সংবাদ বা খবর এর ইংরেজি প্রতিশব্দ `News’. `News’ শব্দটি `New’ এর বহুবচন। `New’ শব্দের অর্থ নতুন। এর সাথে `S’ যুক্ত হয়ে এই জগদ্ধ্যাপী শব্দের উৎপত্তি এবং নতুন কিছু (New Something) অর্থবোধক। অর্থাৎ নতুন নতুন সংঘটিত ঘটনাই সংবাদ বা নিউজ।
দেশে-বিদেশে এর অধিকাংশ সাংবাদিক পন্ডিতগণ তাদের লেখায় উল্লেখ্য করেছেন। কম্পাসের পয়েন্ট বা প্রধান চারটি দিক-
North
East
West
South
এই শব্দগুলোর অদ্যাক্ষর সমন্বয়ে `News’ শব্দটি গঠিত। “গোটা বিশ্বে বিস্তৃত উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম দিগন্তব্যাপী দিকগুলোর মধ্যে জনগণ যা জানতে আগ্রহী কৌতুহলী সেটিই `News’ বা ‘সংবাদ’।
বাংলায় সংবাদ শব্দটি বিশ্লেষণ করলে দাড়ায় সম্+বাদ = সংবাদ। ‘সম’ অর্থ সমসাময়িক বা সাম্প্রতিক আর ‘বাদ’ অর্থ হলো বার্তা,উক্তি,কথন,ভাষণ ইত্যাদি। অর্থাৎ ‘সংবাদ’ বলতে সাম্প্রতিক বা সমসাময়িক বার্তা বা তথ্য পরিবেশনকে বোঝায়।
কোন পন্ডিতগণ সংবাদ বা `News’ কে এইভাবে ব্যাখা করেন-
N= Notable
E= Entertainment
W= Weather
S= Sports
তাহলে আমরা সংবাদ,খবর বা নিউজের সংজ্ঞা এভাবে দিতে পারি-“গোটা বিশ্বে বিস্তৃত উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম দিগন্তব্যাপী দিকগুলোর মধ্য নতুন ব্যতিক্রমী বা অস্বাভাবিক, যা তাৎক্ষণিক সময়োপযোগী আশু, সম্ভাব্য, উন্নয়ন, অগ্রগতি মূলক, জনস্বার্থ বিষয়ক, সত্য নির্ভূল তথ্য নির্ভর, নীতি-বিধি ও আইনসিদ্ধ, প্রথম প্রকাশিত ব্যাপক সংখ্যক মানুষকে আকৃষ্ট করে তাহাই সংবাদ খবর বা নিউজ।
এককথায়, পৃথিবীর চারদিকে নতুন গুরুত্ববহ যা কিছু ঘটছে তাহা প্রথম প্রকাশ হয় তাই সংবাদ।
সুতরাং বড় ভারবাহী ব্যঞ্জনাময় সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার শব্দই খবর।
সংবাদপত্রের বিশেষজ্ঞগণ সংবাদ, খবর বা নিউজকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন যাহা নিম্ন রূপ-
‘নিউইয়র্ক সান’ পত্রিকার সম্পাদক চার্লস এ ডানা সংবাদকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে,“ইতোপূর্বে মনোযোগ আকৃষ্ট হয়নি অথচ সমাজের একটা বৃহৎ অংশকে কৌতুহলী করে তোলে এমন যে কোন বিষয়ই সংবাদ”।
জন কার্ডুনির মতে,“সংবাদ = ঘটনা+মানুষ+পাঠকের আগ্রহ”
নিউইয়র্ক টাইমস এর সাবেক রাত্রিকালীন সহকারী ব্যবস্থাপনা সম্পাদক নীল ম্যাকলীন তাঁর লেখা `Without Fear or Favor’ গ্রন্থে লিখেছেন, “সংবাদ হচ্ছে সংবাদপত্র পাঠকদের জন্য চলমান কিছু আগ্রহোদ্দীপক ও গুরুত্বসম্পন্ন ঘটনা বা বাস্তব অবস্থার বিবরণীর সমষ্টি যা সংবাদপত্রগুলো প্রকাশ করে থাকে।
জর্জ এম মরিস বলেছেন, ‘সংবাদ হচ্ছে সাত তাড়াতড়ির ইতিহাস’।
