রোহিঙ্গা সঙ্কট : মিয়ানমারের বিরোধী দলগুলো হঠাৎ কেন রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি দিল

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তরফ থেকে অনেক চাপ সত্ত্বেও মিয়ানমারের যে রাজনীতিকরা রোহিঙ্গাদের অধিকারের বিন্দুমাত্র স্বীকৃতি দিতে রাজী হয়নি, হঠাৎ করে তাদের অবস্থানে নাটকীয় পরিবর্তন বেশ বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে।

সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো অং সান সুচির দল এনএলডিসহ বিরোধী দলগুলোর একটি জাতীয় মোর্চা থেকে গত বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে এই নাটকীয় ঘোষণাটি দেয়া হয়। এতে রোহিঙ্গাদের অধিকারের স্বীকৃতি শুধু নয়, ১৯৮২ সালের যে নাগরিকত্ব আইনের বলে তাদের অধিকার হরণ করা হয়, সেটি বিলোপের অঙ্গীকারও রয়েছে।

গণতন্ত্রের দাবিতে রক্তাক্ত সংগ্রামে লিপ্ত মিয়ানমারের বিরোধী দলগুলো এখন গড়ে তুলেছে একটি সমান্তরাল সরকার, যেটি ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট বা এনইউজি নামে পরিচিত। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে স্বীকৃতি লাভের জন্য এই এনইউজি এখন সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে।

রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে ঘোষণাটি দেয়া হয়েছে এই এনইউজির তরফ থেকে। ঘোষণাটিকে বেশ ইতিবাচক একটি পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। রোহিঙ্গাদের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার বিভিন্ন সংগঠনও এটিকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে তাদের অবস্থান কতটা আন্তরিক অথবা রোহিঙ্গাদের অধিকারের পূর্ণাঙ্গ স্বীকৃতি এই ঘোষণায় আছে কিনা তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে।

এনইউজি’র ঘোষণায় কী আছে
গত ৩ জুন এনইউজি রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে যে নীতি ঘোষণা করেছে, তাতে বেশ কয়েকটি অঙ্গীকার করেছে তারা।

প্রথমত, এতে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হাতে রোহিঙ্গারা যে হত্যা-নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছে, তার স্বীকৃতির পাশাপাশি যারা এর জন্য দায়ী, তাদের বিচারের কথা বলা হয়েছে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধের বিচারের এখতিয়ার দেয়ার প্রক্রিয়া শুরুর অঙ্গীকার করা হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, এতে ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন/বিলোপের অঙ্গীকার করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব হরণের ক্ষেত্রে এই আইনটিকে ব্যবহার করে মিয়ানমারের সামরিক কর্তৃপক্ষ।

তৃতীয়ত, এই ঘোষণায় মিয়ানমার থেকে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে আনার জন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে করা চুক্তি মেনে চলার অঙ্গীকার আছে।

২০১৭ সালে সর্বশেষ রোহিঙ্গা শরণার্থী সঙ্কট শুরু হওয়ার পর এতটা খোলাখুলি মিয়ানমারের রাজনীতিকদের এভাবে রোহিঙ্গাদের অধিকারের পক্ষে কথা বলতে দেখা যায়নি।

এই ঘোষণার গুরুত্ব কতটা?
‘এটি আসলে মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্যের সরকারের তরফ হতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘রোহিঙ্গা’ পরিচয়ের স্বীকৃতি,’ বলছেন মিয়ানমার বিষয়ক বিশ্লেষক ল্যারি জ্যাগান।

বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, এই ঘোষণার মাধ্যমে এনইউজি স্পষ্টতই মিয়ানমারের সামরিক সরকারের চাইতে একটা পরিষ্কার ভিন্ন অবস্থান নিতে চেয়েছে। কারণ সামরিক বাহিনী এখনো পর্যন্ত বলে যাচ্ছে ‘রোহিঙ্গা’ বলে কিছু নেই।

তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী দলগুলোর অবস্থানে যে একটা পরিবর্তন ঘটেছে এটা তারই ইঙ্গিত। কারণ আমরা দেখেছি অং সান সুচি এবং তার দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি এর আগে ‘রোহিঙ্গা’ কথাটির উল্লেখ পর্যন্ত এড়িয়ে গেছে, তারা এদেরকে ‘আরাকানি মুসলিম’ বলে বর্ণনা করতো।

ল্যারি জ্যাগানের মতে, এই ঘোষণার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক দুটি। প্রথমত, ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন বিলোপের অঙ্গীকার। কারণ এই আইনটাই অনেক সমস্যার মূলে।

আর দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগের স্বীকৃতি এবং তাদের ফিরিয়ে আনার অঙ্গীকার।

এনইউজি’র এই ঘোষণা মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে সক্রিয় গ্রুপগুলোর মধ্যেও আশাবাদ তৈরি করেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনও একে স্বাগত জানিয়েছে।

