ময়মনসিংহ নগরীর চরকালীবাড়ি (মিলগেট) এলাকায় রেলওয়ের পরিত্যক্ত জমিতে বসবাস করেন বীরাঙ্গনা রেজিয়া বেগম কমলা। আবু হানিফ (৩৮) ও আবুল কায়সার মানিক (৩৪) নামে তার দুই ছেলে সন্তান রয়েছে। মা বীরাঙ্গনা হওয়ায় বয়স বাড়লেও বিয়ে করতে পারছেন না ছেলেরা। বিয়ের আলাপ শুরু হলেই মানুষ ভেঙে দেয়। মা বীরাঙ্গনা ছিলেন- এ কথা শুনে কেউ বিয়েতে রাজি হন না।
আমি ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে পারছি না। কেউ সাহায্যে এগিয়ে আসছে না। এখন কলঙ্ক নিয়ে বেঁচে আছি। মানুষ শুনলে ঘৃণার চোখে দেখে। সব মুক্তিযোদ্ধা যদি ভালো থাকে তবে আমার কেন এ অবস্থা? আমার কষ্টের কথা প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাই। চিকিৎসা ও স্থায়ী আশ্রয় চাই। এভাবেই মনে কষ্ট নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন এই বীরাঙ্গনা।
জানা গেছে, কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জের থানার নওবাইত গ্রামের প্রয়াত আবদুল আজিজের মেয়ে রেজিয়া বেগম কমলা। ১৯৭১ সালে তার বাবা আবদুল আজিজ নানসিঁড়ি গ্রামের কৃষক কডু মিয়ার কাছে বিয়ে দিয়ে দেন। বিয়ের দ্বিতীয় দিনের মাথায় স্বামী ও শশুর তাকে রেখেই ভারতে চলে যায়। যুদ্ধকালীন এই সময়টাতে চলে পাক হানাদার বাহিনীর নারকীয় নির্যাতন। জীবনের রঙ্গিন স্বপ্ন ভেঙ্গে তছনছ হয়ে যায় কমলার। স্বাধীনতার সাত বছর পর ময়মনসিংহ নগরীর নতুনবাজার এলাকায় তৎকালীন মোনায়েম খান এতিমখানার করনিক মো. আবুল কাশেমের সঙ্গে আবারও সংসার পাতেন কমলা। কাশেমের বাড়ি ছিলো নগরীর দাপুনিয়া এলাকায়। ১৯৯৪ সালে স্বামী মারা যাওয়ার ৮ দিনের মাথায় শাশুড়ী ও ভাসুর মিলে কমলাকে কলঙ্কিনী নাম দিয়ে সন্তানদেরসহ বের করে দেয়। পরে নগরীর ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ড এলাকায় এক নারীর আশ্রয়ে থেকে চা দোকানে কাজ শুরু করে সন্তানদের বড় করে তোলেন তিনি। তবে দশ বছর যাবত ময়মনসিংহের মিলগেট এলাকায় বসবাস করছেন। অভাবের কারণে ছেলেরা পড়ালেখা করতে পারেননি। আর তাই দুই ছেলে এখন পরিবহন শ্রমিক।
বীরাঙ্গনা রেজিয়া বেগম কমলার গত পাঁচ বছর আগে বুকের বাম পাশে টিউমারের মতো দেখা দেয়। তখন যন্ত্রণা শুরু হওয়ায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়।
পরে বিষয়টি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা বিমল পালকে জানানো হলে তিনি ময়মনসিংহ সিএমএইচে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। পরে সেখান থেকে ঢাকা সিএমএইচে করানো হয় অপারেশন। ধরা পড়ে ক্যান্সার। ছেলের একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ৫৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে মার্চের দিকে একটি কেমোথেরাপি দেন। আরো ৫টি কেমোথেরাপি দিতে হবে জানিয়েছিলেন চিকিৎসকরা। ভাতার ১২ হাজার টাকা দিয়ে সংসার ও নিজের চিকিৎসা চালানো দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে করোনার কারণে সব আটকে গেছে। অসুস্থ বীরাঙ্গনা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। প্রশাসনের কাছে আবাস ও চিকিৎসার অর্থ সহায়তার আবেদন করেও সাড়া মেলেনি। এছাড়া সমাজসেবা অধিদপ্তরে চিকিৎসা সহায়তার জন্য আবেদন করেও কোনো ফল হয়নি। এতে অসহনীয় দুরবস্থায় দিন কাটছে। ২০১৭ সালের ১৩ জুন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পান তিনি।
কথা হয় বীরাঙ্গনা রেজিয়া বেগম কমলার সাথে। ১৯৭১ সালে তার উপর চলা পাক হানাদার বাহিনীর নির্মম নির্যাতন আর জীবন যুদ্ধের নানা দিক তুলে ধরে বলেন, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। আকাশে বাতাসে অজানা আতঙ্ক সবার মনে। আর যাদের ঘরে যুবতী মেয়ে রয়েছে তারা পাকিস্তানীদের ভয়ে দুঃশ্চিন্তায় ছিলো। বাবা আমাকে তড়িঘড়ি করে বিয়ে দেন আসলামের সঙ্গে। বিয়ের দু’দিনের মাথায় স্বামী-শশুর চলে যায় ভারতে। এ সময়ে শাশুড়ী পাক বাহিনীর ভয়ে আমাকে বাবার বাড়িতে রাখার জন্য যাওয়ার পথে রাজাকার আসলাম বলেন আমি পৌঁছে দিচ্ছি। পরে কৌশলে নিয়ে যায় পাক বাহিনীর ক্যাম্পে। সেখানে আমার উপর চলতে থাকে নারকীয় নির্যাতন। একসময় রাজাকারের সাথে সখ্যতা গড়ে কৌশলে পালিয়ে যাই। পরে ময়মনসিংহ হালুয়াঘাটের কড়ইতলী সীমান্তে কিছু মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে মিলিত হয়ে সহযোগিতা শুরু করি। অন্তত ১৬ সদস্যের মুক্তিযোদ্ধার টিমে আমি ছাড়াও আরও তিন নারী সহযোগিতা করতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিজ এলাকায় যাওয়া হয়নি।
বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধা সংসদের ময়মনসিংহ জেলা কমান্ডার বীর মুক্তিযুদ্ধা আলহাজ্ব মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, বীরাঙ্গনার চিকিৎসা ও স্থায়ী আবাসের ব্যবস্থা দ্রুত করা প্রয়োজন। বীরাঙ্গনা ও মুক্তিযুদ্ধাদের মাঝে এখনো অনেকে অসহায় অবস্থায় জীবনযাপন করছে। কেউ কেউ পঙ্গু অবস্থায় রয়েছে। তাদের সরকারিভাবে সহায়তা করা প্রয়োজন। বীরাঙ্গনাদের সম্মানসূচক আচরণ করার জন্য সামাজিক দৃষ্টিকোণ পরিবর্তন করতে হবে। বীরাঙ্গনা রেজিয়া বেগম কমলার চিকিৎসা ও স্থায়ী আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহের ডিসি মো. মিজানুর রহমান বলেন, বীরাঙ্গনা কমলার থাকার জন্য ব্যবস্থা করা হবে। তার যাবতীয় তথ্য ইতিমধ্যে চাওয়া হয়েছে। চিকিৎসার বিষয়টিও দেখা হবে বলে জানান তিনি।