মানুষ আলোটাই দেখে, আলোর শৌর্যে দীপ্তমান হয়ে উঠে ঠিক কিন্তু আলোর অন্তরালে যে সলতে জ্বলতে থাকে তাকে কেউ গুরুত্বারোপ করে না। খেয়ালে রাখে না। সলতেটা জ্বলতে জ্বলতে একপর্যায়ে শেষ হয়ে যায়, কেউ বলে না- সলতেটা পুড়ে গেল। সবাই বলে, আলোটা নিভে গেল। কারণ মানুষ ফলের হিসাব গুনলেও ফুলের হিসাব রাখে না যে ফুল থেকে ফল হয়েছে। মানুষ স্বভাবতই সম্মুখে যা থাকে তাই সানন্দে গ্রহণ করে।
এ বাঙালি জনপদের কমবেশি সবাই ক্রিকেট প্রিয়-অনুরাগী। ক্রিকেটের আদ্যোপান্ত কারো অজ্ঞাত নয়। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল যখন কারো বিপক্ষে মাঠে নামে তখন তো টেলিভিশনের সামনে থেকে উঠাই রীতিমতো দুরূহ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। গোল্লায় যাক পড়াশোনা, প্রাইভেট, খাওয়া-দাওয়া, অফিস, চাকরি এবং প্রেমালাপ। এমন অন্ধ ক্রিকেট অনুসারীর সংখ্যাও কম নয়। কোন খেলোয়াড় টেস্ট ক্রিকেট আলোড়িত করেছে, ওয়ানডে ক্রিকেটে কে সর্বোচ্চ উইকেট নিয়ে বিশ্ব রেকর্ড করেছে, কার রান রেট কত, ক্রিকেট অঙ্গনে ডাবল সেঞ্চুরি এবং ট্রিপল সেঞ্চুরি কার দখলে- সবই নখদর্পণে থাকলেও নেই কেবল একজন মানুষের কৃতিত্বের কথা। মাটিচাপা পড়ে আছে সেই মানুষটির নাম। হয়তো কালে-ভদ্রে শোনা যায়, হয়তো শোনাই যায় না! আমরা কতজন সারদারঞ্জনকে জেনেছি, কতজন শুনেছি তার নাম।
আজ যে অবস্থায় বাংলাদেশ ক্রীড়াঙ্গন, তা একদিনের নয়। বহু বছরের, বহু ইতিহাসের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বর্তমান বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল। যেখানে ১১ জন বাঙালি বীর বাংলাদেশের পক্ষে বল-ব্যাটে যুদ্ধ করার জন্য ২২ গজের ক্রিজে নামে। এ লেখায় সেই গল্পই বলবো, বাঙালির ক্রিকেট ইতিহাসের শুরুর সেই গল্প বলতে গেলে ফিরে যেতে হবে আঠারো শতকের ময়মনসিংহ অঞ্চলে। যখন বিদ্যুৎ ছিলো না, কংক্রিটের রাস্তা-ঘাট ছিলো না, পাকা ঘর ছিলো না, শিক্ষা-দীক্ষা-অর্থ ছিলো না: ছিলো জমিদারি শাসন ব্যবস্থা আর ছিলো কালজয়ী পালাগান।
মৈমনসিংহ গীতিকার জন্য বিখ্যাত এ জনপদ। এ পালাগানের সংগ্রাহক চন্দ্রকুমার দে। পরবর্তীতে ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তা প্রকাশ করেন। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে এ অঞ্চলেই প্রথম ক্রিকেটের হাতেখড়ি হয়। হাতেখড়ি হয়েছিলো যার মাধ্যমে তিনি সারদারঞ্জন রায়। ষোড়শ শতকে ক্রিকেট খেলার প্রচলন হয় বলে ধারণা করা হয়। ইংল্যান্ড দাবি করে- তারা এই খেলা প্রচলন করেছে। কিন্তু অনেক ক্রিকেটবোদ্ধা মনে করেন, এর প্রচলন ৭ম শতাব্দীতেও ছিলো। তখন ব্যাট বল নামে একটি খেলা ভারতীয় উপমহাদেশে চর্চা হতো। পাঞ্জাব প্রদেশের ‘দোয়াব’ এলাকার অধিবাসীরা সর্বপ্রথম ক্রিকেটের মতোই ব্যাট-বল নামক একটি খেলার গোড়াপত্তন করে। যাই হোক, আন্তর্জাতিকভাবে ক্রিকেট খেলা শুরু হয়, ১৮৭৭ সালের ১৫ মার্চ।
অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন। ওই সময়কার দুই বনেদি ক্রিকেট দল অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের মধ্যে প্রথম টেস্ট ম্যাচ শুরু হয়। এই ম্যাচকেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ক্রিকেটের আনুষ্ঠানিক যাত্রা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কিন্তু তার আগে, ১৮৭০ সালেই বাংলায় সারদারঞ্জন রায় ক্রিকেট ইতিহাসের সূচনা করেছিল। বাঙালিদের ক্রিকেট খেলার সাথে পরিচিত করান তিনি। বিশেষ করে সাধারণ বাঙালিদের সঙ্গে। সেই হিসাবে বাঙালির ক্রিকেটের ইতিহাস দেড়শ’ বছরের অধিক সময়।
বঙ্গ ক্রিকেটের পুরোধা সারদারঞ্জন রায় ১৮৬১ সালে বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলায় মসুয়া গ্রামের রায় পরিবারে জন্মেছিলেন। কালীনাথ রায় ছিলেন তার বাবা। শিক্ষা জীবনের শুরুটা এখান থেকেই, কিশোরগঞ্জের মাইনর স্কুলে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করে ভর্তি হন ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে। পড়াশোনায় মাথা ছিলো, তাই পেয়েছেন প্রেমচাঁদ রায় চাঁদ বৃত্তি। পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সারদারঞ্জন রায় সবার বড়। অন্যরা হলেন কামদারঞ্জন, মুক্তিদারঞ্জন, কুলদারঞ্জন, প্রমোদারঞ্জন, গিরিবালা, ষোড়শীবালা ও মৃণালিনী। একপর্যায়ে ভাই কামদারঞ্জন পরিচিত হয়ে উঠেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী নামে। কিন্তু কেন? পৃথিবীর বিচার কখনো কখনো সমান হয় না। যে পায়, সে অনেক পায়। যে পায় না, সে কিছুই পায় না। কালীনাথ রায়ের ভাই জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরী এবং তার স্ত্রী রাজলক্ষ্মী দেবী ছিলেন নিঃসন্তান। তাই কামদারঞ্জনকে পাঁচ বছর বয়সে দত্তক নিয়েছিলেন তারা, নাম পরিবর্তন করে রেখেছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। যিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের লেখক, শিশুসাহিত্যিক, চিত্রকর এবং বাংলা ছাপাখানার পথিকৃৎ। পাঠক সমাজে গুপি-গাইন-বাঘা-বাইন বই লিখে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। এছাড়া বিখ্যাত ‘সন্দেশ’ পত্রিকা বের করেন তিনি। তার ছেলে সুকুমার রায় ছিলেন বিখ্যাত ছড়াকার। সুকুমার রায়ের ছেলে সত্যজিৎ রায় ছিলেন ভারতবর্ষের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক। ‘পথের পাঁচালী’ সিনেমার জন্য অস্কার জিতেছিলেন।
সারদারঞ্জন রায় পাঠ্য-বইয়ের সঙ্গে আরো একটি জ্ঞান সর্বদা লালন করতেন- ক্রিকেট। ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। বিএ পরীক্ষায় ঢাকা অঞ্চলের মধ্যে হন- প্রথম। কিন্তু ক্রিকেটের প্রতি তার যে ঝোঁক তা থেকে সে কখনই দূরে থাকতে পারেননি। তার নেতৃত্বে ঢাকা এবং আস্তে আস্তে সমগ্র বাংলাদেশে ক্রিকেট খেলার বিস্তার প্রসারিত হতে থাকে। তার হাতেই বাংলার প্রথম ক্রিকেট ক্লাব হিসেবে ১৮৮০ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে- ঢাকা কলেজ ক্লাব। চলতে থাকে ক্রিকেট চর্চা। মাঝে তিনি সংস্কৃত পড়তে যান কলকতায়। তবে শেষ করেননি। অসমাপ্ত রেখে গণিত শিক্ষক হিসেবে অধ্যাপনায় নিযুক্ত হন; কিন্তু ক্রিকেট?
