সাপ্তাহিক ছুটিসহ ও একুশে ফেব্রুয়ারির টানা তিন দিনের ছুটিতে পর্যটকের ঢল নেমেছে কক্সবাজারে। হোটেল-মোটেলগুলোতে ঠাঁই মিলছে না।
ট্যুরিস্ট পুলিশের ধারণা, গতকাল শুক্রবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) সৈকতে সমবেত হন প্রায় তিন লাখ পর্যটক। আজ শনিবার এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। আগামীকাল রোববার (২১ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত সাড়ে চার শতাধিক হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট ও কটেজের সব কক্ষই পর্যটকে ভরপুর থাকবে।
এদিকে শুক্রবার সকালে থেকে রাত অবধি দেখা গেছে, হোটেলে রুম ভাড়া না পেয়ে ব্যাগ ও লাগেজ নিয়ে অনেক পর্যটক বালিয়াড়িতেই অবস্থান করছেন, অনেকে সাগরতীরে। কেউ কেউ সড়কে পায়চারি করে সময় পার করছেন। তবে হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ ও যানবাহনের অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ তুলেছেন পর্যটকরা।
শুক্রবার সৈকতের লাবণী, সুগন্ধা ও কলাতলী পয়েন্টে দেখা যায়, পর্যটকরা সৈকতে নেমে গোসল করছেন। আরও অনেকেই বালুচরে দৌড়-ঝাঁপে ব্যস্ত। কেউ দ্রুতগতির জেডস্কি নিয়ে নীল জলের বিশাল সমুদ্রে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলেছেন। আবার কেউ মুগ্ধ হচ্ছেন ছেলেমেয়েদের ঢেউয়ের তালে সমুদ্র স্নানের দৃশ্য দেখে।
সপ্তাহের অন্য ছুটির দিনের চেয়ে একটু যেনো আলাদা এবারের ছুটির আমেজ। টানা তিন দিনের ছুটিতে কক্সবাজার পরিণত হয়েছে উৎসবের নগরীতে। আনন্দে মাতোয়ারা পর্যটকরা পাল্টে দিয়েছে সৈকতে দৃশ্যপট। তিল ধারণের ঠাঁই নেই সৈকতে। দলে দলে নামছেন তারা। প্রকৃতির বিশালতার কাছে যেন নিজেকে আত্মসমর্পণ করছেন।
শামীম ও নাসরিন দম্পতি বলেন, ‘শুক্র, শনি সাপ্তাহিক ও রোববার একুশে ফেব্রুয়ারির টানা ছুটি পেয়ে কক্সবাজারের ছুটে আসা। মূলত কক্সবাজারই আমাদের কাছে ঘুরে বেড়ানো প্রিয় স্থান। খুব ভাল লাগে এখানে।’
পর্যটক রিয়াদ বলেন, ‘ছুটি পেয়েছি, তাই কক্সবাজারে চলে এসেছি। এখানকার অপরূপ প্রকৃতি খুব ভালো লাগে, কাছে টানে। ফলে ছুটির সময়টা এখানে পাহাড়, সাগর ও প্রকৃতি উপভোগ করব।’
এদিকে পর্যটকের আগমনে ব্যস্ত সময় পার করছেন সৈকতের ফটোগ্রাফার, ঘোড়াওয়ালা, জেডস্কি ও বাইক চালকরা।
ফটোগ্রাফার কামাল বলেন, ‘বেশ ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। পর্যটকদের ছবি তুলে ভাল আয়ও হচ্ছে। আশা করি, আরও দুয়েকদিন ভাল ব্যবসা করা যাবে।’
জেডস্কি চালক রহিম বলেন, ‘শুক্রবার সকাল থেকেই সৈকতে হাজার হাজার পর্যটক। এই মৌসুমে মনে হয় সবচেয়ে বেশি পর্যটক এই সময়ে এলো। পর্যটকরা জেডস্কিতে চড়ে সাগর উপভোগ করছেন। ফলে আমাদের ব্যবসাও ভাল হচ্ছে।’
এদিকে তিন দিনের টানা ছুটিতে কক্সবাজারে পর্যটকের ঢল নামায় হোটেল-মোটেলগুলোতে ঠাঁই মিলছে না। অনেকেই হোটেলে কক্ষ ভাড়া না পেয়ে সমুদ্রসৈকত ও সড়কে পায়চারি করছেন। পর্যটকদের অভিযোগ, হোটেল থেকে শুরু করে রেস্তোরাঁ, যানবাহনসহ সবখানে বাড়তি ভাড়া ও অসদচারণের শিকার হওয়ার পাশাপাশি চরম হয়রানিতে পড়ছেন তারা। এসবের জন্য করোনা ও দালালচক্রকে দুষছেন পর্যটন ব্যবসায়ীরা। তবে জেলা প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে পর্যটকদের হয়রানি নিরসন করা হবে বলে জানিয়েছে ট্যুরিস্ট পুলিশ।
বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে লাখো পর্যটকের যেন মেলা বসেছে। সাপ্তাহিক ও একুশে ফেব্রুয়ারির টানা তিন দিনের ছুটিতে তাদের পদচারণায় মুখর সাগরতীরসহ পর্যটন স্পটগুলো।