জন চ্যান্সেলরের মতে, ‘সংবাদ হলো দ্বন্দ্ব ও পরিবর্তনের এক সময়ানুক্রমিক সত্যনিষ্ঠ তথ্য বিবরণী’।
আর পার্থ সারথীর মতে,‘সচরাচর ঘটে না এমন কিছুই হলো সংবাদ’।
প্রফেসর সাখাওয়াত আলী খান এর মতে,‘একজন পেশাদার সাংবাদিক তার উদ্দিষ্ট পাঠক-দর্শক-শ্রোতাদের জন্য যেভাবে লিখে এবং যা লিখে সন্তুষ্ট হন তাই সংবাদ’।
মেলভিন মেনচারের মতে, ‘সাধারণ ঘটনা প্রবাহের মাঝে স্বাভাবিকতা ক্ষুণœকারী, ব্যতিক্রমী ও অপ্রত্যাশিত ঘটনার তথ্য বিবরণী হলো সংবাদ’।
প্রফেসর উইলিয়াম জে ব্লেয়ারের মতে, ‘ব্যাপক সংখ্যক মানুষকে আকৃষ্ট করে এমন আশু, আকর্ষণীয়, সময়োপযোগী তথ্য পরিবেশন হচ্ছে সংবাদ’।
টার্নার ক্যাটলেজ এর মতে,‘সংবাদ হচ্ছে এমন কিছু আজ যা আপনি খুঁজে পেলেন অথচ আগে আপনার তা জানা ছিল না’।
বাস্টিয়ান, কেস ও বাস্কেটের মতে,‘ খবর হলো- মানুষ যে সম্পর্কে ভাবে, কথা বলে, দেখে, আলোচনা করে, পরিকল্পনা করে, সে সম্পর্কিত সর্বশেষ, আকর্ষণীয়, গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ভূল তথ্যের রেকর্ড’।
থমসন ফাউন্ডেশনের মতে, ‘সংবাদ কখনও সহজে উদঘাটিত হয় না; সংবাদ হচ্ছে এমন কিছু যা লোকজন লুকোতে চায়- বাকি সবটাই বিজ্ঞাপন’।
ম্যাকব্রাইড কমিশন এর মতে, ‘শুধুমাত্র ঘটনার প্রতিবেদন নয়, উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের প্রতিবেদনও সংবাদ’
এতক্ষণ আমরা সংবাদের সংজ্ঞা নিয়ে আলোচনা করেছি। বিভিন্ন সাংবাদিক লেখকদের সে সব সংজ্ঞা সম্পর্কিত আলোচনা থেকে একটা সম্যক ধারণাও জন্মেছে সংবাদ সম্পর্কে। আমরা বুঝতে পেরেছি যে সংবাদ হচ্ছে কতগুলো তথ্যের সমষ্টি।
এখন কথা হচ্ছে সংঘটিত ঘটনাটি যে সংবাদ তা কি করে বুঝবো?
বিশ্বে হাজারো ঘটনা ঘটছে প্রতি মূহুর্তে; তা সবই সংবাদ নয়। ‘সুনির্দিষ্ট মানদন্ডে’ নির্বাচিত কিছু বিশেষ ঘটনার প্রকাশযোগ্য তথ্য বিবরণী হলো সংবাদ। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে কি সেই মানদন্ড- যার ভিত্তিতে কোন ঘটনার পরখ করে সংবাদ চেনা যায়।
সংঘটিত ঘটনাটি সংবাদ কি-না তা ঘটনার মধ্যস্থিত কতগুলো উপাদান বিশ্লেষণ করে আমরা সহজেই সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারি। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে দুটো বিষয়-
১. ঘটনার সত্যতা বা বিশ্বাসযোগ্যতা।
২. ঘটনার উপযুক্ত প্রমাণ তথ্যাদি।
সংবাদ হচ্ছে সত্যের বয়ান, নিয়মের ব্যতিক্রম, আগামীর ইতিহাস। উড়ন্ত ইতিহাসও বলে। অনেকেই খবরকে একটি পচনশীল প্রোডাক্ট বলে উল্লেখ করেছেন। সমর্থন প্রকাশ করে বলছি খবর এখন জলদি পঁচে। তাই ঘটনা প্রথম যা প্রকাশ হওয়া খবর। দ্বিতীয় বার থেকে প্রকাশ হওয়া বাসী বা পচন খবর।
খবর লিখার কিছু উপাদান-
১. গুরুত্ব, খ্যাতি বা প্রমিনেন্স: বিখ্যাত-কুখ্যাতরা ঘটনার সাথে জড়িত এমন খবর চায় পাঠক।
