যেভাবে উদ্ধার হলো ২ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া শিশু সজীব

ফারুক হোসেন। বয়স ৪০-এর কাছাকাছি। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানাধীন বেগুনবাড়ি এলাকায় বসবাস। স্ত্রী ও দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে ছোট্ট সংসার। টিনশেডের দুই রুমের ভাড়া বাসা। বাসার সামনে ছোট্ট একটু ফাঁকা জায়গা। সেখানে পুরাতন লোহা-লক্কড়, প্লাস্টিকের ভাঙ্গা ও পরিত্যাক্ত জিনিসের স্তূপ। পুরাতন লোহা-লক্কড়, প্লাস্টিকের ভাঙ্গা ও পরিত্যক্ত জিনিস সংগ্রহ এবং বিক্রি করেই চলে তার সংসার।

দুই ছেলে-মেয়ের মধ্যে সজীব বড়। বয়সের তুলনায় তার মানসিক গ্রোথ কম। তার সমবয়সী অন্য ছেলে-মেয়েদের তুলনায় কোনোকিছু বুঝতে বা আত্মস্থ করতে তার অনেক বেশি সময় লাগে। কোনো কিছু মনে রাখতে পারে না। তবু ফারুক হোসেনের খুব ইচ্ছা ছেলে পড়াশুনা করবে। মানুষের মতো মানুষ হয়ে দূর করবে সংসারের অনটন। হাসি ফুটাবে মা-বাবার মুখে।

২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৯ তারিখ। বিকেল আনুমানিক সাড়ে চারটার দিকে সজীবকে মশার কয়েল কিনে আনতে দোকানে পাঠায় তার বাবা। বাসা থেকে মিনিট দূরত্বে ৭-৮ টি দোকান। প্রায় আধা ঘন্টা পার হয়ে গেলেও সজীবের কোনো খবর নেই। তার বাবা ছুটে যায় আশেপাশের দোকানগুলোতে। দোকানদাররা কেউ সজীবকে দোকানে আসতে দেখেনি বলে জানায়। হতবিহ্বল হয়ে ফারুক হোসেন চষে বেড়ায় পুরো বেগুনবাড়ি এলাকা। কিন্তু কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না সজীবকে।

ফারুক ও তার স্ত্রীর আত্মচিৎকারে জড়ো হলো বেশ কিছু লোক। তন্নতন্ন করে খোঁজা হলো বাসার চারপাশ। বাসা পেরিয়ে আশেপাশের দোকান, রাস্তাঘাট, খেলার মাঠ, পরিচিতদের বাড়িঘর। খবর শুনে ছুটে এলো ফারুকের বন্ধু-বান্ধব ও আশেপাশে অবস্থানরত আত্মীয়-স্বজন। আলাদা-আলাদাভাবে খোঁজা হলো পুরো এলাকা। হাতিরঝিল, কুনিপাড়া, নাখালপাড়া, সাতরাস্তা, মহাখালী, রেলওয়ে স্টেশন, মধুবাগ, বিজয় স্মরণী ও তেজগাঁও এলাকা। আত্মীয়-স্বজনরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়ে চলে গেল ডিএমপির সব থানায়, হাসপাতালে ও ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলার থানাগুলোতে। সজীবের কোনো সন্ধান নেই।

রাতেই তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন তার বাবা। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার এসআই তৌহিদ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সকল থানা, হাসপাতাল ও ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলার থানাগুলোতে তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়ায় সজীবকে। মাইকিং করা হলো। সজীবের ছবি সংবলিত ‘নিঁখোজ সংবাদ’ পোস্টার ছাপিয়ে তাতে এসআই তৌহিদের মোবাইল নম্বর দিয়ে লাগিয়ে দেয়া হলো তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, হাতিরঝিল, তেজগাঁও এলাকার প্রতিটি অলি-গলিতে। পোস্টার লাগানো হলো বাসস্ট্যান্ড, রেলওয়ে স্টেশন, মসজিদ, মন্দিরের দেয়ালে। ঢাকা শহরের অভ্যন্তরীণ রুট, দূরপাল্লার বাস ও ট্রেনে। সজীবের কোনো সন্ধান নেই। সজীবের মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন এবং তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা পুলিশের দিগ্বিদিক ছুটোছুটিতেও কাজ হলো না।

