জীবনের চরম সংকটকালে পরম সান্ত্বনা ও ভরসার স্থল হিসেবে যার কথা প্রথম মনে পড়ে তিনিই মমতাময়ী মা। একজন আদর্শ মায়ের অভাবে ব্যক্তি, সমাজ ও জাতি বিপন্ন হতে বাধ্য। সুতরাং মা হিসেবে ইসলামে একজন নারীর অবস্থান বা মর্যাদা অকল্পনীয়। মা সম্পর্কে হাদিসে বলা হয়েছে, ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। ’ কম শব্দের এ হাদিসে অত্যন্ত ব্যাপকভাবে বলে দেয়া হয়েছে মা সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি। সুতরাং মায়ের সন্তুষ্টি অর্জন একজন সন্তানের অপরিহার্য দায়িত্ব।
أَخْبَرَنَا عَبْدُ الْوَهَّابِ بْنُ عَبْدِ الْحَكَمِ الْوَرَّاقُ، قَالَ: حَدَّثَنَا حَجَّاجٌ، عَنْ ابْنِ جُرَيْجٍ، قَالَ: أَخْبَرَنِي مُحَمَّدُ بْنُ طَلْحَةَ وَهُوَ ابْنُ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ، عَنْ أَبِيهِ طَلْحَةَ، عَنْ مُعَاوِيَةَ بْنِ جَاهِمَةَ السَّلَمِيِّ، أَنَّ جَاهِمَةَ جَاءَ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، أَرَدْتُ أَنْ أَغْزُوَ وَقَدْ جِئْتُ أَسْتَشِيرُكَ، فَقَالَ: «هَلْ لَكَ مِنْ أُمٍّ؟» قَالَ: نَعَمْ، قَالَ: «فَالْزَمْهَا، فَإِنَّ الْجَنَّةَ تَحْتَ رِجْلَيْهَا»
মুআবিয়া ইব্ন জাহিমা সালামী (রহঃ)
আমার পিতা জাহিমা (রাঃ) রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর খিদমতে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমি যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছা করেছি। এখন আপনার নিকট পরামর্শ জিজ্ঞাসা করতে এসেছি। তিনি বললেনঃ তোমার মা আছেন কি? সে বললোঃ হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ তাঁর খিদমতে লেগে থাক। কেননা, জান্নাত তাঁর দু’পায়ের নিচে।
সুনানে আন-নাসায়ী, হাদিস নং ৩১০৪
হাদিসের মান: হাসান সহিহ
পিতামাতার সাথে সদাচারন করার ব্যাপারে কোরআনের বাণীঃ
وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا
অর্থঃ “আর তোমার প্রতিপালক ফয়সালা করেছেন যে, তোমরা কেবল তাঁরই ইবাদত করবে এবং পিতামাতার সাথে ভালব্যাবহার করবে। তোমার বর্তমানে তাদের একজন বা উভয়েই বার্ধ্যকে পৌছে যায় তাহলে তাদের সামনে উফ শব্দটুকুও করবে না এবং তাদেরকে ধুমুক দিবে না । তাদের সাথে সুন্দরভাবে কথা বলবে। সূরা আল-ইসরা, আয়াত,২৩।
এব্যাপারে হাদীসের বাণীঃ
حديث معاوية بن جاهمة أنه جاء النبي صلى الله عليه وسلم قال : يا رسول الله أردتُ أن أغزو ، وقد جئت أستشيرك فقال : هل لك أم ؟ قال : نعم ، قال : فالزمها ؛ فإن الجنة تحت رجليها .
