ময়মনসিংহে বাড়ছে বজ্রপাত : বাড়ছে মৃত্যু

Thunderময়মনসিংহে চলতি মৌসুমে মাত্রারিক্ত বজ্রপাতের ঘটনা ঘটেছে। সেই সাথে বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই এমন বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমন ঘটনায় গত কয়েক দশকে বড় বড় গাছ কেটে ফেলাকে দায়ী বিশেষজ্ঞরা।

বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি ঠেকানোর লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ময়মনসিংহে পরীক্ষামূলকভাবে বজ্রপাত চিহ্নিতকরণ যন্ত্র বা লাইটনিং ডিটেকটিভ সেন্সর বসিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।  যুক্তরাষ্ট্র থেকে ডিটেকটিভ সেন্সরের যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। কিন্তু এর আদৌ কোন ফল পাচ্ছেনা ময়মনসিংহবাসী।

ময়মনসিংহ লাইভ এর কাছে তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, চলতি বছরের ২২ এপ্রিল বুধবার সকালে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার কুতিকুড়া ও দুপুরে কড়ইতলী গ্রামে বজ্রপাতে হান্নান (৪৫) ও আবুল কাশেম (৫০) নামে দুই জন কৃষক মারা গেছেন। ২ মে রোববার দুপুর ২টার দিকে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার বালিয়ান ইউনিয়নের সারুটিয়া গ্রামে ধান কাটার সময় বজ্রপাতে চাঁন মিয়া (২৬) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। ২ মে রোববার ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে ধানকাটার সময় বজ্রপাতে নজরুল হক (৬০) নামের এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। ৮ এপ্রিল বৃহস্পতিবার ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট পৌর শহরের আকনপাড়া গ্রামের মৃত হাজারী শেখ এর পুত্র নুর ইসলাম (৫০) নামে এক কৃষক বজ্রপাতে নিহত হয়েছে। ১৮ মে মঙ্গলবার ময়মনসিংহের তারাকান্দার রামপুর ইউনিয়নের খলিশাজান গ্রামের আজমত আলীর ছেলে আতিকুল ইসলাম ফুটবল খেলার সময় মাঠে বজ্রপাতে মারা যায়।

ময়মনসিংহে সাধারণ জনগণকে বজ্রপাত থেকে বেঁচে থাকার বা করণীয় সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি না করায় আগের তুলনায় বর্তমানে মানুষ আরও অসচেতন হচ্ছে। এই ঘটনা শুধু ময়মনসিংহের ক্ষেত্রেই না, সারা দেশেই একই অবস্থা বিরাজমান।

বজ্রপাত নিয়ে গবেষণা করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এ ফারুখ বলেছেন, ”বাংলাদেশে বজ্রপাতের মূল কারণ দেশটির ভৌগলিক অবস্থান। বাংলাদেশের একদিকে বঙ্গোপসাগর, এরপরই ভারত মহাসাগর। সেখান থেকে গরম আর আর্দ্র বাতাস আসছে। আবার উত্তরে রয়েছে পাহাড়ি এলাকা, কিছু দূরেই হিমালয় রয়েছে, যেখান থেকে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছে। এই দুইটা বাতাসের সংমিশ্রণ বজ্রপাতের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে”।

তিনি বলেন, ”শীতের পর বঙ্গোপসাগর থেকে উষ্ণ বাতাস আসতে শুরু করে, অন্যদিকে হিমালয় থেকে আসে ঠাণ্ডা বাতাস। দক্ষিণের গরম আর উত্তরের ঠাণ্ডা বাতাসে অস্থিতিশীল বাতাস তৈরি হয় আর এর থেকে তৈরি হয় বজ্র মেঘের। এরকম একটি মেঘের সঙ্গে আরেকটি মেঘের ঘর্ষণে বজ্রের তৈরি হয়। এরকম উচ্চ ভোল্টের বৈদ্যুতিক তরঙ্গ যখন মাটিতে নেমে আসে, তখন সবচেয়ে কাছে যা পায়, তাতেই আঘাত করে।”

এদিকে উন্নত দেশগুলোতে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যু কমলেও বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এ সংখ্যা বাড়ছে। বজ্রপাতে মৃত্যুর বিষয়টিকে এখন অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতোই বিবেচনা করছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর।

সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরাম বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়ার ধরন পরিবর্তন, লম্বা গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া, আকাশে কালো মেঘের পরিমাণ ও মেঘে মেঘে ঘর্ষণের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া এবং বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণেই অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে বজ্রপাত। তাপমাত্রা যত বাড়বে বজ্রপাতও তত বাড়বে।

তাপমাত্রা গড়ে এক ডিগ্রি বেড়ে গেলে বজ্রপাত ১০ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি বজ্রপাত বেড়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সম্প্রতি মেঘে মেঘে ঘর্ষণের ফলে বা ঘন কালো মেঘের ওপরের ও নিচের অংশ দুটি পুল হিসেবে প্রবাহিত হয়। এই কারণে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়ে বজ্রপাতের সৃষ্টি হয়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কালো মেঘের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ায় হঠাৎ বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে বজ্রপাতের পরিমাণ। বিদ্যুৎপ্রবাহ মানুষের শরীর দিয়ে প্রবাহিত হয় অনেকটা ইলেকট্রিক শকের মতো। বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলে মানুষ যেভাবে দ্রুত শকড হয়, ঠিক একইভাবে বজ্রপাতেও মানুষ শকড হয়ে মারা যায়। কারণ মানুষের শরীর বিদ্যুৎ পরিবাহী। এ কারণে মানুষের ওপর বজ্রপাত হয়। যদি কোনো খোলা স্থানে বজ্রপাত হওয়ার মতো কোনো বিদ্যুৎ পরিবাহী পদার্থ না থাকে আর সেখানে যদি মানুষ থাকে যার উচ্চতা অন্য বিদ্যুৎ পরিবাহীর চেয়ে বেশি তাহলে মানুষের ওপর বজ্রপাত হয়।

সংগঠনটি বলছে, সরাসরি মাটিতে সাধারণত বজ্রপাত হয় না। বজ্র বিদ্যুৎ পরিবাহীর ওপর পড়ে। এরপর ওই পরিবাহির মাধ্যমে বজ্রের বিদ্যুৎ মাটির সঙ্গে মিশে যায়। উঁচু গাছ, ভবন, পাহাড়ের শীর্ষে সাধারণত বজ্রপাত হয়। বাসাবাড়িতে লাগানো বজ্রপাত নিরোধক দণ্ডের ওপরও বজ্রপাত হয়।

তবে বজ্রপাত নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি করতে পারলে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কেমে যাবেও বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

Share this post

scroll to top