সপ্তাহ গেল, মাস গেল, পেরিয়ে গেল বছর। ছেলেকে হারিয়ে কাঁদতে-কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে গেছে মা-বাবার। হতাশ আত্মীয়-স্বজনরাও হাঁপিয়ে উঠল। সিনিয়র পুলিশ অফিসারদের কাছে সজীবকে খুঁজে না পাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে-করতে হাঁপিয়ে উঠল এসআই তৌহিদ। একপর্যায়ে নিঁখোজ সজীবকে প্রায় ভুলেই গেল সবাই। শুধু ভুলতে পারলো না পুলিশ। প্রাত্যহিক কাজের মধ্যেই পত্র-পত্রিকা, ফেসবুকে নিয়মিত সজীবকে খুঁজে ফেরে এসআই তৌহিদ। প্রতীক্ষায় থাকে একটা ফোন কলের।

৮ নভেম্বর, ২০১৮। তেজগাঁও বিভাগের এডিসি হাফিজ আল ফারুক, এসি সালমান হাসান ও আরো কয়েকজন তদন্তাধীন মামলার অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করছিলেন। আলোচনার ফাঁকে এসি সালমান হাসানের চোখ আটকে যায় একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে। রেললাইনের প্ল্যাটফর্মের পাশে ভিক্ষার থালা হাতে বসে আছে এমন একজনের অস্পষ্ট ছবি পোস্ট করে Kashem Mia নামের একজন স্ট্যাটাস দিয়েছে, ‘ছেলেটার বাপ মা কই আল্লাহ জানে। খুব কষ্টে আছে সে’। সজীবের মা-বাবাকে ডেকে আনলো এসআই তৌহিদ। রেললাইনের প্ল্যাটফর্মের পাশে ভিক্ষার থালা নিয়ে বসে থাকা যে ছেলেটির ছবি ফেসবুকে পোস্ট করা হয়েছে, তাকে সজীব বলে সনাক্ত করলেন তার বাবা-মা।

Kashem Mia নামের ফেসবুক স্ট্যাটাস দেয়া সেই ব্যক্তির সাথে ফেসবুকে যোগাযোগ করলেন এসি সালমান হাসান। সজীবের ছবি তুলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়া হয়েছিল সেটা কোন জায়গা ছিল জানতে চাওয়া হলো তার কাছে। Kashem Mia প্রথমে স্বীকারই করলেন না যে এমন কোনো স্ট্যাটাস তিনি দিয়েছেন। পরে সেই স্ট্যাটাস ডিলিট করলেন। পুলিশ পরিচয়ে কথা বলার পর ডিএকটিভ করলেন ফেসবুক আইডি। প্রায় দু’বছর পর ছেলেকে ফিরে পাওয়ার যে স্বপ্ন দেখছিল তার মা-বাবা, নিমিষেই ভেঙ্গে গেল।

Kashem Mia’র ফেসবুক আইডি থেকে তার ফ্রেন্ডলিস্টে থাকা ফেসবুক ফ্রেন্ডদের কাছে তার ফেসবুক আইডিতে দেয়া ছবি, ডিটেইলস পাঠিয়ে জানতে চাওয়া হলো তার পরিচয়। কেউ তেমন কিছু বলতে পারল না।

রেললাইনের প্ল্যাটফর্মের পাশে ভিক্ষার থালা নিয়ে বসে আছে সজীব- Kashem Mia’র পোস্ট করা এই ছবি নিয়ে এসি সালমান হাসান এসআই তৌহিদকে পাঠালেন কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন মাস্টারের কাছে। ছবি দেখে স্টেশন মাস্টার জানালেন, ‘এটি জামালপুর রেলওয়ে স্টেশনের ছবি’।

তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার বিপিএম, পিপিএম নির্দেশে এসআই তৌহিদ ও এসআই নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার একটি টিম পাঠানো হলো জামালপুর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায়।

দু’দিন ধরে তন্নতন্ন করে খোঁজা হলো পুরো রেলওয়ে স্টেশন ও আশেপাশের এলাকা। দোকানদার, কুলি ও ভিক্ষুকদের দেখানো হলো সজীবের ছবি। কেউ কোন তথ্য দিতে পারল না।

প্রধান সড়কের পাশে রেলগেট এলাকার প্রায় ষাট বছর বয়সী এক মহিলা ভিক্ষুক সজীবের ছবি দেখে জানালেন, ‘এই পোলাডা সারাদিন চিক্কুর দিয়া কানতো। মাসখানেক আগে কাগজ কুঁড়ানি এক দাঁড়িওয়ালা বুইড়া ব্যাটার লগে গ্যাছে’।