অর্থঃ মুয়াবিয়া ইবনে জাহিমা রাঃ নামের এক ছাহাবী রাসূল সাঃ এর কাছে এসে বললেন: হে আল্লাহর রাসূল সাঃ আমি যুদ্ধ করতে চাই। আর আমি আপনার কাছে পরামর্শ চাইতে এসেছি। তখন রাসূল সাঃ বললেন: তোমার মা কি বেঁচে আছেন। তখন ছাহাবীটি বললেন হা আছেন। তখন রাসূলে আকরাম সাঃ বললেন: তুমি তার কাছেই থেকে যাও। কেননা জান্নাত তো তাঁর পায়ের নিচে। নাসায়ী, তাবারানী, হাদীসের সনদ হাসান । তবে হাকিম রহঃ এবং যাহাবী রহঃ সহীহ বলেছেন আর মুনযিরী রহঃ স্বীকৃতি দিয়েছেন।
অতএব কোরআন এবং হাদীসের নির্দেশনা অনুযায়ী সবসময় পিতামাতার সাথে ভালব্যাবহার করা এবং তারা কষ্ট পায় এমন কথা বা কাজ করা থেকে বিরত থাকা আমাদের একান্ত কর্তব্য। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন।
শান্তির ও মানবতার ধর্ম ইসলাম মা’কে দিয়েছে বর্ণনাতীত মর্যাদা ও সম্মান। ইসলামের দৃষ্টিতে বাবার চেয়ে মায়ের মর্যাদা তিন গুণ বেশি। এ প্রসঙ্গে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি রাসূল (সা.)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে জানতে চাইলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! মানুষের মাঝে আমার নিকট থেকে সর্বোত্তম সেবা লাভের অধিকার কার? নবী (সা.) বলেন, তোমার মায়ের। লোকটি পুনরায় জানতে চাইলেন, তারপর কার? তিনি বললেন, তোমার মায়ের। লোকটি পুনরায় জানতে চাইলেন, তার পর কার? তিনি বললেন, তোমার মায়ের। লোকটি আবারও জানতে চাইলেন, তারপর কার? তিনি বললেন, তোমার পিতার। -বোখারি ও মুসলিম
পবিত্র কোরআনে কারিমের কয়েক স্থানেও মায়ের কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করে মাকে বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভধারণ করেছেন এবং দুই বছর দুগ্ধপান করিয়েছেন। ’ –সূরা লোকমান : ১৪
‘তার জননী তাকে কষ্ট সহকারে গর্ভধারণ করেছেন এবং কষ্ট সহকারে প্রসব করেছেন। তাকে গর্ভেধারণ করতে ও স্তন্যছাড়তে সময় লেগেছে ত্রিশ মাস। ’ -সূরা আহকাফ : ১৫
উল্লেথিক আয়াত দু’টোতে বিশেষতঃ মায়ের কষ্টের বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। নয় মাস ধরে গর্ভেধারণ, অপরিসীম কষ্টের সাথে সন্তান প্রসব করণ এবং গর্ভধারণ ও বুকের দুধ খাওয়ানোতে ত্রিশ মাস কাটানো এ ধরনের কষ্টের বদলা দেয়া সন্তানের পক্ষে অসম্ভব।
কোনো ব্যক্তি মাকে পিঠে বহন করে হজ সম্পাদন করালেও তার বদলা পরিশোধ হবে না। এ বিষয়ে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, জনৈক ব্যক্তি রাসূল (সা.)-এর দরবারে হাজির হয়ে অভিযোগ করল যে, তার মা বদমেজাজের। রাসূল (সা.) বললেন, নয় মাস পর্যন্ত অব্যাহতভাবে যখন তিনি পেটে ধারণ করে ঘুরছে তখন তো তিনি বদমেজাজের ছিলেন না। লোকটি বলল, হুজুর আমি সত্যই বলছি, তিনি খারাপ মেজাজের। হুজুর (সা.) বললেন, তোমার জন্য যখন তিনি রাতের পর রাত জাগ্রত থেকেছেন এবং তোমাকে দুধ পান করিয়েছেন তখন তিনিতো বদমেজাজের ছিলেন না। সে ব্যক্তি বলল, আমি আমার মায়ের প্রতিদান দিয়ে ফেলেছি। রাসূল (সা.) বললেন, সত্যিই কি তার প্রতিদান দিয়ে ফেলেছো? জবাবে লোকটি বলল, আমি আমার মাকে কাঁধে চড়িয়ে হজ করিয়েছি। তখন রাসূল (সা.) এবার সিদ্ধান্তকারী রায় দিয়ে বললেন, ‘তুমি কি তার সে কষ্টের বদলা বা প্রতিদান দিতে পার যা তোমার ভূমিষ্ট হওয়ার সময় স্বীকার করেছেন? অর্থাৎ মাকে পিঠে করে হজ সম্পাদন করালেও ভূমিষ্ট হওয়ার সময়ে তার যে কষ্ট হয়েছে সেটার ন্যূনতম বদলা হবে না।
হাদিস থেকে আরো জানা যায় যে, নামাজ চালিয়ে যাওয়া থেকে মায়ের ডাকে সাড়া দেয়া উত্তম কাজ। ইসলামে মা হিসেবে নারীকে যে সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছে দুনিয়ার অপর কোনো সম্মান বা মর্যাদার সাথে তার তুলনা চলে না।
