ময়মনসিংহ জেলার রেকর্ডরুমের গোপনীয় শাখা, উপজেলা ভূমি অফিসের রেকর্ডরুম, ইউনিয়ন ভূমি সহকারীর অফিসে সংরক্ষিত থাকা মূল খতিয়ান বইয়ের পাতা ছিড়ে ভুয়া পাতা সংযোজন করতো একটি চক্র। দীর্ঘদিন ধরে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে নামজারি করে সেই জমি বিক্রি করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিল চক্রটি।
মঙ্গলবার (২৪ নভেম্বর) সকালে এ চক্রটির ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলা ভূমি অফিসে জাল কাগজপত্র দেয়ার প্রমাণ পেয়ে তাদের আটক করেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) তরিকুল ইসলাম তুষার। পরে পুলিশের কাছে তাদের সোপর্দ করেন।
আটক জালিয়াত চক্রের সদস্যরা হলেন- উপজেলা ধানীখোলা ইউনিয়নের উজান ভাটিপাড়া গ্রামের শফিকুল ইসলাম, ইব্রাহিম খলিল, শরিফ উদ্দিন, একই গ্রামের শহিদুল ইসলামের স্ত্রী ফাতেমা খাতুন ও শফিকুল ইসলামের স্ত্রী নাছিমা বেগম।
উপজেলা ভূমি অফিস সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার (২৪ নভেম্বর) উপজেলা ভূমি অফিসে ছিল একটি বিরোধপূর্ণ জমির নামজারি জমা খারিজের শুনানির দিন। জালিয়াত চক্রটি ধানীখোলা উচ্চ বিদ্যালয় ও ধানীখোলা মিলন সমাজের মাঠের দুই একর ৪৮ শতাংশ জমি খারিজের জন্য ২০১৭ সালে ত্রিশাল ভূমি অফিসে আবেদন করে। ভূমি অফিসের সংরক্ষিত রেকর্ড কপিতে তাদের মালিকানা প্রমাণ না হওয়ায় খারিজ আবেদনটি বাতিল করে দেয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
এরপর থেকে প্রতারক চক্রটি মূল ভলিয়মের কাগজ পাল্টানোর জন্য অফিসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আশ্রয় নেয়। গত তিন বছরে চক্রটি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়নের তিন অফিসের ভলিয়মের মূল কাগজ পাল্টাতে সক্ষম হলে চলতি বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর পুনরায় দুই একর ৪৮ শতাংশ জমির নামজারি জমা খারিজের আবেদন করেন। পরে ত্রিশাল উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সরজমিনে তাদের দখলে জমি না থাকায় খারিজ আবেদনটি বাতিল করে দেন। এতেও হাল ছাড়েননি প্রতারক চক্রটি।
আরও জানা গেছে, অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে দিয়ে খারিজ করার সুপারিশ করলে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নথিগুলো আবার পর্যালোচনা করতে বসেন। তখন অফিসে সংরক্ষিত মূল ভলিয়মের পাতা ছেড়া দেখে বিষয়টি প্রথমে সন্দেহ হয়। পরে তিনি তার অফিসের রেকর্ডরুমের উল্লেখিত জমির এক নম্বর বইয়ের পাতা ছেড়া ও ২২ নম্বর বইয়ে নতুন একটি পাতা সংযোজন দেখতে পান। বিষয়টি যাচাইয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট ধানীখোলা ইউনিয়ন অফিসে সংরক্ষিত কপি যাচাই করলে একই জালিয়াতি পাওয়া যায়।
এ সময় দু’জায়গায় অনিয়ম দেখা দিলে সহকারী কমিশনার তরিকুল ইসলাম ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসকের এসএ শাখায় সংরক্ষিত কপি যাচাই করে একই রকম পাতা ছেড়া অবস্থায় পান। নিজস্ব ওয়েবসাইটসহ ভলিয়ম ঘেটে তিনি জানতে পারেন, ভলিয়মের এক নম্বর বই থেকে ধানীখোলা মিলন সমাজ ক্লাবের নামে লিপিবদ্ধ জমির পরিমানের পাতাটি উধাওয়ের পাশাপাশি ২২ নম্বর বইয়ের নতুন পাতা সংযোজন করে ধানীখোলা মিলন সমাজের দাগের জমি প্রতারক চক্রের নামে উল্লেখ করে নতুন একটি পাতা সংযোজন করা হয়েছে।
পরে বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানালে মঙ্গলবার উপজেলা ভূমি অফিসে নামজারি জমা খারিজের শুনানির দিন ধার্য করেন এসিল্যান্ড। এ সময় প্রতারক চক্র উপস্থিত হলে স্থানীয় এলাকাবাসী নিজেদের স্কুল মাঠের জমি রক্ষা করতে জড়ো হয় ভূমি অফিসে।
জিজ্ঞাসাবাদে তাদের প্রতারনার কৌশল ও অফিসের লোকজনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়ায় তাদের আটক করে ত্রিশাল থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ ঘটনায় উপজেলার ধানীখোলা ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মানিক কুমার সরকার বাদী হয়ে ত্রিশাল থানায় প্রতারণার মামলা দায়ের করেছেন।
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) তরিকুল ইসলাম তুষার বলেন, প্রতারক চক্রটি বিভিন্ন জালিয়াতির মাধ্যমে জমি হাতিয়ে নিচ্ছিল। এ জন্য এ চক্রটি এক শ্রেণির অসাধু কর্মচারীর সহায়তায় ইউনিয়ন ভূমি অফিস, উপজেলা ভূমি অফিস ও জেলা রেকর্ডরুমের মূল ভলিয়মের বই থেকে পাতা ছেঁড়া ও নকল কপি সংযোজনের কাজটি করেছেন। এ ব্যাপারে অসাধু কর্মকর্তাদের খুঁজে বের করতে জেলা প্রশাসন কার্যালয় বরাবর প্রতিবেদন পাঠিয়েছি।
এ বিষয়ে ত্রিশাল থানার ওসি মাহমুদুল ইসলাম ময়মনসিংহ লাইভকে বলেন, এ ঘটনায় ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মামলা দায়েরের পর আটককৃত পাঁচজনকে থানায় হস্তান্তর করে। আটককৃতদের আজ বুধবার আদালতে পাঠানো হবে বলেও জানান তিনি।