বৃদ্ধা ভিক্ষুককে নিয়ে রেলওয়ে স্টেশন ও তার আশেপাশের এলাকায় কাগজ কুঁড়ায় ও বিক্রি করে এমন ছেলে-মেয়ে ও লোকজনদের খোঁজ করা হল। ৩-৪ জন বৃদ্ধা ভিক্ষুকের বক্তব্যকে সমর্থন করল সজীবকে মাসখানেক আগে দাঁড়িওয়ালা কাগজ কুঁড়ায় এমন এক বৃদ্ধের সাথে দেখা গেছে।

রাসেল নামের ১০-১১ বছর বয়সী একজন এসআই তৌহিদ ও এসআই নজরুলকে জামালপুর শহরের সরকারি জাহেদা শফির মহিলা কলেজ গেট এলাকায় পুরাতন কাগজ ক্রেতা সালাম মোল্লার কাছে নিয়ে গেল। সালাম মোল্লা সজীবের ছবি দেখে চিনতে পারে। সালাম মোল্লা জানায়, কাগজ আলী নামের একজন কুঁড়ানো ও পুরাতন কাগজপত্র বিক্রি করে তার দোকানে। মাসখানেক আগে সজীবও তার সাথে আসত। বেশ কিছুদিন থেকে কাগজ আলীকে আর দেখা যাচ্ছে না এলাকায়। কাগজ আলী মূলত রেলওয়ে স্টেশনে যারা কাগজ কুঁড়ায়, তাদের কাছ থেকে কুঁড়ানো কাগজপত্র কিনে সালাম মোল্লার দোকানে বিক্রি করত।

সালাম মোল্লা অনেক কাগজপত্র ঘেঁটে কাগজ আলীর মোবাইল নম্বর দেয় এসআই তৌহিদকে। তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় কাগজ আলীর ব্যবহৃত মোবাইলের অবস্থান পাওয়া যায় গাজীপুরের এরশাদনগর বস্তি এলাকায়।

তাৎক্ষণিকভাবে এসআই তৌহিদ ও এসআই নজরুল তাদের টিম নিয়ে চলে যায় গাজীপুর এরশাদনগর বস্তি এলাকায়। এসআই নজরুল নিজেকে পুরাতন কাগজ ক্রেতা হিসেবে পরিচয় দিয়ে মোবাইল ফোনে কথা বলে কাগজ আলীর সাথে।

কাগজ আলী এখন আর পুরাতন কাগজ কেনাবেচার কাজ করে না জানালেও বেশি দামে কাগজ বিক্রির অফার পেয়ে দেখা করে এসআই নজরুল ও তৌহিদের সাথে। গাজীপুরের এরশাদনগর বস্তিতে কাগজ আলীর ভাড়া করা কক্ষে ঘুমন্ত অবস্থায় পাওয়া যায় সজীবকে। যে সজীব প্রায় দুই বছর আগে মশার কয়েল কিনতে বাসা থেকে বের হয়ে নিঁখোজ হয়েছিল।

কাগজ আলীর বয়স ষাটের কাছাকাছি। স্ত্রীর মৃত্যুর পর একমাত্র ছেলেকে নিয়ে বাঁচার জন্য বিয়ে করেনি আর। ১০ বছর বয়সী ছেলের মৃত্যু হয় ট্রেনে কাটা পড়ে। এরপর কাগজ কুঁড়িয়েই পার করতে চেয়েছিল বাকি জীবন।

জামালপুর রেলওয়ে স্টেশনে ভিক্ষার থালা হাতে কাঁদতে থাকা সজীবকে দেখে পিতৃস্নেহ জাগ্রত হয় কাগজ আলীর। একপর্যায়ে সজীবকে নিয়ে পালিয়ে আসে গাজীপুরে পিতৃস্নেহে তাকে বড় করার জন্য।

মশার কয়েল কেনার জন্য বাসা থেকে বের হওয়ার পর কেউ একজন সজীবকে কম দামে বেশি কয়েল দেওয়ার কথা বলে অন্যদিকে নিয়ে যায়। আর কিছু বলতে পারে না সে।

সজীবকে জামালপুরসহ বিভিন্ন স্পটে ভিক্ষার থালা হাতে বসিয়ে দেয়া হত। সমবয়সী ছেলে-মেয়েদের তুলনায় মানসিক গ্রোথ তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় বাবা-মার নাম ছাড়া অন্যকিছু বলতে পারত না সজীব।

সূত্র : ডিএমপি নিউজ

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top