দূষণের নগরীর তালিকায় ঢাকা ময়মনসিংহের ত্রিশাল। রাজধানীর চেয়ে অনেক বেশি সবুজ থাকার পরও ত্রিশাল কেন দূষণের শীর্ষে অবস্থান করছে তা নিয়ে কৌতুহল বাড়ছেই। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের তথ্যানুযায়ী এই দূষণের মাত্রা ‘অস্বাস্থ্যকর’ অবস্থায় পৌঁছেছে। শীত শুরুর আগেই এই মাত্রা চরম আকার ধারণ করেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানী ঢাকার চেয়ে ত্রিশালে দূষণ বাড়ার উপযোগী উপাদান দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে ইটভাটা, বর্জ্য পোড়ানো, কলকারখানা ও গাড়ির কালো ধোঁয়া এই দূষণের জন্য দায়ী। ত্রিশালে চলতি মাসের শুরু থেকেই চালু হয়েছে ইটভাটা। কলকারখানাগুলোর বেশির ভাগেরই নেই প্রয়োজনীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। এ ছাড়া রাজধানী ঢাকার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ত্রিশালে তৈরি হচ্ছে বাড়ি, কমছে গাছপালা ও খোলা জায়গা। ফলে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবছর বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বে প্রায় ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। দূষিত বায়ু ফুসফুসে ঢুকে ক্রমশ দুর্বল করে দেয়, যা শ্বাসতন্ত্রের সমস্যাজনিত মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করে। বায়ুদূষণের সঙ্গে এবার যোগ হয়েছে করোনাভাইরাসের মহামারি। এ ভাইরাসের প্রধান লক্ষ্যই ফুসফুস। এ কারণে এবার কাশি, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগ বাড়ারও আশঙ্কা বেশি।
ত্রিশালে প্রায় ৮০টি ইটভাটা রয়েছে। তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন ও নবায়নকৃত লাইসেন্স রয়েছে এমন ইটভাটার সংখ্যা ১০টির বেশি হবে না। ভাটাগুলোয় কয়লার পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে কাঠ। ফলে আশপাশের পরিবেশ আচ্ছাদিত হচ্ছে কালো ধোঁয়ায়। ফলে অনেকেই নিজেদের বসতবাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বালিপাড়া ইউনিয়নের বিয়ারা গ্রামে পাশাপাশি ১০-১২টি ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় যেন আকাশ ছেয়ে গেছে। একই অবস্থা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের রাগামারা মোড় থেকে রামপুর সংযোগ সড়ক পর্যন্ত। এ ছাড়া আমিরাবাড়ী, হরিরামপুর ও মঠবাড়ী ইউনিয়নে গড়ে ওঠা শিল্প-কলকারখানার ধোঁয়ায়ও আচ্ছন্ন হচ্ছে পরিবেশ। বেশির ভাগ কারখানাই তাদের বর্জ্য পুড়িয়ে পরিবেশ দূষিত করছে। ত্রিশাল উপজেলায় শতাধিক ক্রাশার মিল ধুলাবালি উড়িয়ে শুঁটকি, মিটবোন, ভুট্টা, কুঁড়া গুঁড়ো করে মাছের খাবার উৎপাদন করে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে প্রতিদিন রাস্তার কাজের জন্য পাথর ভাঙা হয়।
আইকিউএয়ারের গত বুধবার বিকেল ৫টার তথ্যানুযায়ী, সাভারের বায়ুমান সূচক (ইউএস একিউআই) ছিল ১৬৭, আর ত্রিশালে ১৬২। অন্যদিকে মানিকগঞ্জে ছিল ১৫৩ আর ঢাকায় ১৩৯। রাতে সব কিছু নীরব থাকার পরও দূষণের মাত্রা বেড়ে যায়। বুধবার রাত ৮টায় বায়ুমান সূচক ছিল ত্রিশালে ২৩৪, ঢাকায় ১৯০ ও সাভারে ১৮০। গত শুক্রবার বিকেল ৪টায় দেখা যায়, সাভারে ১৯০, মানিকগঞ্জে ১৮৫, ঢাকায় ১৮১ ও ত্রিশালে ১৬৫। গতকাল শনিবার বিকেল ৫টায় দেখা যায়, ঢাকায় ২৩৩, সাভারে ২৩০, মানিকগঞ্জে ১৬৯ ও ত্রিশালে ১৬৮। ইউএস একিউআই র্যাংকিং অনুযায়ী গতকাল বায়ুদূষণের নগরীর তালিকায় বিশ্বে ঢাকার অবস্থান ছিল তৃতীয়, বায়ুমান সূচক ১৯৭। এ সময় বিশ্বের সর্বোচ্চ দূষণের নগরী ছিল কিরগিজস্তানের রাজধানী বিশকেক, বায়ুমান সূচক ২৪১। কলকাতায় ছিল ২০৩, কুয়েত সিটিতে ১৭৭ ও মুম্বাইয়ে ছিল ১৬৪।
এদিকে ত্রিশাল এলাকার বাতাস চলতি সপ্তাহজুড়েই ছিল অস্বাস্থ্যকর। বাংলাদেশে বায়ুদূষণের উৎস নিয়ে গত বছরের মার্চে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংক। তাতে দেখা যায়, দেশে বায়ুদূষণের প্রধান তিনটি উৎস হচ্ছে ইটভাটা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া ও নির্মাণকাজ। আট বছর ধরে এই তিন উৎস ক্রমেই বাড়ছে। ২০১৩ সালে দেশে চার হাজার ৯৫৯টি ইটভাটা ছিল। ২০১৮ সালে বেড়ে দাঁড়ায় সাত হাজার ৯০২টি। এর মধ্যে দুই হাজার ৪৮৭টি ইটভাটা ঢাকা বিভাগেই।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, শুষ্ক মৌসুমে যে নির্মাণকাজগুলো হয়, তাতে সকাল ও বিকেলে পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু ত্রিশালের বেশির ভাগ এলাকায়ই তা মানা হচ্ছে না।