যমজ যে ভাই-বোন ফিলিস্তিনি আন্দোলনের নতুন মধ্যমণি

গাজায় যুদ্ধবিরতির দুই সপ্তাহের মাথায় আবারও ইসরায়েল অধিকৃত পূর্ব জেরুসালেমের শেখ জাররাহ মহল্লায় উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। উচ্ছেদের হুমকিতে রয়েছে শেখ জাররাহ’র যে চারটি ফিলিস্তিনি পরিবার ; তাদের একটি এল-কুর্দ পরিবার। রবিবার ইসরায়েলি পুলিশ ঐ বাড়িতে ঢুকে ২৩ বছরের তরুণী মুনা এল কুর্দকে ধরে নিয়ে যায়। খবর পেয়ে তার ভাই মোহাম্মেদ এল কুর্দ পুলিশ স্টেশনে গিয়ে স্বেচ্ছায় গ্রেফতার বরণ করেন। কয়েক ঘণ্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর পুলিশ তাদের ছেড়ে দেয়।

মুনা এবং মোহাম্মেদের বাবা নাবিল এল কুর্দ পরে সাংবাদিকদের বলেন, হঠাৎ ঘরে ঢুকে পুলিশের তল্লাশি এবং মেয়েকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় তিনি হতবাক হয়ে পড়েছিলেন।

কেন বিনা উসকানিতে মুনা কুর্দকে ইসরায়েলি পুলিশ ধরে নিয়ে যায়?
পুলিশের দেয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সম্প্রতি পূর্ব জেরুসালেমে দাঙ্গায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে করা এক মামলায় তাকে আটক করা হয়।

মুনা বা তার ভাই মোহাম্মেদ নিজেরা শেখ জাররাহ বা আল আকসা মসজিদ চত্বরে ইসরায়েলি পুলিশের দিকে পাথর ছুঁড়েছিলেন কিনা বা ছুঁড়তে উৎসাহ দিয়েছিলেন কিনা তা নিশ্চিত নয়। কিন্তু এই দুই যমজ ফিলিস্তিনি ভাই-বোন এখন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের প্রতিবাদ আন্দোলনের মধ্যমণি হয়ে উঠেছেন।

বিশেষ করে শেখ জাররাহ থেকে ফিলিস্তিনি উচ্ছেদের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে প্রতিবাদ তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা রেখেছেন এই দুই ভাই-বোন।

রবিবার যখন তাদের আটকের খবর সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, মুহূর্তের মধ্যে তাদের প্রচুর সমর্থক দলে দলে পূর্ব জেরুজালেমের ঐ পুলিশ স্টেশনের কাছে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। সে সময় পুলিশের ছোঁড়া স্টান গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাস ডজন-খানেক ফিলিস্তিনি জখম হয়েছে।

মুনা-মোহাম্মেদ এবং টুইটার-ইনস্টাগ্রাম
গত ক’মাসে তরুণ বয়সী এই দুই ভাই-বোন শেখ জাররাহ থেকে উচ্ছেদ ঠেকানোর আন্দোলন এবং সার্বিকভাবে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি প্রতিবাদ আন্দোলনের অত্যন্ত পরিচিত দুই মুখ হয়ে দাঁড়িয়েছেন।

বিশেষ করে সোশাল মিডিয়ায় এই আন্দোলনে তারা কার্যত নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তারা দু’জনই টুইটার এবং ইনস্টাগ্রামসহ সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন প্লাটফর্মে খুবই সরব।

ইনস্টাগ্রামে মুনার ফলোয়ারের সংখ্যা এখন ১৩ লাখের মতো। টুইটারে অ্যাকাউন্ট খুলছেন মার্চ মাসে কিন্তু এরই মধ্যে তার ফলোয়ারের সংখ্যা ৬৪ হাজার। দিনে দিনে সেই সংখ্যা বাড়ছে।

টুইটারে তার ভাই মোহাম্মেদের ফলোয়ারের সংখ্যা প্রায় দুই লাখের কাছাকাছি।

তিন মাস আগে মুনা ‘সেভ শেখজাররাহ’ (শেখ জাররাহকে বাঁচাও) হ্যাশটাগে সোশ্যাল মিডিয়ায় যে ক্যাম্পেইন শুরু করেন সেটাই সারা বিশ্বের ফিলিস্তিনি এবং তাদের সমর্থকদের নজর কাড়ে এবং দ্রুত তা বড় একটি আন্দোলনে দানা বাঁধে।

মোহাম্মেদ এই মুহূর্তে জেরুজালেমে থাকলেও উচ্চশিক্ষার জন্য নিউইয়র্কে থাকেন তিনি। কিন্তু সেখানে বসেই ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগের বিভিন্ন ইস্যুতে তিনি অনলাইনে এবং মূলধারার মিডিয়াতে নিয়মিত লেখালেখি করেন। বয়স মাত্র ২৩ হলেও সিএনএন, গার্ডিয়ান বা আল জাজিরাসহ প্রথম সারির মিডিয়ায় তার একাধিক সাক্ষাৎকার এবং লেখা প্রচার হয়েছে।

ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগের ইতিহাস নিয়ে লেখা তার একটি বই বর্তমানে প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।

