বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুম-গুপ্তহত্যার বিষয়ে বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। গত বছরের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। গত বছরে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) সংবাদ সম্মেলনে পর্যবেক্ষণের তথ্য প্রকাশ করেন আসকের উপ-পরিচালক নীনা গোস্বামী।
তিনি বলেন, ২০১৮ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বিভিন্ন বাহিনীর সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ এবং তাদের হেফাজতে মোট ৪৬৬ নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৪ মে থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর মাদকবিরোধী অভিযানে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন ২৯২ জন। ২০১৭ সালে বন্দুকযুদ্ধে ১৬২ জন নিহত হয়েছেন বলে জানান তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে আসকের উপ-পরিচালক নীনা গোস্বামী বলেন, ২০১৮ সালে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও নিখোঁজ হয়েছেন ৩৪ জন। এর মধ্যে ১৯ জনের সন্ধান পাওয়া গেছে, যাদের বেশির ভাগই বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার রয়েছেন।
গত বছর জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে অন্তত ৪৭০টি সহিংসতার ঘটনায় ৩৪ জন নিহত হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। এসব সহিংসতায় নিহতদের মধ্যে ১৯ জন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক। এর বাইরে বিএনপির চারজন ও একজন আনসার সদস্যের পাশাপাশি ১০ জন সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছেন।
গত বছর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ও অন্যান্য দলের এবং নিজেদের মধ্যে কোন্দলের জেরে ৭০১টি রাজনৈতিক সঙ্ঘাতের ঘটনায় ৬৭ জন নিহত এবং সাত হাজার ২৮৭ জন আহত হয়েছেন বলে আসকের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে। এতে আরো বলা হয়েছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের কয়েকটি স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে।
২০১৮ সালে নারী নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গত বছর সারা দেশে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৩২ জন। তাদের মধ্যে ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৬৩ জন আর ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন সাতজন। নির্বাচনের রাতে নোয়াখালীর সুবর্ণচরের এক গৃহবধূকে দলবেঁধে ধর্ষণের বিষয়টিও এসেছে আসকের প্রতিবেদনে।
সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক আবু আহমেদ ফয়জুল কবির বলেন, গত বছর গৃহকর্মী নির্যাতন ও এসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে ৫৪টি আর যৌতুকের কারণে এবং পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৯৫ জন নারী। এ ছাড়া গত বছর ২০৭ জন সংবাদিক আইনশৃঙ্খলাবাহিনী, প্রভাবশালী ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি, সন্ত্রাসী, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের দ্বারা শারীরিক নির্যাতন ও হামলার শিকার হয়েছেন। এ ছাড়া হত্যার শিকার হয়েছেন তিনজন সাংবাদিক।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এক হাজার ১১টি শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে ২০১৮ সালে। এদের মধ্যে ৪৪৪টি শিশু যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের শিকার হয়। গত বছর গায়েবি মামলার বিষয়টিও আসকের প্রতিবেদনে উঠে আসে। একটি পত্রিকার বরাত দিয়ে এতে বলা হয়, ২০১৮ সালে শুধু সেপ্টেম্বর মাসেই ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় পুলিশ বাদি হয়ে ৫৭৮টি নাশকতার মামলা করেছে। এসব মামলার তথ্য অনুযায়ী পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে ৯০ বার। অথচ বাস্তবে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি বলে ওই পত্রিকার বরাত দিয়ে বলা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের চেয়ে ২০১৮ সালে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় শ্রমিক নিহতের সংখ্যা বেড়েছে। বেসরকারি সংগঠন সেইফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী গেল বছর কর্মক্ষেত্রে মোট ৪৮৪টি দুর্ঘটনায় ৫৯২ জন শ্রমিক মারা গেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্যে আসকের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের তদন্তে কমিশন গঠনের দাবি জানান। তিনি বলেন, একটি স্বাধীন দেশে এসব হত্যাকাণ্ড হোক তা আমরা চাই না। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এ বছর অনেক বেশি হয়েছে। নারী ও শিশু ধর্ষণ-নির্যাতনও অনেক বেড়েছে।