ক্রিকেট তিনি ছাড়তে পারেননি, ক্রিকেটও তাকে ছাড়েনি, তার সঙ্গেই আছে। ১৮৮৪ সালে কলকাতার ইডেন গার্ডেনে ক্যালকাটা প্রেসিডেন্সি ক্লাবের সঙ্গে এক খেলায় ঢাকা কলেজ জয়লাভ করে। এ জয়ের ধারা ছন্দপতন খুব একটা হয়নি। ওই বছরই কলকাতার ঐতিহ্যবাহী টাউন ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন সারদারঞ্জন। এটি ছিলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ এবং স্বদেশী জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বেলিত করার একটি কৌশল। কেননা ওই সময় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নিয়মিত খেলত ঢাকা কলেজ ক্রিকেট ক্লাব এবং কলকাতার টাউন ক্লাব। ব্রিটিশরা শাসক আর তারা শোষিত। এরই ধারাবাহিকতায় ‘নন্দন-কানন’ খ্যাত ইডেন গার্ডেনের মাঠে হঠাৎই একদিন টাউন ক্লাবের হয়ে খেলতে দেখা গেলো স্বামী বিবেকানন্দকে। সবাই তো অবাক! অবাক হলেও সত্য, সেই ম্যাচে স্বামী বিবেকানন্দ আরো খানিকটা অবাক করে দিয়ে তুলে নেয় ৭ উইকেট! সেদিন ব্রিটিশদের গঠন করা কলকাতা ক্রিকেট ক্লাবের মুখোমুখি হয়েছিল টাউন ক্লাব। উল্লেখ্য, কলকাতা ক্রিকেট ক্লাব ১৭৯২ এবং কলকাতা টাউন ক্লাব ১৮৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী নেতা হেমচন্দ্র ঘোষের কাছে সারদারঞ্জনের সন্ধান পায় দার্শনিক স্বামী বিবেকানন্দ। তাদের দু’জনের অনুপ্রেরণায় স্বামী বিবেকানন্দের পা গড়ায় ক্রিকেট মাঠে। ১৮৮৭ সালে সন্ন্যাস জীবন গ্রহণ করেন। তার আগে দুই বছর পর্যন্ত টাউন ক্লাবের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। কিন্তু ক্রিকেট তখন গণমানুষের, সাধারণ মানুষের খেলা ছিলো না।
ভারতের পার্সিরা, দিল্লি ও বোম্বে ক্রিকেট চর্চা হতো তুলনামূলক বেশি। কেননা তৎকালীন ক্রিকেট ছিলো খুব ব্যয়বহুল। ব্যাট-বল আসত বিলেত থেকে। সুতরাং দাম যে আকাশছোঁয়া হবে- এ তো অনুমান করাই যায়। ক্রিকেট খেলার সরঞ্জাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে ছিলো, তাই একে সাহেবী খেলাও বলা হতো। এসবের কারণে ক্রিকেট সীমাবদ্ধ ছিল কেবলমাত্র অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে। এমতাবস্থায় সারদারঞ্জন রায়ই ক্রিকেট খেলাকে গণমানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে আসেন। ক্রিকেট খেলার সামগ্রী উৎপাদন করবে বলে পরিকল্পনা করেন। কলকাতার যশোর রোডে ১৮৯৫ সালে ‘এস রায় অ্যান্ড কোম্পানি’ নামে ক্রিকেট সামগ্রীর একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। যেখানে ব্যাটও বানানো হয়। এ প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলার প্রথম ক্রিকেট সামগ্রী সুলভমূল্যে বিক্রয় করা হয়। জানা যায়, ১৯০৬ সালে সারদারঞ্জনের কারখানায় তৈরি হওয়া ‘ব্যালান্সড ব্যাট’ বিশেষ পুরস্কার পেয়েছিল। কীর্তিমানের মৃত্যু নেই, এ কথার ভিত্তি নেই। কীর্তিমানের মৃত্যু হয় যদি তাকে লালন করা না হয়।
তৎকালীন পূর্ববাংলায় জন্ম তার, তাই এখানকার খেলোয়াড়দের প্রতি আলাদা একটা টান ছিল। তাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন ভিন্ন কিছু করার। এ কারণে বাংলার মানুষ নিয়ে ১৯২০ সালে ইস্ট বেঙ্গল ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। ক্লাবের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্টও ছিলেন তিনি। ছিলেন ক্রিকেটের দক্ষ সংগঠক। ক্রিকেট কোচ হিসেবেও সারদারঞ্জন রায়ের অবদান অসামান্য। কিন্তু আমরা ক’জন চিনি তাকে?