করোনার উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ জেলাগুলোর মধ্যে স্থান পেয়েছে ময়মনসিংহ। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী জেলা হওয়ায় সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা লক্ষণীয়। পাশাপাশি নেত্রকোনা জেলাও করোনার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। ময়মনসিংহসহ উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ৩৭ জেলাতে দুই সপ্তাহের ব্যবধানে দেশের সংক্রমণের হার ৬ থেকে ১০ শতাংশে উঠে এসেছে।
বর্তমানে উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে করোনা সংক্রমণের হার ৬৩ শতাংশ এবং পার্শ্ববর্তী জেলা রাজশাহীতে এই হার ৪১ শতাংশে উঠেছে। অর্থাৎ এই জেলাগুলোতে ভাইরাসের সংক্রমণশীলতা অত্যধিক।
দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দেশের ৩৭টি জেলাকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করেছে। এমন পরিস্থিতি আশংকাজনক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ৪০ শতাংশের ওপরে সংক্রমণ রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও খুলনায়। ২০ থেকে ২৯ শতাংশ সংক্রমণ রয়েছে সিলেট, ঝালকাঠি, রাজশাহী, নাটোর ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা এবং ফরিদপুরে।
এছাড়া ১০ থেকে ১৯ শতাংশ সংক্রমণের হার রয়েছে দিনাজপুর, সিরাজগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ফেনী, রংপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, বরিশাল, সাতক্ষীরা, গাজীপুর বগুড়া, গোপালগঞ্জ, যশোর, মাদারীপুর চট্টগ্রাম, রাজবাড়ী, মাগুরা, নওগাঁ, কক্সবাজার, ভোলা, নড়াইল, লক্ষ্মীপুর, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, কুষ্টিয়া, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া, নেত্রকোনা এবং টাঙ্গাইল। গত ১৮ মে এই জেলাগুলোকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) এবং করোনা সংক্রান্ত মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে জেলা পর্যায়ে সংক্রমণের হার বাড়তে শুরু করেছে।
বিশেষ করে সীমান্তবর্তী জেলাগুলো এই হার কিছুটা বেশি। এক্ষেত্রে দেশবাসীকে একটু ধৈর্য ধরে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
অন্যথায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়বে। তিনি বলেন, একটু উদাসীন হলে মাত্র ৭ থেকে ১০ দিনেই দেশের সামগ্রিক করোনা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটতে পারে।
তাই সংক্রমণের উর্ধ্বমূখী প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ সবাইকে মেনে চলার অনুরোধ জানান তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে বিভাগীয় পর্যায়ে দেখা যায়, ঢাকায় এ পর্যন্ত আক্রান্ত ৪,০১,৩২৪ এবং সংক্রমণের হার ১৭ শতাংশ। খুলনায় আক্রান্ত ৩৫৮৬৬ এবং সংক্রমণের হার ১৫ শতাংশ, রংপুরে আক্রান্ত ২০,১৬৫ এবং সংক্রমণের হার ১৫ শতাংশ, বরিশালে আক্রান্ত ১৭,৬৭৬ এবং সংক্রমণের হার ১৩ শতাংশ, রাজশাহীতে আক্রান্ত ৪১,৩৩৬ এবং সংক্রমণের হার ১১ শতাংশ, ময়মনসিংহে আক্রান্ত ১২৬৭৮ এবং সংক্রমণের হার ১০ শতাংশ, সিলেটে আক্রান্ত ২২,৫৮৬ এবং সংক্রমণের হার ৯ শতাংশ।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আহমদ পারভেজ জাবীন বলেন, সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর সংক্রমণের হার বাড়ছে। অর্থাৎ বর্তমানে একজন থেকে আরেক জনে সংক্রমিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে সীমান্তে আসা-যাওয়া বন্ধ করতে হবে।
