চলতি শুষ্ক মৌশুমে বাংলাদেশের তিস্তা অববাহিকার বিস্তৃর্ণ অঞ্চলে পানির তীব্র সঙ্কট চললেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেনের আসন্ন ভারত সফরে ইস্যুটি অগ্রাধিকারে নেই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব নেয়ার পর দিল্লিতে প্রথম সফরটিতে তিনি সৌহার্র্দ্য ও সম্প্রীতির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। নির্দিষ্ট কোনো ইস্যুর ওপর আলোকপাত করতে চান না ড. মোমেন।
আগামী ৭ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের যৌথ পরামর্শক কমিশনের (জেসিসি) পঞ্চম বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এতে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে নতুন দায়িত্ব পাওয়া ড. আব্দুল মোমেন। ভারতীয় প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে থাকবেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ।
জেসিসি বৈঠকে পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, কানেক্টিভিটি, নিরাপত্তা সহযোগিতা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানী এবং দুই দেশের জনগনের মধ্যে সম্পৃক্ততা বাড়ানোর উপায়সহ সার্বিক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পর্যালোচনার সুযোগ রয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার পর নিজ মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে প্রথম বিদেশ সফরে বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশী দেশ হিসাবে ভারত যাওয়ার কথা জানান। এরপর এই সফরে তিস্তা ইস্যু প্রাধান্য পাবে কিনা – এই প্রশ্নের জবাবে একাধিকার বলেছেন, নির্দিষ্ট কোনো ইস্যু নিয়ে তিনি ভারত যাচ্ছেন না। এ সফর হবে সৌহার্র্দ্য ও সম্প্রীতির।
ভারতের সিকিম রাজ্যে হিমালয় থেকে সৃষ্ট ৩১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা নদীটি পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। বাংলাদেশ অববাহিকার ১২৫ কিলোমিটার অঞ্চলের জীবনধারা এই নদীর ওপর নির্ভরশীল। শুষ্ক মৌশুমে প্রয়োজনীয় পানি না থাকায় বিশেষ করে রংপুর, লালমনিরহাট, গাইবান্ধাসহ বিস্তৃর্ণ এলাকার কৃষকরা বিপাকে রয়েছেন। এ সব এলাকার চাষাবাদ মূলত তিস্তার পানি প্রবাহের ওপর নির্ভরশীল। পানির অভাবে কৃষির পাশাপাশি পরিবেশও ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। নদীতে মাছের আকাল দেখা দিয়েছে। স্বাভাবিক গতিপ্রবাহে শুষ্ক মৌশুমে পাঁচ হাজার কিউসেক পানি থাকার কথা থাকলেও এখন পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৫০০ কিউসেক।
গজলডোবায় স্থপিত বাঁধের মাধ্যমে তিস্তার পানির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে ভারত। এই বাঁধের মাধ্যমে শুষ্ক মৌশুমে নদী থেকে পানি পশ্চিমবঙ্গের চাষাবাদযোগ্য এলাকায় প্রবাহিত করা হয়, অর্থাৎ প্রত্যাহার করা হয়। আর বর্ষা মৌশুমে বাঁধের গেইটগুলো খুলে পানি ছেড়ে দেয়া হয়।
ইতোপূর্বে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে থাকা ইস্যু তিস্তার পানি বন্টন চুক্তিটি ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির গ্যাঁড়াকলে পড়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যাণার্জির অনমনীয় মনোভাবের কারণে বছরের পর বছর ধরে অনিষ্পন্ন এই ইস্যুটি ঝুলে রয়েছে। এ কারণে তিস্তার ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশের বিস্তৃর্ণ অঞ্চলের মানুষকে খেসারত দিয়ে যেতে হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে এই দুর্ভোগ লাঘব হবে – এমন আশাও ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে।
সইয়ের জন্য চূড়ান্ত করা তিস্তার পানি বন্টনের ১৫ বছর মেয়াদি অন্তর্বর্তীকালিন চুক্তিতে ভারতের জন্য ৪২ দশমিক পাঁচ শতাংশ, বাংলাদেশের জন্য ৩৭ দশমিক পাঁচ শতাংশ এবং বাকী ২০ শতাংশ পানি নদীর স্বাভাবিক প্রবাহের জন্য রাখা হয়েছিল। ২০১১ সালে সেপ্টেম্বরে মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় এই চুক্তি সই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মমতা ব্যাণার্জি শেষ মুহুর্তে বেঁকে বসায় এই আয়োজন ভেস্তে যায়। পাল্টা হিসাবে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ভারতকে ব্যবহার করতে দেয়ার সম্মতিপত্র সই করা থেকে বিরত থাকে বাংলাদেশ।
ভারত তার ভূমিবেষ্ঠিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর জন্য বাংলাদেশের কাছ থেকে দীর্ঘদিন ধরে ট্রানজিট চেয়ে আসছে। তিস্তার পানি বন্টনে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য ট্রানজিটকে ট্রাম্প কার্ড হিসাবে হাতে রেখেছিল বাংলাদেশ। ভারত বারবার বাংলাদেশকে বোঝাতে চেষ্টা করছে দুই দেশের সম্পর্ক কেবলমাত্র একটি ইস্যুতে জিম্মি হয়ে থাকতে পারে না। প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক এখন অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে বলে দাবি করে ভারত ও বাংলাদেশ। এর এ জন্য তিস্তা ইস্যুতে নমনীয় হয়ে বাংলাদেশকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অন্যান্য দিক নিয়ে অগ্রসর হতে হচ্ছে। গত অক্টোবরে দিল্লিতে নৌ পরিবহন সচিব পর্যায়ে বৈঠকে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারে ভারতের সাথে চূড়ান্ত চুক্তি সইয়ের পর এর বিধি-বিধান (এসওপি) প্রণয়নের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে।
২০১৫ সালের জুনে নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকালে ভারতকে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের অনুমতি সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারকসহ (এমওইউ) রেকর্ড সংখ্যক চুক্তি সই হয়। ২০১৭ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি সফরে যান। এ সময় প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, ডিফেন্স লাইন অব ক্রেডিট এবং বিভিন্ন প্রতিরক্ষা প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের মধ্যে এমওইউসহ ২২টি চুক্তি সই হয়। সফরকালে নরেন্দ্র মোদির সাথে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালের জানুয়ারিতে দু’দেশের সম্মতি অনুযায়ী তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে একটি অন্তর্বতীকালীন চুক্তি করতে নয়াদিল্লির প্রতি অনুরোধ জানান। জবাবে মোদি বলেন, এ ব্যাপারে দ্রুত চুক্তি সম্পাদনে তার সরকার ভারতের সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে কাজ করছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের পর মমতার উপস্থিতিতে মোদি ঘোষণা দেন, দুই দেশের বর্তমান সরকারের ক্ষমতার মেয়াদেই তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি হবে। কিন্তু একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। ভারতের জাতীয় নির্বাচনও সামনে। কিন্তু তিস্তা চুক্তি হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ভারতের নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশও হয়ত এই ইস্যুতে দিল্লির ওপর নতুন করে চাপ সৃষ্টি করতে চাইছে না।