করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে লকডাউনে মানুষ অনেকটা গৃহবন্দী ছিল। ধারণা করা হয়েছিল, লকডাইনে দম্পতিদের সন্তান উৎপাদন বেড়ে যাবে। তবে সেই ধারণা বাস্তব হয়নি। বরং যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কিছু দেশে এর উল্টাটা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত এক শতাব্দীর ইতিহাসে দেশটিতে সবচেয়ে কম সংখ্যক শিশুর জন্ম হয়েছে। ইউরোপের কয়েকটি দেশেও শিশু জন্মের হার অনেক কমে গেছে।
মহামারীর শুরুতে জার্মানির ফ্রেডেরিকে যখন তার বয়স্ক মা-বাবাকে দেখাশোনা করার কথা ভেবেছিলেন, তার মনে হয়েছিল যে এটা তার জীবনে উপহার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কারণ এর ফলে তিনি তার পরিবারের সাথে আরো বেশি সময় কাটানোর সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু কয়েক মাস পরেই ৩৩ বছর বয়সী ওই নারী অনুভব করতে শুরু করেন যে তার জীবনে বুঝি বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে।
ফ্রেডেরিকে একজন অবিবাহিত নারী। তিনি ভেবেছিলেন খুব শিগগিরই কারো সাথে তার পরিচয় হবে, যার সাথে তিনি তার সংসার জীবন শুরু করতে পারবেন। কিন্তু তার মনে হলো যে মহামারী আসলে জীবন থেকে সেই সুযোগ কেড়ে নিচ্ছে। তিনি বলেন, `বর্তমানে সময় অত্যন্ত মূল্যবান। মনে হচ্ছে, আমার জীবন যেন থমকে গেছে।’
অনলাইনে ডেটিং করার চেষ্টা করেছেন তিনি। কিন্তু প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় বাইরে গিয়ে রোমান্স করার মতো যথেষ্ট আগ্রহ তার ছিল না তার। এখনো তিনি বিষণ্ণতায় ভুগছেন। তার মাথায় সবসময় একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খায়, ‘এই অবস্থার যখন সমাপ্তি হবে তখন তো আমার সন্তান জন্ম দেয়ার ক্ষমতা থাকবে না। যখন আমি সন্তান নিতে পারতাম তখন আমি ঘরে বসে আছি।’
‘বিস্ময়কর কিছু নয়’
ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ফিলিপ এন কোহেন বলেছেন, ‘মহামারী পরিস্থিতি এতো খারাপ তা দেখে আমি বিস্মিত হইনি।’
গত বছরের জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রে ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের অর্থনীতিবিদরা অনুমান করেছিলেন যে দেশটিতে শিশু জন্মের পরিমাণ তিন লাখ থেকে পাঁচ লাখ কমে যাবে। একই সময়ে ইউরোপেও একটি জরিপ চালানো হয়েছে। যাতে দেখা গেছে, জার্মানি ও ফ্রান্সে ৫০% মানুষ ২০২০ সালে সন্তান নেয়া থেকে বিরত থাকছে। ইতালিতে ৩৭% মানুষ বলেছে, তারা এই পরিকল্পনা বাদ দিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংক্রান্ত একটি দফতর সিডিসির রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে ডিসেম্বর মাসে শিশুর জন্ম ৮% কমে গেছে। ইতালির পরিসংখ্যান অনুসারে, এ বছরের শুরুতে শিশু জন্মের হার কমেছে ২১.৬% ও স্পেনে এই হার রেকর্ড রাখা শুরু হওয়ার পর থেকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে, কমেছে ২০%।
মহামারী শুরু হওয়ার পর প্রথম নয় মাসে ফ্রান্স, কোরিয়া, তাইওয়ান, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া- এসব দেশেই জন্মের হার কমেছে। বলা হচ্ছে, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে এসব দেশে গত ২০ বছরের তুলনায় সবচেয়ে কম সংখ্যক শিশুর জন্ম হয়েছে।