যতক্ষণ পর্যন্ত সংক্রমণের হার ৫-এর নিচে না নামে ততক্ষণ পর্যন্ত এটা বন্ধ থাকবে। এই মুহূর্তে স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত বিজ্ঞানসম্মত নয়। এক্ষেত্রেও সংক্রমণের হার ৫-এর নিচে নামা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের ১৮ দফা স্বাস্থ্যবিধি দেশের সবাইকে জানাতে ব্যাপক হারে প্রচার চালাতে হবে। রাজশাহী ও চাঁপাই থেকে যে ৪০টি নমুনা আনা হয়েছে সেগুলোর জিনোম সিকুয়েন্সিং করে দেখাতে হবে দেশে ইন্ডিয়ার ভ্যারিয়েন্টের পরিস্থিতি কি।
সংক্রমণের দিকে থেকে সর্বোচ্চ দশটি জেলার চিত্রে দেখা যায়, ঢাকায় এ পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছে ৩,২৭,৭৮৮, চট্টগ্রামে ৪৭,৫২৮, নারায়ণগঞ্জে ১৪,৭৭৪, কুমিল্লায় ১৪,৭৭৪, বগুড়ায় ১৪,২১৯, সিলেটে ১৩,১৩৭, গাজীপুরে ১১,৯৯০, কক্সবাজারে ১০,৮৪০, ফরিদপুরে ১০,৭৩৮ এবং খুলনায় ১০,৪৯৮ জন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান বলেন, জেলাগুলোতে পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে চূড়ান্ত কর্মসূচি এলাকাভিত্তিক লকডাউন করা।
ইতোমধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জে এটা করা হয়েছে। প্রয়োজনে অন্যান্য ঊধ্বমুখী সংক্রমণপ্রবণ জেলাগুলোতে এই ব্যবস্থা নিতে হবে।
তবে অবশ্যই লকডাউন এলাকায় খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবা সরকারিভাবে নিশ্চিত করতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে এসব এলাকা থেকে কেউ যেন অন্য শহরে যেতে না পারে। তাহলে সংক্রমণের হার কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সারা দেশের সংক্রমণশীলতার ওপর ভিত্তি করে জেলাগুলোকে ৬ ভাগে ভাগ করেছে। যেখানে সর্র্বোচ্চ ২০ হাজারের উপরে আক্রান্ত রোগী রয়েছে মাত্র দুটি জেলায়। এর মধ্যে ঢাকায় এ পর্যন্ত আক্রান্ত ৩,২৬,৩৩৩ এবং চট্টগ্রামে ৪৬,৬১৬ জন।
যেসব জেলায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১০ থেকে ২০ হাজারের মধ্যে সেগুলো হলো-সিলেটে ১২,৬৯৪, বগুড়ায় ১৪,০৭৩, কুমিল্লায় ১৪,৫৭৪, নারায়ণগঞ্জে ১৪,৬৪৪, ফরিদপুরে ১০,৬১৫, খুলনায় ১০,১৩৯, কক্সবাজারে ১০,১৩৯ জন। যেসব জেলায় এ পর্যন্ত আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৫ থেকে ১০ হাজারের মধ্যে সেগুলো হলো-দিনাজপুরে ৫,৯৭৭, রংপুরে ৫,৩১১, রাজশাহীতে ৯,১৬৬, কুষ্টিয়ায় ৫,৪৫৪, পাবনায় ৫,২৯৫, টাঙ্গাইলে ৫,৮৬২, ময়মনসিংহে ৭,৬০৫, কিশোরগঞ্জে ৫,১৩৬, ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় ৫,৩৮৬, যশোরে ৭,১৮৬, চাঁদপুরে ৬,০৫৯, বরিশালে ৮,১১৫ এবং নোয়াখালীতে ৯,০০৩ জন।
যেসব জেলায় এ পর্যন্ত আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২ থেকে ৫ হাজারের মধ্যে সেগুলো হলো-নওগাঁয় ২,৫০১, মেহেরপুরে ৩,৩২৬, রাজবাড়ী ৪,৭৪৬, ঝিনাইদহে ২,৬৫০, পটুয়াখালীতে ২,১৬২, ভোলায় ২,৩৯২, লক্ষ্মীপুরে ৩,৮৩২, ফেনীতে ৩,৯৪১, হবিগঞ্জে ২,৮৫০ এবং সুনামগঞ্জে ৩,১২৮ জন।
কিছু জেলায় আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ১,৫০০ থেকে ২ হাজারের মধ্যে রয়েছে। এগুলো হলো-ঠাকুরগাঁওয়ে ১,৬৮৪, নীলফামারীতে ১,৫৯১, গাইবান্ধায় ১,৯৮৬, জয়পুরহাটে ১,৬৫৯, নাটোর ১,৯০৫, চুয়াডাঙ্গায় ১,৬২৪, মাগুরায় ১,৫৬৩, নড়াইলে ১,৯৫৩, বাগেরহাটে ১,৭৬৩ এবং পিরোজপুরে ১,৭৫৪ জন। বাকি জেলাগুলোতে সংক্রমণের হার ও আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা আনেক কম।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ-স্বাচিপ সভাপতি অধ্যাপক ডা. এম ইকবাল আর্সলান বলেন, অধিক সংক্রমণশীল জেলাগুলোকে সিল করতে হবে। অন্য জেলা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করতে হবে।
ওইসব জেলায় স্বাস্থ্যবিধি সবাইকে বাধ্য করতে হবে। সংক্রমিত রোগীদের কন্ট্রাক ট্রেনিং করতে হবে। পাশপাশি এসব জেলায় অধিক হারে নমুনা পরীক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।