বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশ সফররত ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ডা. লোটে শেরিং মনে করেন, এবারের বাংলাদেশ সফর তার জন্য গৌরবের। তিনি ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের স্মৃতির কথা উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে স্বাক্ষাতে বলেন, তিনি বাংলাদেশে মোটেও নতুন নন। ১৯৯১ সালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ২৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে তাঁর মেডিকেল শিক্ষাজীবন শুরুর স্মৃতিচারণ করে তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন সকালে গুলশান থেকে মোটরসাইকেলে চড়ে মাত্র ২০ মিনিটে শাহবাগে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালে পৌঁছে যাওয়ার দিনগুলোর কথাহোন্ডায় চড়ে, যাতে ২০ মিনিটে চলে আসা যায়। তা-ও সকালবেলা রওনা দিয়ে। ৯টার দিকে রওনা দিলে অনেকক্ষণ লাগত। তাই তিনি সকালবেলা চলে আসতেন। তাতে খুব কম সময় লাগত হোন্ডায় চড়ে।’
গতকাল মঙ্গলবার ঢাকায় ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে বেরিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘তিনি (লোতে শেরিং) তো আমাদের ছেলে।
এসময় তিনি বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতি উপেক্ষা করে তারা যে ঢাকা এসেছেন এটা আমাদের জন্য গৌরবের। ঢাকা সফর শেষে দেশে ফিরে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীদের ২১ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে।’
মোমেন বলেন, ‘ভুটানের সঙ্গে আমরা কানেক্টিভিটি বাড়াতে চাই। এটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী তো আমাদেরই ছেলে। তিনি এখান থেকেই মেডিক্যালে পড়েছেন। তিনি তার শিক্ষা জীবনের ১৩ বছর ময়মনসিংহ ও ঢাকায় কাটিয়েছেন। দারুণ বাংলাও বলতে পারেন।’
লোটে শেরিং ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসএস করেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশ সফরে এসে শিক্ষা জীবনে ময়মনসিংহের যেখানে যেখানে ছিলেন সেসব জায়গা ঘুরে দেখেন তিনি। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে বক্তব্যও রাখেন লোটে শেরিং।
প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং ঢাকায় মোটেও নতুন নন। প্রধানমন্ত্রী হয়ে দুই বছর আগে পহেলা বৈশাখে বাংলাদেশ সফরের সময় ছুটে গিয়েছিলেন তাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে। বিদেশি শিক্ষার্থী হিসেবে একসময় বাংলাদেশে পড়ালেখা করা লোতে শেরিং এখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাচ্ছেন ভিভিআইপি প্রটোকল। লোটে শেরিং গতকাল সকালে ঢাকায় এসে পৌঁছার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উপস্থিত হয়ে তাঁকে স্বাগত জানান। বিমানবন্দরে ভুটানের প্রধানমন্ত্রীকে লাল গালিচা সংবর্ধনা ও গার্ড অব অনার দেওয়া হয়।
লোটে শেরিং ঢাকায় পৌঁছার পরপরই ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের ফেসবুক পেজ ও টুইটার বার্তায় বলা হয়েছে, “তিনি আবারও সেই ভূমিতে ফিরে এসেছেন। এটি কার্যত তাঁর ‘সেকেন্ড হোম’ (দ্বিতীয় ঠিকানা)। এখানেই তিনি একজন চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন আঁকড়ে ধরেছিলেন। তবে এবার তিনি একজন দূত হিসেবে ভুটানের মহামান্য রাজার বিশেষ প্রার্থনা ও ভুটানের জনগণের ভালোবাসা নিয়ে এসেছেন (বাংলাদেশের জন্য)।”
ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বিমানবন্দর থেকে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে যান। সেখানে তিনি মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগকারী বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এরপর ঢাকায় ফিরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানান। বিকেলে তাঁর সঙ্গে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে সাক্ষাতের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও কানেক্টিভিটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ দেশের নৌপথগুলো ব্যবহারের বিষয়ে তাঁদের আগ্রহ আছে।
মানুষে-মানুষে যোগাযোগ বাড়ানোর বিষয়ে ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘মানুষে-মানুষে যোগাযোগ বাড়াচ্ছি। আমরা চিন্তা করছি, ঢাকা-থিম্পু সরাসরি ফ্লাইট চালু করতে পারি। তারা (ভুটান) রেলওয়ে পছন্দ করে। হলদিবাড়ী টু চিলাহাটি নিয়ে আমাদের একটু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে।’
কভিড মহামারির মধ্যে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সফরসঙ্গীদের বাংলাদেশে আসার বিষয়টিকে বিশাল ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, কভিড মোকাবেলায় ভুটানে বেশ কড়াকড়ি। সেখানে কভিডে মৃত্যুর সংখ্যা নেই বললেই চলে। এ জন্য তারা পুরস্কারও পেয়েছে। এই কড়াকড়ির মধ্যেও বাংলাদেশের উদযাপন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তাঁরা ফ্লাইট নিয়ে চলে এসেছেন। ফেরার পর প্রধানমন্ত্রীসহ প্রতিনিধিদলের সবাইকে বাধ্যতামূলক ২১ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। বন্ধু রাষ্ট্রের জন্য এ এক বিশাল ত্যাগ।
ভুটানের প্রধানমন্ত্রী গতকাল প্রধানমন্ত্রী আয়োজিত নৈশ ভোজেও অংশ নেন।
তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে লোটে শেরিং বাংলাদেশে আসার আগেই দেশটির রয়্যাল একাডেমি অফ পারফর্মিং আটর্সের (রাপা) ২২ শিল্পী ও চারজন সাংবাদিক ১৯ মার্চ ঢাকা আসেন।
১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর বিশ্বের প্রথম রাষ্ট্র হিসেবে ভুটান বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এর মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সূচনা হয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিফ অফ প্রটোকল আমানুর রহমান জানান, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ডা. লোটে শেরিং ২৫ মার্চ পর্যন্ত ঢাকায় থাকবেন। তার এ সফরে দ্বিপক্ষীয় নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে।
তিনি বলেন, দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে একান্ত বৈঠক ছাড়াও প্রতিনিধি পর্যায়ে সংলাপ হবে। সার্বিক বিবেচনায় ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর এই সফর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বলে বিবেচিত হবে।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে গত ১৭ জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে শুরু হয়েছে বিশেষ অনুষ্ঠান; চলবে ২৬ মার্চ পর্যন্ত।
১০ দিনের এই বিশেষ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এরই মধ্যে মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম মোহাম্মেদ সোলিহ, শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে ও নেপালের রাষ্ট্রপতি বিদ্যা দেবি ভাণ্ডারি বাংলাদেশ সফর শেষে দেশে ফিরে গেছেছেন। ২৬ মার্চ সকালে আসার কথা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির।
ভুটানের প্রধানমন্ত্রী আজ বুধবার (২৪ মার্চ) জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডের অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। সেখানে তিনি সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখবেন। পরে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করবেন।