বিএনপির চেয়ারাপরসন বেগম খালেদা জিয়ার কারাবাসের তিন বছর পূর্তি আজ সোমবার (৮ ফেব্রুয়ারি)। শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পেলেও পুরোপুরি মুক্ত নন বিএনপি প্রধান। দলটির নেতারা বলছেন, তাকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে। এ উপলক্ষে আজ ঢাকা মহানগরীসহ দেশে সব জেলা ও মহানগরে প্রতিবাদ সমাবেশ কর্মসূচি পালন করবে বিএনপি।
দলীয় সূত্র জানায়, প্যারোলে মুক্ত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার লন্ডন যাওয়ার পথ সুগম হচ্ছে। শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে তাকে বিদেশে যেতে দেয়ার ব্যাপারে সরকারের উচ্চ মহলের ইতিবাচক মনোভাবের কথা জানা গেছে। এ প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে ও তার জামিনের মেয়াদ বাড়াতে খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্যরাও সরকারের উচ্চ পর্যায়ে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। চলতি সপ্তাহেই পরিবারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন জানানো হবে দলটির নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে।
দুটি দুর্নীতির মামলায় ১৭ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত খালেদা জিয়া ২৫ মাস জেল খাটার পর গত বছরের ২৫ মার্চ জামিন পান। দুই মেয়াদে জামিনের মেয়াদ বাড়ানোর পর গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর তার জামিনের মেয়াদ বাড়িয়ে আগামী ২৬ মার্চ পর্যন্ত করা হয়। এবার ছয় মাসের সেই জামিনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পথে।
সূত্র জানায়, নতুন জামিনের জন্য ফের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে তার পরিবার। জামিনের মেয়াদ বাড়িয়ে খালেদাকে বিদেশে নিতে লিখিত আবেদনে প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি চাইবেন তারা। সাক্ষাতে খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে একটি শুভেচ্ছা চিঠিও নিয়ে যাওয়া হবে।
আবেদনের খসড়া প্রস্তুত
আগামী ২৬ মার্চের আগেই মেয়াদ বাড়াতে আবেদন করবে পরিবার। প্রস্তুতির অংশ হিসেবে খালেদা জিয়ার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ চার আইনজীবী খালেদা জিয়ার পরিবারের সঙ্গে সমন্বয় করে জামিনের মেয়াদ বাড়ানোর একটি খসড়া আবেদন তৈরি করেছেন। চলতি সপ্তাহেই সাজা স্থগিতের মেয়াদ বৃদ্ধির আবেদন করা হবে। তবে এসব বিষয়ে দলের নেতারা সম্পূর্ণ অন্ধকারে। তাদের বক্তব্য, দলীয় প্রধানের বিষয়ে সম্পূর্ণ সিদ্ধান্ত তার পরিবারের। এর সঙ্গে দলের কোনো সম্পর্ক নেই।
জানতে চাইলে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘ম্যাডাম ও তার পরিবার তো উন্নত চিকিৎসার জন্য বাইরে যেতে চাইবেন। কারণ, তার আত্মীয়রা স্বাস্থ্যের বিষয়টি দেখিয়ে মুক্তির আবেদন করেছেন, সরকারও মানবিকভাবে তা গ্রহণ করেছে। মুক্তির মূল উদ্দেশ্য ছিল ভালো চিকিৎসা। কিন্তু সেই সুযোগ হয়নি। এখন তার পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করা হবে এবং সরকার সেটাকে ইতিবাচক হিসেবে নেবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
আবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এরপর এটিতে আইন মন্ত্রণালয় মতামত দেবে। মুক্তি দেয়ার বিষয়টি সরকারের এখতিয়ার। সরকার চাইলে নির্বাহী আদেশে তাকে মুক্তি দিয়ে বিদেশে চিকিৎসা নেয়ার অনুমতি দেয়া হতে পারে।’
থেমে নেই সমঝোতার তৎপরতা
গত ২৬ মার্চ শর্তসাপেক্ষে মুক্তির পরও বসে নেই খালেদা জিয়ার পরিবার। সমঝোতার যে সূত্রে তার প্যারোলে মুক্তি হয়েছিল, উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে দেশের বাইরে নিতে সরকারের সেই সূত্রের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। এরইমধ্যে একবার বৈঠকও হয়েছে দুপক্ষের। কিন্তু দুপক্ষের কেউই এসব নিয়ে মুখ খুলছে না। সরকারের পক্ষ থেকে সবুজ সংকেত পেয়েই করোনার অজুহাতে দেশের কোনো হাসপাতালে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা করানো হয়নি।
লন্ডন পাঠানোর প্রস্তুতি শুরু
উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকার ও পরিবারের সমঝোতার মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে লন্ডনে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। খালেদা জিয়ার ভাই শামীম এসকান্দার ব্রিটিশ হাইকমিশনে তার এবং বোন খালেদা জিয়ার পাসপোর্টসহ কাগজপত্র জমা দিয়েছেন। এর আগে কূটনৈতিক মহলও এ নিয়ে বেশ উদ্যোগী হয়। সরকার অনুমতি দিলে ব্রিটিশ হাইকমিশন খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য ভিসা দেয়ার ঘোষণা দেয়। এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট ডিকসন জানিয়েছিলেন, সরকার অনুমতি দিলে খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য তারা ব্রিটেন যেতে ভিসা দেবেন।
সরকারের দুই শর্ত
সরাসরি রাজনীতি থেকে অবসরের কথা না বললেও খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যেতে সরকারের পক্ষ থেকে দুটি শর্তের কথা জানানো হয়েছে। প্রথমত, লন্ডনে গিয়েও চিকিৎসার প্রয়োজন ছাড়া প্রকাশ্যে চলাফেরা করতে পারবেন না তিনি। গুলশানে যেভাবে বাস করছেন লন্ডনে ঠিক তেমনি থাকবেন। দ্বিতীয়ত, বিদেশিদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ থেকে বিরত থাকবেন। লন্ডনে থাকা অবস্থায় রাজনৈতিক বক্তব্য-বিবৃতি দেয়া ও সভা-সমাবেশে যোগদান থেকে বিরত থাকা এবং নেতাকর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারবেন না। এক্ষেত্রে খালেদার পরিবার চায় শর্ত মেনেই চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যাবেন তিনি। তবে খালেদা জিয়া চান শর্ত ছাড়াই লন্ডন যেতে।
জানতে চাইলে খালেদা জিয়ার বোন সেলিমা ইসলাম বলেন, ‘জামিনের পরে তিনি এখন পর্যন্ত কোনো শর্ত ভঙ্গ করেননি। তাই এ ব্যাপারে সরকার কঠোর হবে না। তার বিদেশে চিকিৎসার প্রয়োজন। খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার এখনও তেমন উন্নতি হয়নি। চলাফেরাও করতে পারছেন না। মুক্তির মেয়াদ বাড়াতে আবেদন তো করতেই হবে। তবে কখন করব সে ব্যাপারে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি।’
শরীরের সর্বশেষ অবস্থা
খালেদা জিয়ার অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে। পুরোনো অস্টিও আর্থাইটিস, ডায়াবেটিসসহ অন্য সব রোগই আগের চেয়ে বেড়েছে। একা চলাফেরা করতে পারেন না। জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যথা কমেনি। বাসায় দুজন নার্স স্থায়ীভাবে রাখা হয়েছে। তারা বাসায় থেকেই তার স্বাস্থ্যের সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখছেন এবং ফিজিওথেরাপি দিচ্ছেন। এ ছাড়া তার মেরুদণ্ড, বাম হাত ও ঘাড়ের দিকে শক্ত হয়ে যায়। দুই হাঁটু প্রতিস্থাপন করা আছে। তিনি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধ খান। বাম চোখেও বেশ সমস্যা রয়েছে তার। সার্বিকভাবে চিকিৎসা তদারকি করছেন তার পুত্রবধূ ডা. জোবায়দা রহমান।
ফিরোজায় যেভাবে কাটে দিন
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খালেদা জিয়া নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন ও কোরআন তিলাওয়াত করেন। পত্রিকা পড়েন ও টিভির খবর দেখেন। লন্ডনে নাতনিদের সঙ্গে ভিডিওকলে কথা বলেন। বিকেলে চেয়ার পেতে বারান্দায় বসে থাকেন। ডায়াবেটিস থাকায় সতর্কভাবে খাবার খাচ্ছেন তিনি। স্যুপ, সবজি, রুটি, মুরগি, লাউ ও মাছের ঝোলের তরকারি ও সরু চালের ভাত ও পোলাও খান তিনি। বাসায় পুরোনো বাবুর্চিরাই রয়েছেন। অনেকসময় পরিবারের সদস্যরা বাসা থেকে রান্না করেও খাবার নিয়ে আসেন।
প্রয়োজন হলে দলের কাউকে ডেকে পাঠান বিএনপি প্রধান নিজেই। তবে মেডিকেল টিম যাচ্ছে মাঝে-মধ্যে। প্রতিদিনই একজন চিকিৎসক ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ পরীক্ষা করেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদলও যায় মাঝে-মধ্যে। ওষুধ খেয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন তিনি। এখন নিয়মিত ডায়াবেটিসের মাত্রা ৮ থেকে ১৪’র মধ্যে ওঠানামা করে।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসকদলের সিনিয়র সদস্য ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘ম্যাডামের শারীরিক অবস্থা আগের মতোই। ডায়াবেটিস এখনো ওঠানামা করে। আগে জয়েন্টে জয়েন্টে যে ব্যথা ছিল সেগুলো এখনো আছে। তিনি আগের মতো হাঁটাচলা করতে পারেন না।’