তখন বয়স কত হবে ১৪ বা ১৫। কৈশোর না তারুণ্য কোনটা বলবো জানি না । ১৯৮৬ বিশ্বকাপ ফুটবল । টান টান উত্তেজনা । আমি বরাবরই ব্রাজিলের সাপোর্টার । কারণ ফুটবলের রাজা পেলে তখন আমাদের হৃদয় জুড়ে । সবাই বলতো কালোমানিক । না তার খেলা সরাসরি দেখার সৌভাগ্য হয়নি । তবে পুরাতন মানুষদের কাছ থেকে এই নামটা শুনতে শুনতে ব্রাজিলের ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম । পেলে সব সময় বলতেন “সফলতা বিফলতা নয় মানুষ হওয়াটাই আসল কথা। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো অন্যের অনুকরণ না করে নিজে নিজে স্বকীয়তা অর্জন করা ।” পেলে যে সময় খেলতেন সে সময় ফুটবল খেলার ধরণটা আজকের মতো ছিলো না । তবে ১৯৮৬ এর বিশ্বকাপে দেখলাম ফুটবল খেলাকে বদলে দেওয়ার মতো একজন জাদুকরকে । যে ফুটবল খেলে না বরং ফুটবলকে খেলায় । কি অসাধারণ নিয়ন্ত্রণ তার ফুটবলের উপর । পেলের খেলার কৌশল থেকে পুরোপুরি ভিন্ন । পেলের পরামর্শটা হয়তো সে কিংবদন্তি মানুষটা মনের ভিতরে শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছিলেন । ইংল্যান্ডের সাথে খেলাটা দেখে তখন চোখ তো কপালে উঠে গেছে । মনে হচ্ছিলো যেন ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছি । একেবারে মাঝ মাঠ থেকে সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে ফুটবলের জাদুকরের কি এক দুর্ভেদ্য আকর্ষণে বলটা প্রতিপক্ষের জালে! আর হাতের ছোঁয়ায় গোলটা যেন সে দুরন্ত মানুষটা দেননি ঈশ্বর তার অদৃশ্য শক্তি মানুষটার মধ্যে বিরাজিত করে বলটাকে লক্ষভেদের রহস্যের জালে পৌঁছে দিলেন । ভাবতেই গায়ের লোমগুলো খাড়া হয়ে উঠে । ব্রাজিল প্রিয় দল কিন্তু প্রিয় খেলোয়াড় হয়ে উঠলেন সেই মানুষটা । দিয়াগো ম্যারাডোনা । স্বপ্ন যখন স্বপ্নের চেয়েও বিস্ময়কর হয়ে উঠছিলো তখন অদৃশ্য শক্তি দুরন্ত ম্যারাডোনাকে মহানায়ক থেকে মাটিতে নামিয়ে আনলো । সবাই বললো লোকটা আর ভালো নেই । সে খারাপ হয়ে গেছে । মাদকের নেশা তাকে গ্রাস করেছে । আলো থেকে অন্ধকারে তার যাত্রা শুরু হয়েছে । আমি বিষয়টাকে এভাবে কখনো মেনে নিতে পারিনি । বরং আমার কাছে মনে হয়েছে একটা এগিয়ে যাওয়া মানুষকে পা ধরে টেনে নামিয়েছে তথাকথিত মহামানবেরা । কারণ তারা ঈর্ষান্বিত হয়েছে । হয়তো ভিতরে অনেক ষড়যন্ত্র তার বিরুদ্ধে হয়েছে । আলো দেওয়া তারাকে অন্ধকার আকাশ থেকে নামিয়ে একটা হার না মানা প্রতিভাকে হিংসার আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে । যেমন আমাদের মতো সততা আর নৈতিকতা নিয়ে দাঁড়ানো মানুষদের মিথ্যা অপবাদ নিতে হচ্ছে । কারো কারো স্বার্থের ও হিংসার বলি হতে হচ্ছে । প্রতিদিন আগুনে পুড়ে পুড়ে চেনা মুখোশের মুখগুলো দেখতে হচ্ছে । কিন্তু কিছুই তো বলা যাচ্ছে না । কারণ অদ্ভুত এক আঁধার নেমে এসেছে এ পৃথিবীতে ।
বছর তিনেক আগে এক সাক্ষাৎকারে ম্যারাডোনা বলেছিলেন, ‘আমি যখন মাদক নিতাম, তখন আমি জীবনে এক পা পিছিয়ে থাকতাম। অথচ ফুটবলার হিসেবে আমার এক পা এগিয়ে থাকার কথা ছিল। ওই দুঃসহ জীবন বদলে যায় আমার মেয়েদের কারণে। অনেকেই অনেক কথা বলতে পারে। কিন্তু আমি ১৫ বছর আগে ওই অসুস্থতা (নেশার জীবন) কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। তাই এখন কেউ কেউ আমার বিরুদ্ধে মাদক ছেড়ে ডোপিং নিয়ে কথা বলেন।’ এ নেশা হয়তো তিনি ধরেননি, ষড়যন্ত্রকারীরা ধরিয়েছিল । হয়তো যা সত্য সেটি মিথ্যে ছিলন আর যা মিথ্যে তা সত্য ছিল । মানুষ বেঁচে থাকলে তাকে পঁচানো হয় আর মরে গেলে পৃথিবী যা হারায় তা আর ফিরে পায় না । না ফেরার দেশে ভালো থেকো ম্যারাডোনা । বুয়েনস আয়ার্সের বস্তি থেকে উঠে আসা অন্য আরেকটি কিশোরকে কি আর আমরা কখনো পাবো? যার একটা ফুটবল তখন ছিলো না কিন্তু ফুটবলের প্রতি প্রাণের ব্যাকুলতা ছিল। ম্যারাডোনারা বার বার জন্মে না, কাল ভদ্রে একবার জন্মে । কিন্তু আমরা তাদের বেঁচে থাকতে মূল্য দিতে পারি না । হয়তো আমরা সবাই এখনো তাই মুখোশ মানুষ