কথা এবং লেখাতেও খুবই ধারালো এই দুই ভাইবোন।

রবিবার পুলিশের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার পর মুনা সাংবাদিকদের সামনে বলেন, “আমাদের ভয় দেখাতে, আতঙ্কিত করতে তারা (ইসরায়েল) যাই করুক না কেন, যতবারই আমাদের গ্রেফতার করুক, আমরা ভয় পাই না।“

পরপরই ভাই মোহাম্মেদ টুইট করেছেন, “আমরা স্বাধীন, মুক্ত। আমাদের ভয় নেই। তারা (ইসরায়েল) কখনই আমাদের আতঙ্কিত করতে পারবে না।“

তাদের এসব কথা, টুইট হাজার হাজার শেয়ার হচ্ছে।

উচ্ছেদের মুখে মুনা-মোহাম্মেদের পরিবার
কিন্তু কেন মুনা এবং মোহাম্মেদ এই বয়সে শেখ জাররাহ নিয়ে এতটা তৎপর হয়ে পড়লেন? কারণ, শেখ জাররাহতে যা হচ্ছে তার সরাসরি শিকার হয়ে পড়েছেন তারা এবং তাদের পরিবার।

যে চারটি পরিবারকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে আল কুর্দ পরিবার তাদেরই একটি।

দু’হাজার নয় সালে তাদের বাড়ির অর্ধেকটা সরকার নিয়ে তা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা অভিবাসী একটি ইহুদি পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে।

মোহাম্মেদ এবং মুনার বয়স তখন নয়। হঠাৎ একদিন তারা দেখেছে যে বাড়িতে তারা কয়েক প্রজন্ম ধরে বসবাস করছে তার একটি অংশে অন্য দেশে থেকে আসা একটি ইহুদি পরিবার থাকতে শুরু করেছে।

সম্প্রতি আল জাজিরা নেটওয়ার্কের সাথে এক সাক্ষাৎকারে মোহাম্মেদ আল কুর্দ বলেন, ঐ বয়সে অজানা অচেনা কিছু মানুষ “যারা ব্রুকলিনের ইংরেজি উচ্চারণে“ কথা বলে তাদের সাথে বাড়ি ভাগাভাগি করাটা ছিল ‘অসহ্য, ভয়াবহ’ এক অভিজ্ঞতা।

তিনি বলেন, “লোকগুলো আমাদের বাড়িতে বসে রয়েছে, আবার আমাদের ভয় দেখাচ্ছে, উসকানি দিচ্ছে, বাড়ির বাকি অংশ থেকে যেন আমরা চলে যাই তার জন্য যা করার দরকার তাই করছে। শুধু আমাদের নয় আমাদের প্রতিবেশীদেরও হয়রানি করছে। তাদের উদ্দেশ্য একটাই – ফিলিস্তিনিরা যেন জেরুজালেম থেকে চলে যায়।“

মুনা এবং মোহাম্মেদের পরিবারসহ যে চারটি পরিবারকে শেখ জাররাহ থেকে উচ্ছেদ করার পক্ষে জেরুজালেমের একটি আদালত রায় দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো – যে জমিতে তাদের বাড়ি তার মালিক তারা নয়। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র তৈরির আগে ঐ জমি ছিল ইহুদিদের, এবং তাদেরকে সেই জমি ফেরত দেয়া হচ্ছে।

কুর্দ পরিবার বলছে, ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র তৈরির সময় হাইফা শহর থেকে বাড়ি-ঘর ফেলে তারা পূর্ব জেরুজালেমে পালিয়ে আসলে শেখ জাররায় তাদের পুনর্বাসন করা হয়। পূর্ব জেরুজালেম তখন জর্ডানের নিয়ন্ত্রণে ছিল।

ইসরায়েলের বর্তমান আইন অনুযায়ী ইহুদিরা কাগজপত্র দেখিয়ে ফেলে যাওয়া কোনো জমির মালিকানা প্রমাণ করতে পারলে সেই জমি তারা ফেরত পাবে। ফিলিস্তিনিরা সেখানে কতবছর ধরে রয়েছে সেটি কোনো বিবেচনা নয়।

কিন্তু ১৯৪৮ এ ইহুদিদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ফিলিস্তিনি পরিবার বর্তমান ইসরায়েলের বিভিন্ন জায়গা থেকে পালিয়ে আসলেও ফেলে আসা জমি-বাড়ি দাবি করার কোনো আইনি অধিকার তাদের নেই।

জেরুজালেমের আদালতের রায়কে যদি ইসরায়েলের সুপ্রিম কোর্ট বহাল রাখে, উচ্ছেদের ঝুঁকিতে পড়া পরিবারগুলোর আপিল যদি না টেকে তাহলে যে কোনো সময় কুর্দ পরিবারকে বাস্তচ্যুত হতে হবে।

কিন্তু যে জায়গা-বাড়ি তাদের পূর্বপুরুষ হাইফাতে ফেলে এসেছিলেন তা ফেরত পাওয়ার কোনো সুযোগ তাদের নেই।

সূত্র : বিবিসি বাংলা

Share this post

scroll to top