মায়ের সেবা-যত্ন না করলে, মাকে কষ্ট ও দুঃখ দিলে সন্তান যতই ইবাদত-বন্দেগি আর নেকের কাজ করুক না কেন, তার পক্ষে বেহেশত লাভ করা সম্ভব নয়। এ বিষয়ে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত, নবী করিম (সা.)-এর সময় ‘আলকামা’ নামক এক যুবক কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়। তার রোগ ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেতে থাকে। শয্যাপাশে উপস্থিত সেবা-শুশ্রুষাকারীরা জীবনের অন্তিম সময় ভেবে তাকে কালেমা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পাঠ করার উপদেশ দিতে থাকে। কিন্তু শত চেষ্টা করেও সে তা উচ্চারণ করতে পারে না। রাসূল (সা.) এ আর্শ্চয ঘটনা সম্পর্কে জানতে পেরে জিজ্ঞাসা করলেন, তার মা কি জীবিত আছে? বলা হলো তার পিতা মারা গেছে তার মা জীবিত আছে। অবশ্য সে খুবই বয়োবৃদ্ধ। তখন তাকে রাসূল (সা.)-এর দরবারে উপস্থিত করা হলো। তার নিকট তার ছেলের কথা উল্লেখ করে এর কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস করা হলো। সে বলল, আলকামা বড় নামাজী, বড় রোজাদার ব্যক্তি এবং বড়ই দানশীল। সে যে কত দান করে তার পরিমাণ কারো জানা নেই। রাসূলুল্লাহ (সা.) জিজ্ঞাস করলেন, তোমার সাথে তার সম্পর্ক কেমন? উত্তরে বৃদ্ধা মা বলল, আমি ওর প্রতি খুবই অসন্তুষ্ট। তার কারণ জিজ্ঞাসা করায় সে বলল, সে আমার তুলনায় তার স্ত্রীর মন যোগাত বেশি, আমার ওপর তাকেই বেশি অগ্রাধিকার দিত এবং তার কথা মতো কাজ করতো। রাসূল (সা.) বললেন, ঠিক এ কারণেই আল্লাহতায়ালা তার মুখে কালেমার উচ্চারণ বন্ধ করে দিয়েছেন। অতঃপর রাসূল (সা.) হজরত বিলাল (রা.)কে আগুনের একটি কুণ্ডুলী জ্বালাতে বললেন এবং তাতে আলকামাকে নিক্ষেপ করার আদেশ করলেন। আলকামার মা এ কথা শুনে বলল, আমি মা হয়ে তা কেমন করে হতে দিতে পারি! সে যে আমার সন্তান, আমার কলিজার টুকরা। এবার রাসূলে কারিম (সা.) বললেন, তুমি যদি চাও যে, আল্লাহ তাকে মাফ করে দিন তাহলে তুমি তার প্রতি খুশি হয়ে যাও। অন্যথায় আল্লাহর শপথ, তার নামাজ, রোজা ও দান-খয়রাতের কোনো মূল্যই হবে না আল্লাহর দরবারে। অতঃপর আলকামার মা বলল, আমি আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমি তাকে মাফ করে দিলাম। এরপর খবর নিয়ে জানা গেল যে, আলকামা অতি সহজেই কালেমা উচ্চারণ করতে সমর্থ হয়েছে। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর এ হাদিস প্রমাণ করে মায়ের মনে এতটুকু কষ্ট কত বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। হাদিসের এ ঘটনা মায়ের মর্যাদাকে বাড়িয়ে আরো শক্তিশালী করেছে।
মায়ের সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় নবী করিম (সা.)-এর ভূমিকা বিশ্বের ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। তিনি মায়ের স্নেহ-মমতার সুযোগ না পেলেও দুধ মা হালিমার স্নেহ-মমতা ভুলেননি। নবী করিম (সা.)-এর অন্তরের মণিকোঠায় ছিল মা হালিমার স্থান। তাই চল্লিশ বছরের বেশি বয়সেও তাকে মা, মা বলে ডাকতে শুনা যেত। নিজের গায়ের চাদরটি খুলে বিছিয়ে তার বসার স্থান করে দিতে দেখা যেত।
বস্তুত মা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত। ইসলাম মাকে যথাযথ মর্যাদা ও মূল্যায়ন করেছেন। ইসলাম মনে করে মায়ের মর্যাদা ও সম্মানকে বিশেষ দিনে আবদ্ধ না করে ইসলাম প্রদত্ত মর্যাদা ও সম্মানের আলোকে সারা জীবন প্রত্যেকেই নিজ নিজ জন্মদাত্রী মায়ের সেবা-যত্ন ও সম্মান করুক, মর্যাদা দিক।