কিন্তু একটি বিদ্রোহী সরকারের স্বীকৃতির মূল্য কী?
মিয়ানমারের প্রায় সব প্রধান বিরোধী দলগুলোর রাজনীতিকদের নিয়ে এনইউজি গঠিত হয় গত ১৬ এপ্রিল। ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা হারানো এনএলডির নির্বাচিত পার্লামেন্টারিয়ানরা আছেন এই সরকারে। আছেন আরো বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধি এবং দলের রাজনীতিকরা।

ল্যারি জ্যাগানের মতে, এনইউজি যে মিয়ানমারের মূলধারার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতিনিধিত্ব করছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেদিক থেকে এই স্বীকৃতির একটা মূল্য অবশ্যই আছে।

‘এনইউজি তাদের মোর্চাটা অনেক বড় এবং ব্যাপক রাখতে চায়। এখানে অন্য দলগুলোকেও রাখা হয়েছে। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব আছে, সিভিল সোসাইটির সঙ্গে আছে। এটি মিয়ানমারের মূল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতিনিধিত্ব করে, কিন্তু এটি যতটা প্রতিনিধিত্বমূলক হওয়া উচিৎ, ততটা নয়। যেমন রোহিঙ্গাদের কাউকে রাখা হয়নি এই সরকারে।’

কিন্তু হঠাৎ কেন মিয়ানমারের রাজনীতিকদের অবস্থানে এই পরিবর্তন
মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্যের সরকার এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে স্বীকৃতির জন্য ব্যাপক চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু রোহিঙ্গা প্রশ্নে তাদের অবস্থান পরিষ্কার না করে সেটা পাওয়া কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে শুরু থেকেই সংশয় ছিল।

গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের ফরেন এফেয়ার্স কমিটির এক শুনানিতে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সেই শুনানিতে এনইউজির এক দূতকে কংগ্রেসম্যান ব্রাড শেরম্যান প্রশ্ন করেছিলেন, রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে তাদের অবস্থান কী, যার কোন সদুত্তর দিতে তিনি ব্যর্থ হন।

এনইউজি যে রোহিঙ্গা প্রশ্ন তাদের অবস্থান বদলেছে, আন্তর্জাতিক চাপ সেখানে বড় ভূমিকা রাখছে বলে অনেকে মনে করছেন।

ল্যারি জ্যাগান বলেন, ‘তারা নিজেরা যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে স্বীকৃতি চায়, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে স্বীকৃতি পেতে হলে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে অবস্থান বদল করতে হবে। নইলে তারা সহানুভূতি পাবে না।’

তবে ল্যারি জ্যাগান বলেন, শুধু আন্তর্জাতিক চাপ নয়, সামরিক অভ্যুত্থানের পর রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মিয়ানমারের রাজনীতিকদের চিন্তা-ভাবনায়ও একটা নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে।

‘সামরিক অভ্যুত্থান জনগণকে এটা উপলব্ধি করতে বাধ্য করেছে যে, সামরিক বাহিনীর নিপীড়ন যেটা রাখাইনে ঘটেছিল, সেটাই এখন অন্য সব জায়গায় ঘটছে। কাজেই দৃষ্টিভঙ্গিতে একটা মৌলিক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। আমার মতে এটা একটা আন্তরিক পরিবর্তন।

ল্যারি জ্যাগানের মতে আরেকটি বিষয়ও এখানে কাজ করছে, সেটি হচ্ছে, মিয়ানমারের জেনারেলদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি করা।

‘এনইউজি চায়, সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে যে মামলা, তাতে সাহায্য করতে, যাতে মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর সংগঠিত অপরাধের বিচার করা যায়। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে তারা নিজেদের নীতি পরিবর্তন না করে তো এটা করতে পারবে না। সেজন্যেই হয়তো তারা অবস্থান পরিবর্তন করেছে।’

মিয়ানমারের রাজনীতিকরা এবার যে তাদের অঙ্গীকার রক্ষা করবেন সে ভরসা কোথায়?

বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশনের প্রেসিডেন্ট টুন খিন অতটা নৈরাশ্যবাদী হতে চান না। আগের তুলনায় এবার তারা অনেক বেশি ইতিবাচক, এটাই আমি বিশ্বাস করতে চাই। এর আগেরবার আমরা কেবল অং সান সুচির ওপর ভরসা করেছিলাম। কিন্তু এবার আমরা একটা পুরো জাতীয় ঐক্যের সরকারের ওপর এই আস্থা রাখছি। বার্মার মানুষের মধ্যে রোহিঙ্গা ইস্যুতে কিছু সমর্থন এবং সহানুভূতি আমরা দেখছি। কাজেই আমি আশাবাদী।
সূত্র : বিবিসি

Share this post

scroll to top