এ পথে এগোনোর আগে ট্রাম্পকে বিশেষভাবে ভাবতে হবে। আর ট্রাম্প প্রশাসন উত্তেজনা তৈরি করে নিজ দেশের শাট ডাউন বা অন্যান্য ব্যর্থতার বিষয়গুলোকে আড়াল করা অথবা অভিসংশনের সম্ভাব্য উদ্যোগ ঠেকাতে চাইলে এই উত্তেজনা বেশি দূর না-ও এগোতে পারে। সে ক্ষেত্রে জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমেও একটি সমাধানের রাস্তা বের করার চেষ্টা হতে পারে।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top