ভারতের রাস্তায় করোনায় মৃতদের লাশ ছিঁড়ে খাচ্ছে কুকুর

India Covid Dead body Roadমৃত্যুপুরী বললেও কিছুই বোঝানো যাচ্ছে না আর। বুধবারের দিল্লি নরককুণ্ড ছাড়া আর কিছুই নয়। এদিন সেখানে কোভিডে দৈনিক মৃতের সংখ্যা সাতশ’-তে পৌঁছেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, শিগগিরই এ সংখ্যা হাজার ছাড়াবে। ভারতের রাজধানী শহরের বিভিন্ন শ্মশানের বাইরে রাস্তায় টোকেন নিয়ে মরদেহের দীর্ঘ লাইন। ২০ ঘণ্টা কেটে যাচ্ছে আগুন পেতে। লাশ ছিঁড়ছে কুকুর। শ্মশানের দরজায় দরজায় ঘুরে জায়গা না পেয়ে স্রেফ বরফ চাপা দিয়ে ৪৮ ঘন্টাও বাড়িতে শব রেখে দিচ্ছে স্বজনেরা। কুকুরের মৃতদেহ পুঁতে ফেলার জায়গা ব্যবহার করা হচ্ছে মানুষকে দাহ করার জন্য।

এ যদি নরক না হয়, তা হলে নরক ঠিক কী? প্রশ্ন দিল্লিবাসীর। এরই মধ্যে অরুণ জেটলি স্টেডিয়ামে যথারীতি বসেছে আইপিএল-এর আসর। দর্শকশূন্য মাঠ হলে হবে কী! নিরাপত্তার ব্যবস্থা তো করা চাই! অতএব স্টেডিয়ামে দাঁড়িয়ে অ্যাম্বুলেন্স, কোভিড পরীক্ষার যাবতীয় সরঞ্জাম। ওদিকে শহরের মানুষ খাবি খাচ্ছেন, ওষুধের অভাবে, শয্যার অভাবে ধুঁকছেন। আইপিএল চলছে। কারা চালাচ্ছে? কার স্বার্থ রক্ষা করছে ভারতীয় ক্রিকেট? ক্ষোভে ফেটে পড়ছে নাগরিক সমাজ।

দিল্লির সুভাষনগর শ্মশানে টিনের চালের নিচে সারি সারি চিতা জ্বলছে। উড়ছে ছাই। এমনিতে নতুন নয় এই দৃশ্য। কিন্তু সেই ছাই উড়ে পড়ছে পাশের যে চাতালে? সেই চাতাল ধরেই এখন মৃতদেহের সর্পিল রেখা। এক ঝলক তাকালেই মাচার সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা অন্তত ১৫-২০টি দেহ চোখে পড়ছে। পাশের উঁচু বাঁধানো জায়গায় ঘি এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে বসে রয়েছেন স্বজনরা। এক, দুই ঘণ্টা নয়, ১৬ থেকে ২০ ঘণ্টাও বসে রয়েছেন কেউ কেউ। যে প্লাস্টিকের ব্যাগে মৃতদেহ মোড়া রয়েছে, তার ওপর নাম, নম্বর লেখা। হাতছাড়া হওয়ার ভয় নেই। তাই একটানা বসে না থেকে পোড়া দেহের গন্ধ এবং ধোঁয়া থেকে বেরিয়ে মাঝেমধ্যে বাইরে ঘুরে আসছেন অনেকে।

শুধু একটি শ্মশানের ছবি নয় এটা। দক্ষিণ দিল্লির বিকাশ নগরে সোমবার রাতে বছর ৩৫-এর এক কোভিড রোগিনীকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল দীনদয়াল হাসপাতালে। যথারীতি বেড না পেয়ে ফিরে এসে বাড়িতেই রাখা হয়। মাঝরাতে শ্বাসকষ্টে মারা যান তিনি। শেষ রাতে নিকটবর্তী রণহৌলা শ্মশানে নিয়ে গিয়ে দেখা যায়, গেট বন্ধ। কিন্তু বাইরে ছয়টি মৃতদেহের লাইন। জানা গেছে, তাদের টোকেন দেওয়া হয়েছে। কখন ডাক আসবে বলা যাচ্ছে না। বাড়ি ফিরে বরফবন্দি করে রাখা হয় মৃতকে। পরদিন সকাল ১০টায় উত্তমনগরের কালি বস্তি শ্মশানে গিয়ে শেষ পর্যন্ত দাহ করার সুযোগ পায় মৃতের স্বজনরা।

সোমবার বিকেলে ওই সুভাষনগরের শ্মশানটিতেই কোভিডে মৃত বাবার দেহ নিয়ে গিয়েছিলেন বছর ৪০-এর মনমীত সিংহ। সংবাদমাধ্যমে তিনি জানিয়েছেন, অ্যাম্বুলেন্স, গাড়ির ভিড় কাটিয়ে শ্মশানে ঢুকতে যাবেন, তার আগেই রাস্তা আটকালেন এক কর্মী। জানিয়ে দিলেন, আর দেহ নেওয়া যাবে না। কারণ দাহ করার জায়গা ও কাঠ নেই। আর সিএনজি চুল্লিতে একসঙ্গে দুইটির বেশি মরদেহ দাহ করা যায় না। তাতেও এক একটি দেহের পেছনে কমপক্ষে ৯০ মিনিট সময় লাগবে। ইতোমধ্যে লাইনে ২৪টি দেহ রয়েছে। তাই অন্য কোথাও যেতে হবে তাকে। এর পর পশ্চিম বিহার এলাকার একটি শ্মশানে গিয়ে বাবাকে দাহ করেন তিনি। সংবাদ সংস্থাকে মনমীত বলেছেন, ‘সরকার হাসপাতালে অক্সিজেন দিতে পারছে না। অন্তত শ্মশানে জায়গা তো দিক, যাতে পৃথিবী থেকে বিদায়টা ঠিকমতো হয়!’

জায়গার অভাবে গাজিপুরের কাছে একটি শ্মশানের পার্কিং লটই গণচিতার আকার নিয়েছে। পরপর জ্বলছে দেহ। গত রবিবার কোভিডে মৃত্যুর পর গাজিয়াবাদ জেলা আদালতের এক কর্মীকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল হিন্দোন শ্মশানে। মৃত ব্যক্তির সহকর্মী ত্রিলোকী সিংহ জানিয়েছেন, তারা সকাল ৮টায় পৌঁছানোর পর টোকেন দেওয়া হয় বেলা ১০টার। কারণ লম্বা লাইন পড়েছে। পরে সেই টোকেন বদলে নতুন সময় দেওয়া হয় সন্ধ্যা ৬টায়।

শবানুগামীরা দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন। হঠাৎই এক স্থানীয় ব্যক্তি এসে খবর দেন, রাস্তার কুকুর এসে মৃতদেহ ছিঁড়ে দিচ্ছে। তারা দৌড়ে যান। সেই ছবি ও সংবাদ প্রকাশ্যে এসে নিদারুণ বিড়ম্বনায় ফেলেছে দিল্লি সরকারকে। কংগ্রেসের মুখপাত্র রণদীপ সিংহ সুরজেওয়ালা ‘নিজের মানুষের দেহের ওপর দাঁড়ানো কোনও সরকার মজবুত হতে পারে না। অন্তিম সংস্কারের জন্য এই অন্তহীন অপেক্ষা শাসকের পাষাণ হৃদয়কেই তুলে ধরছে।‌‌’ সূত্র: আনন্দবাজার।

Share this post

scroll to top