মাক্স প্লাঙ্ক ইনসটিউটের জনসংখ্যা বিষয়ক গবেষক জশুয়া ভিল্ডে ও তার দল এই হ্রাস আগেই অনুমান করেছিল। তাদের গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, এই অবস্থা যুক্তরাষ্ট্রে অন্তত আরো কয়েক মাস অব্যাহত থাকবে।
অক্টোবর মাসে তারা অনুমান করেছিল যে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে শিশুর জন্ম ১৫.২% কমে যাবে। কিন্তু এখন তারা দেখছে যে এই হার কমার প্রবণতা অগাস্ট মাস পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। বলা হচ্ছে, এক শতাব্দীরও বেশি সময়ের মধ্যে শিশুর জন্মের হার কখনো এতোটা কমে যায়নি। এ ছাড়াও শিশু জন্মের ওপর ২০০৮ সালের বিশ্বমন্দা ও ১৯২৯ সালের মহামন্দার চেয়েও বর্তমান মহামারীর প্রভাব আরো বেশি দীর্ঘস্থায়ী বলে মনে করা হচ্ছে।
ভিল্ডে বলেন, ‘সাধারণত এ ধরনের মন্দা ও মহামারীর সময় আমরা দেখি যে শিশু জন্মের হার কমে যায়। পরে সেটা আবার বাড়তে থাকে। আপনি হয়তো কল্পনা করতে পারেন যে যখন প্রথম ওয়েভ শেষ হলো, অনেকেই ভেবেছিল যে এখনই সন্তান নেয়ার সময়। কিন্তু এবারের মহামারীতে সেরকম হয়নি। এবার আমি যা দেখতে পাচ্ছি তা হলো, যেসব লোকজন সন্তান নেয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন, তারা আরো দীর্ঘ সময়ের জন্য অপেক্ষা করছে।’
কেউ কেউ তো এই সিদ্ধান্তও নিয়েছে যে তারা আর সন্তানই নেবে না। স্টিভের বেলায় এমনটাই হয়েছে। গত তিন বছর ধরে তিনি তার স্ত্রীর সাথে বারবার একই বিষয়ে কথাবার্তা বলেছেন। স্টিভের স্ত্রী আরো একটি সন্তান নিতে চান। তাদের দুই ছেলেসন্তানের জন্য একটা ছোট্ট বোন নিতে চান তিনি। কিন্তু স্টিভ চারজনের সংসার নিয়েই খুশি। তিনি বলেন, ‘ফলে প্রতিবছর আমাকে নানা ধরনের অজুহাত দেখাতে হয়।
তারা নাইজেরিয়াতে থাকেন। স্টিভ তার স্ত্রীকে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল নয়। কিন্তু তার স্ত্রী সেটা কিছুতেই বুঝতে চান না। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারীর পর এই প্রথম সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে আর কোনো সন্তান নয়।
জাতিসঙ্ঘের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মহামারীর কারণে ১১৫টি দেশের এক কোটি ২০ লাখ নারী পরিবার পরিকল্পনা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এর ফলে মা-বাবার না চাওয়া সত্ত্বেও প্রায় ১৪ লাখ শিশুর জন্ম হতে পারে। শুধুমাত্র ইন্দোনেশিয়াতেই সরকার অনুমান করেছিল যে মহামারীর কারণে পাঁচ লাখ শিশুর জন্ম হতে পারে। এ কারণে লকডাউনের সময় সরকার শহরে শহরে গাড়ি পাঠিয়েছে যেখান থেকে লাউডস্পিকারে সন্তান না নেয়ার বিষয়ে লোকজনকে সতর্ক করা হয়েছে।
এসব বার্তার মধ্যে ছিল, ‘অনুগ্রহ করে আপনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করুন। বিয়ে করতে পারেন। কিন্তু গর্ভধারণ করবেন না।’
দেশটির জাতীয় পরিবার পরিকল্পনা সংস্থা বলছে, লকডাউনের কারণে লোকজন ক্লিনিক ও ফার্মাসিতে যেতে না পারার কারণে প্রায় এক কোটি মানুষ জন্মনিরোধক ব্যবহার করতে পারেনি।
শারীরিক সম্পর্ক কি কমে গেছে?