২. দ্বন্দ্ব সংঘাত বা কনফ্লিক্ট: প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে বিজয় ছিনিয়ে আনার আগ্রহ মানুষের সহজাত। অভ্যন্তরীণ,
আর্ন্তজাতিক সব রকম সংঘাতের প্রতি মানুষের কৌতুহলী নজর, দ্বন্দ্ব এবং তার পরিণতির খবর জানতে চায় পাঠক।
৩. ফলাফল: অনেক ঘটনার পরিণতি বা ফলাফল খবরের উপাদান হয়ে উঠে।
৪. সর্বোপরি সংবাদ হবে বস্তুনিষ্ঠ: উল্লেখিত বৈশিষ্ট্য সমূহের সমন্বয়ে সংবাদের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য যে
যৌগিক বৈশিষ্ট্যটি নিশ্চিত করা সম্ভব তা হলো সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা।
৫. সংবাদ হবে যথার্থ: সংবাদ হবে নির্ভূল তথ্যের ভিত্তিতে রচিত, যথার্থ পদ্ধতি ও কাঠামোয় লিখিত এবং যথাযথভাবে
উপস্থাপিত তথ্যচিত্র। সংবাদ হবে বাস্তব তথ্য নির্ভর। নির্ভরযোগ্য তথ্য সূত্রের ভিত্তিতে সংবাদ রচিত হবে। মনে
রাখা জরুরি যে, পাঠককে ভুল তথ্য বা আংশিক সত্য জানিয়ে বিভ্রান্ত করার কোন অধিকার সাংবাদিকের নেই।
৬. সংবাদ হবে বিশ্বাসযোগ্য: পাঠক মাত্রই সংবাদকে নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য রূপে দেখতে চায়। বিশ্বাসযোগ্যতা যে
কোন সংবাদ মাধ্যমের প্রধান পুঁজি। অনেক দিনের সত্যনিষ্ঠ তথ্য সেবার মধ্যে দিয়েই কেবল একটি সংবাদ মাধ্যম
পাঠকের আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। একটি মিথ্যা সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে মূহুর্তেই সেটা নষ্ট
হয়ে যেতে পারে।
৭. সংবাদ হবে ভারসাম্যপূর্ণ: সংবাদ হবে প্রতিবেদকের নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা এবং সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের ভাষা
বা বক্তব্য সহকারে বস্তুনিষ্ঠ তথ্যের ভিত্তিতে পক্ষপাতমুক্ত লিখা।
৮. সংবাদ হবে সংক্ষিপ্ত: সংবাদ হবে সব ধরনের বাহুল্য বর্জিত, প্রকৃত নির্ভেজাল তথ্যের ভিত্তিতে লিখিত সহজ-সরল ও
সংক্ষিপ্ত বিবরণী।
৯. সংবাদ হবে তাৎক্ষণিকতা: বিশেষ করে ‘হার্ড নিউজ’ এর ক্ষেত্রে তাৎক্ষনিকতার বৈশিষ্ট্য অপরিহার্য। হার্ড নিউজ হলো এক প্রকার পরম, চরম বা গরম সংবাদ। এক অর্থে সংবাদ হলো সব ধরনের পণ্য বা বস্তুর মধ্যে সব চাইতে তাজা বস্তু। আবার সংবাদ মূল্যের বিচারে তাৎক্ষণিকতার মানদন্ডে সংবাদ সব চাইতে পচনশীল তথ্যপণ্য। সঙ্গত কারণে তাৎক্ষণিকতা হলো সংবাদের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ও অপরিহার্য উপাদান।
সর্বোপরি দুর্নীতি, অনিয়ম, সংঘর্ষ, অপরাধ, দুঃসাহস, প্রাকৃতিক দূর্যোগ, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, শিহরণ অভিনবত্ব, ট্র্যাজেডি, রহস্য ইত্যাদিই সংবাদ বা খবর।