শিল্প ঋণ বিতরণে অনীহায় ১১ ব্যাংককে সতর্ক করল বাংলাদেশ ব্যাংক

ক্রেডিট কার্ড, ভোক্তা ঋণসহ বিভিন্ন অনুৎপাদনশীল খাতে ঋণ বিতরণ করলে মুনাফা বেশি পাওয়া যায়। একই সাথে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা এ খাতে ঋণ নেয়ায় আদায়ের হারও বেশি। বিপরীতে শিল্প ঋণে ঝুঁকি বেশি। বিশেষ করে চলমান পরিস্থিতিতে শিল্প খাতে ভালো উদ্যোক্তা পাওয়া যাচ্ছে না। যারা এ খাতে ঋণ নিতে আগ্রহী তাদের বেশির ভাগই ব্যাংকিং খাতে ভালো উদ্যোক্তা নন। তাদের বিরুদ্ধে ঋণ নিয়ে ঋণ পরিশোধ না করার অভিযোগ রয়েছে।

ফলে বেশির ভাগ ব্যাংকই লোকসান কাটাতে অনুৎপাদনশীল খাতে বেশি হারে ঋণ দিচ্ছে। তবে কটেজ, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ঋণ দিতে নিজেদের দেয়া লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ করছে না ১১টি দেশী-বিদেশী সরকারি ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক। তারা লক্ষ্যমাত্রার ৩০ শতাংশ ঋণ বিতরণ করেনি। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোকে সতর্ক করা হয়েছে। একই সাথে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ঋণ বিতরণের পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, দীর্ঘ দিন যাবত বিনিয়োগ মন্দ চলছে। শিল্প খাতে ঋণ দিতে ভালো উদ্যোক্তা পাওয়া যাচ্ছে না। যারা আসছেন, তাদের বেশির ভাগেরই অতীত ইতিহাস ভালো নয়। ফলে ব্যাংকগুলো অনেকটা নিরুপায় হয়ে বিকল্প বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এতে ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকিও বাড়ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, ব্যাংকিং খাতে যারা বড় অঙ্কের ঋণ নিচ্ছেন, তাদের বেশির ভাগই ঋণ পরিশোধ করছেন না। ব্যবসা-বাণিজ্য মন্দার কথা বলে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ না করায় ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে চলছে। এদিকে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর এক দিকে খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে বেশি হারে। এতে ব্যাংকের আয় কমে যাচ্ছে। অপর দিকে কয়েকজন উদ্যোক্তার কাছে ঋণ আটকে যাওয়ায় ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে ব্যাংকিং খাতের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এদিকে ব্যাংকের নিট আয় কমে গেলেও ব্যয় কমছে না বরং বেতন-ভাতা, বিদ্যুৎ, ভবন ভাড়াসহ নানা ইউটিলিটি বিল বেড়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলো বাধ্য হয়ে বিকল্প বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এভাবেই অনেক ব্যাংকের শিল্পখাতে ঋণ আনুপাতিক হারে কমে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ভোক্তা ঋণ, ক্রেডিট কার্ড অনুৎপাদনশীল খাতে ঋণ বিতরণ করায় ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাংকগুলোর ঋণ তদারকি করে এমনি একটি বিভাগের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কেউ ভুয়া স্যালারি সার্টিফিকেট দিয়ে এবং ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে ক্রেডিট কার্ড ও ভোক্তা ঋণ নিয়ে পালিয়ে আছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সেই সব ভুয়া গ্রাহককে খুঁজে পাচ্ছে না। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো দেশী এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রার বিপরীতে এই কার্ড ব্যবহার করার জন্য গ্রাহকদের একই কার্ড অথবা দুই ধরনের কার্ড দিয়ে আসছে। এসব কার্ডের বিপরীতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে অনেক ব্যাংক সর্বোচ্চ শতকরা ৩০-৪০ ভাগ পর্যন্ত সুদ আদায় করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিনিয়োগ স্থবিরতার মাঝে বেশির ভাগ ব্যাংকই লোকসান কাটাতে ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ করছে। এর পরেও ব্যাংকগুলোর পরিচালন ব্যয় কমছে না। এ পরিস্থিতিতে বছর শেষে নিশ্চিত লোকসানের হাত থেকে রক্ষা পেতে কোনো কোনো ব্যাংক আগ্রাসী ব্যাংকিং শুরু করেছে। অনেকে প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের বাইরে এসে ক্রেডিট কার্ড, ভোক্তা ঋণের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ঋণসীমা বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে ভোক্তাদের।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা মনে করছেন, জামানতবিহীন ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ঝুঁকির পরিমাণ বাড়ছে ব্যাংক খাতে। কেননা এমনিতেই জামানত নিয়েও ব্যাংকের বড় বড় ঋণের বিপরীতে আদায় হয় না। হলমার্ক, বিসমিল্লাহসহ বড় বড় ঋণ কেলেঙ্কারির ধকল ব্যাংক খাতকে এখনো ভোগাচ্ছে। এর বাইরে জামানতবিহীন ঋণ বেড়ে যাচ্ছে যার কারণে ঝুঁকির পরিমাণ আরো বাড়ানো হচ্ছে এ খাতে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, ব্যাংকগুলো ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে বেশি ঋণ দিচ্ছে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে বিতরণকৃত ঋণ শ্রেণী বিভাজন করা যাচ্ছে না। এর ফলে পরিদর্শন করতে গিয়ে নানা বিপত্তির মুখে পড়ছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শকরা। গ্রাহকদের সক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ঋণসীমা বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। সাধারণ গ্রহকদের এক লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণসীমা দেয়া হচ্ছে। জামানতবিহীন ঋণ দেয়ার মাধ্যমে ঋণঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে নতুন করে ঝুঁকির মুখে ফেলছে ব্যাংকিং খাতকে। পরিস্থিতি সীমার বাইরে যাওয়ার আগেই সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

এরই অংশ হিসেবে ১১টি ব্যাংককে সতর্ক করা হয়েছে। ব্যাংকগুলোর মধ্যে পাঁচটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক, দুইটি সরকারি ব্যাংক ও চারটি বিদেশী ব্যাংক রয়েছে। ব্যাংকগুলোকে নিজেদের দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ক্ষুদ্র ও মাঝারিখাতে ঋণ বিতরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top