ইউরোপ ও আমেরিকাতে শিশুর জন্ম কমে যাওয়াকে উল্লেখ করা হচ্ছে ‘বেবি বাস্ট’ হিসেবে। তাত্ত্বিকভাবে বেবি বাস্ট হচ্ছে, লোকজনের শারীরিক সম্পর্কে জড়ানোর আগ্রহ কমে যাওয়া।
যুক্তরাষ্ট্রে ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিনসে ইনসটিটিউটের রিপোর্ট অনুসারে, যাদের ওপর জরিপ চালানো হয়েছে তাদের ৪০% নারী-পুরুষ ও বয়সের পার্থক্য নির্বিশেষে বলেছে যে মহামারীর সময় তাদের শারীরিক সম্পর্ক করার আগ্রহ কমে গেছে। চীনেও একই ধরনের গবেষণা চালানো হয়েছিল। তাতেও একই ফল পাওয়া গেছে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়াতে চালানো গবেষণায় দেখে গেছে লোকজনের মধ্যে শারীরিক সম্পর্কের আগ্রহ কমেনি।
মাস্ট্রিচ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মনোবিজ্ঞানী ও যৌনবিজ্ঞানী মারিয়েকে দেভিতে বলেছেন, এসব গবেষণা থেকে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। লোকজনের যৌনতা ও সম্পর্কের ওপর মহামারীর কী ধরনের প্রভাব পড়ে তাতে একেকজন একেকভাবে সাড়া দিয়ে থাকে।
তিনি আরো বলেন, ‘অনেকে আছেন স্ট্রেসের কারণে যাদের যৌন চাহিদা বৃদ্ধি পায়। আবার বাকিরা শারীরিক সম্পর্ক করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।’ তবে অর্থনৈতিক অবস্থার সাথে শিশু জন্মের সম্পর্ক আছে। বিভিন্ন দেশে সবসময়ই দেখা গেছে যে অর্থনীতি ভালো হলে শিশু জন্মের হার বেড়ে যায়। অনিশ্চয়তার কারণে এই হার হ্রাস পায়।
ইউরোপে চালানো গবেষণায় দেখা গেছে, জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের যেসব এলাকা করোনাভাইরাসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে, ওইসব জায়গায় লোকজন সন্তান জন্ম দেয়া থেকে বিরত থেকেছে। কিন্তু উত্তর ইউরোপের কিছু ধনী দেশ- নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, যেখানে করোনাভাইরাস মহামারী ভালোভাবে মোকাবেলা করেছে। এসব দেশে ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে শিশু জন্মের হার সামান্য কমেছে। একেবারে হ্রাস পায়নি।
‘চড়া মূল্য’
শিশু জন্ম কমে যাওয়া মোটামুটি সারা বিশ্বেরই প্রবণতা। যাতে অনেকে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ভবিষ্যতে কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা কমে গেলে সরকারের রাজস্ব আয়ও কমে যাবে। তার ফলে বয়স্ক লোকজনকে পেনশন ও স্বাস্থ্যসেবা দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। অথচ মানুষ এখন আগের তুলনায় বেশি সময় বেঁচে থাকছে।
এই সমস্যার সমাধান আছে, অবসর নেয়ার বয়স বাড়িয়ে দেয়া অথবা অভিবাসনের ব্যাপারে লোকজনকে উৎসাহিত করা। কিন্তু এগুলোর রাজনৈতিক দিকও রয়েছে। অনেক দেশ শিশু জন্মের হার বাড়ানোর চেষ্টা করে সামান্য সফল হয়েছে। একবার যখন এই হার কমে যায়, তখন নারীদেরকে সন্তান নেয়ার ব্যাপারে প্রভাবিত করা খুব কঠিন।
অধ্যাপক ফিলিপ কোহেন বলেন, ‘২০০৯ সালে বড় ধরনের অর্থনৈতিক মন্দার পর পরিস্থিতি হয়তো কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সেটা আগের পর্যায়ে ফিরে যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রে শিশু জন্মের হার মন্দার আগের পর্যায়ে আর কখনোই ফিরে যায়নি।’
বর্তমান মহামারী যতোই দীর্ঘ হচ্ছে নারীদের বয়সও ততো বাড়ছে। তাদের জন্য সন্তান ধারণের সময়ও কমে আসছে। যেমন জার্মান নারী ফ্রেডেরিকে মনে করছেন, তার সময়ও ফুরিয়ে আসছে। এরকম পরিস্থিতিতে তিনি তার ডিম্বাণু হিমায়িত করে রাখার কথাও চিন্তা করছেন। ভাবছেন তার সমকামী পুরুষ বন্ধুর সাথে সন্তান গ্রহণের কথাও। না হলে তার হয়তো কখনোই সন্তান নেয়া হবে না। তিনি বলেন, ‘বয়স্ক লোকজনকে রক্ষার জন্য এটা করতে আমি রাজি। কিন্তু এর জন্য আমাকে অনেক বেশি মূল্য দিতে হবে।’
সূত্র : বিবিসি