শুধু হোটেল, বালিয়াড়ি কিংবা সাগরতীর নয়; অনেক পর্যটক ইনানী, সেন্টমার্টিন, হিমছড়ি, রামুর রামকোট, পাতুয়ারটেক সৈকত দেখতেও ভিড় জমাচ্ছেন।
সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে হোটেলে রুম ভাড়া না পেয়ে ব্যাগ ও লাগেজ নিয়ে অবস্থান করছেন বালিয়াড়িতে। আবার অনেক পর্যটক অবস্থান করছেন সাগরতীরে। ভ্রমণে এসে অনেক পর্যটক হোটেল রুমের জন্য ঘুরছেন। কেউ চাচ্ছেন অতিরিক্ত ভাড়া। পর্যটকদের অভিযোগ, তারা হয়রানি শিকার হচ্ছেন।
সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে ব্যাগ ও লাগেজ নিয়ে অবস্থান করা পর্যটক ইলিয়াছ উদ্দিন বলেন, ‘হোটেলের রুম আগে বুকিং করিনি। হঠাৎ করে পাঁচ জনের একটি টিম কক্সবাজারের ছুটে এলাম। কিন্তু সকাল ৬টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত হোটেল মোটেল জোনে ঘুরে বেড়িয়েছি। কিন্তু কোনো রুম ভাড়া পাইনি। ফলে এখন সাগরের বালিয়াড়িতে অবস্থান করছি।’
প্রধান সড়কে সুগন্ধা পয়েন্টের মোড়ে অবস্থান নেওয়া পর্যটক রায়হান কবির বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার হোটেল সানসেট রিসোর্টে ১২০০ টাকায় রুম ভাড়া নিয়ে ছিলাম। কিন্তু শুক্রবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) রুম থেকে বের করে দিয়েছে। রুমের ভাড়া দ্বিগুণ দিতে চেয়েছিলাম তাও দেয়নি। পরে দেখলাম ১২০০ টাকার ওই রুম চার হাজার টাকায় ভাড়া দিয়েছে।’
পর্যটক শুক্কুর, কাইয়ুম ও ছৈয়দ বলেন, ‘সি ল্যান্ড গেস্ট হাউসে একটি রুম ভাড়া চেয়েছিলাম। তারা একদিনের জন্য ছয় হাজার টাকা চেয়েছে। পরে অতিরিক্ত টাকায় রুম ভাড়া নিয়ে চলে আসি।’
এদিকে টানা ছুটিতে করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া ও হয়রানির জন্য দালালচক্রকে দুষছেন পর্যটন ব্যবসায়ীরা।
‘সি ল্যান্ড’ গেস্ট হাউসের ম্যানেজার জাহেদ বলেন, ‘করোনার কারণে আমরা তো পুরো বছরই বসা ছিলাম। আর টানা ছুটির এই তিন দিনে কী পুরো বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যায়?’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক হোটেল ম্যানেজার বলেন, ‘কলাতলী থেকে শুরু সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মোড় পর্যন্ত কয়েকটি দালালচক্র রয়েছে। যারা এই টানা ছুটিকে কাজে লাগিয়ে অসাধু উপায়ে হোটেল মোটেল রিসোর্ট ও কটেজগুলো থেকে বেশি ভাড়া আদায়ের ব্যবসা শুরু করেছে একটি দালাল চক্র। তারাই নানাভাবে পর্যটকদের হয়রানি করছে।’
এদিকে পর্যটকদের নিরাপত্তায় সমুদ্র সৈকত ও সড়কগুলোতে ট্যুরিস্ট পুলিশের অবস্থান দেখা গেলেও হোটেল-মোটেল জোনে কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা প্রশাসনের লোকজন দেখা যায়নি।
ট্যুরিস্ট পুলিশের পরিদর্শক মো. সাকের আহমদ বলেন, ‘পর্যটকদের নিরাপত্তায় সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি পয়েন্ট, পর্যটন স্পট ও বালিয়াড়িতে ট্যুরিস্ট পুলিশের টহল জোরদার করা হয়েছে। ফলে আগত পর্যটকরা নিরাপদে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘ট্যুরিস্ট পুলিশের সঙ্গে জেলা প্রশাসনের একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছেন। সুতরাং যেখানে পর্যটকরা হয়রানির শিকার হবেন; অভিযোগ পাওয়া মাত্র সেখানে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে সমন্বয় করে পর্যটকদের হয়রানি নিরসনে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’