আঁকা-বাঁকা মেঠো পথ, মধুমতি-ধানসিঁড়ি নদীর তীরে, নৈস্বর্গীয় গ্রাম গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া। ইরাকি দরকেশ শেখ আওয়াল। তাঁর ষষ্ঠ উত্তরসুরী শেখ লুৎফর রহমান। যাঁর ঔরস্যের সন্তান হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনা। জন্ম ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২৮ সেপ্টেম্বর। টুঙ্গিপাড়ার দাদার প্রতিষ্ঠিত টিনসেড ঘরে। মা ফজিলাতুননেছা রেণু। যাঁকে মা বাবা আদর করে ডাকতেন ‘হাসু’। বাবা মুজিব, কলমে এঁকেছেন ‘হাছিনা’। এই হাসুই আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যাঁর চিন্তা চেতনায় উজ্জীবিত দেশপ্রেম; প্রয়াত পিতার স্বপ্ন-সাধ পূরনে যিনি দৃঢ় অঙ্গীকারাবদ্ধ। দিবারাত নিরন্তর পরিশ্রম, ধ্যান ধারনায় শুধু মানবের কল্যান। সেই ফজর থেকে এশা পর্যন্ত রুটিন ওয়ার্ক। তাহাজ্জুদ নামাজ, কুরআন পাঠ, খাওয়া নাওয়া বাদে যার বিশ্রাম-ঘুম মাত্র কয়েক ঘন্টা। ধীর-স্থির, শান্ত মেজাজের শেখ হাসিনা তখনই অগ্নিমূর্ত, যখন কোন অন্যায়, অনাচার, অবিচার, দুর্নীতি, সন্ত্রাস তাঁর নজরে আসে। তিনি চিন্তা করেন মুক্তি পাগল জনতার অর্থনৈতিক মুক্তির। দেশের সকল ক্রান্তিলগ্নে দেশদরদি উন্নয়নের কান্ডারি শেখ হাসিনা বার বার ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন। বহুবার মৃত্যুর হাত থেকে তিনি রক্ষা পেয়েছেন অলৌকিক ভাবে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট তাঁর স্বপরিবারকে নির্মমভাবে হত্যা করে একদল উচ্চভিলাসি খুনিরা। যেদিন তাঁর স্বপরিবার ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকান্ডের শিকার হন, তার পনেরো দিন আগে অর্থাৎ ১ আগস্ট ছোট বোন রেহানাকে নিয়ে স্বামীর সঙ্গে জার্মানী যান। পরিবারের সবাইকে হারিয়ে শেখ হাসিনা ও তাঁর বোন শেখ রেহানা বুকে শোকের পাথর বেঁধে দীর্ঘ ছ’টি বছর কাঁটিয়েছে বিদেশের মাটিতে। ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মে, তিনি ফিরে আসেন তাঁর জন্মভূমি বাবার স্বপ্নের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটিতে। দেশের মাটি আছে, আছে বাড়ি, নেই তাঁর পরিবার-পরিজন। পিতা-মাতা, স্বজনহারা শেখ হাসিনার সম্বল একমাত্র আপামর জনতা। দেশে ফেরার পর মানিক মিয়া অ্যাভিন্যুর বিশাল জনসভায় স্বজনদের আত্মার উদ্দেশ্যে তিনি হো হো করে কেঁদেছিলেন। ওই দিনের শোকের কান্না লাখো জনতার মাঝে শক্তির সঞ্চার ঘটায়। যে শক্তি এখন স্রোতের মোহনায় পল্লবিত। এই শক্তির দিন দিন সংস্কার হচ্ছে শেখ হাসিনার উন্নয়ন কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে। তাঁর শত সহ¯্র উক্তির মধ্যে অন্যতম উক্তি, “আমার চাওয়া-পাওর্য়া কিছুই নেই এবং হারাবারও কিছু নেই। আমি মানুষের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছি। আমি মানুষের কল্যাণ চাই।” সেদিনের এতিম শেখ হাসিনা আজ দেশের প্রাণ। যাঁর কথা এবং কাজের বন্ধন নিবিড়। সকল দুর্যোগ প্রতিকুল পরিবেশে যিনি অনঢ় এক লৌহমানব। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর অমর বানী, “এই স্বাধীন দেশের মানুষ যখন পেট ভরে খেতে পাবে, পাবে মর্যাদাপুর্ণ জীবন তখনই শুধু এই লাখো শহীদদের আত্মা তৃপ্তি পাবে।” বঙ্গবন্ধুর এই আবেদন বাস্তবায়নে শেখ হাসিনা দেশটাকে নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিনত করার দ্বারপ্রান্তে দাঁড় করিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নসাধ গুড়িয়ে দেবার ষড়যন্ত্র বহু পুরোনো, তা থেকে এই দেশ রক্ষা করতে শেখ হাসিনাকে ১৯৮১ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত বাংলার পথে-ঘাটে ছুটতে হয়েছে। স্বদেশে ফেরার পর দীর্ঘ তেইশটি বছর তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছে। ১৯৯৬ সালে তিনি প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন। ওই সময় তাঁর সরকার দেশের সুশাসন নিশ্চিত করায় ব্রত হন। ‘পার্বত্য শান্তি চুক্তি’ এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকার্য শুরু করেন। দীর্ঘ দিনের লালিত স্বাধীনতা বিরোধীরা ঘরে-বাইরে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। শেখ হাসিনা দমেনি। মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার নিশ্চিত করতে নিরন্তর সংগ্রাম অব্যাহত রাখে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে আপামর জনতা তাঁকে ও তাঁর দলকে বিজয়ী করেন। সে থেকেই তিনি টানা তৃতীয় বারের মত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছরের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, এখন বিশ্বে উন্নয়নের মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। শিশু সুরক্ষা নীতিমালা ও শিশুর অধিকার নিশ্চিত, শিক্ষার্থীদের মাঝে বৃত্তি প্রদান, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, বছরের শুরুতে বিনামূল্যে বই বিতরণ, ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেবা, সবুজ শ্যামলিমা পরিপুর্ণ দেশ গঠনে বৃক্ষরোপণ, রাস্তাঘাটসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর উন্নয়ন গতি চলমান। যাঁর আমলে গ্রাম অঞ্চলের মানুষরা কর্মব্যস্ত। কারো কোন অভাব নেই; শিক্ষা স্বাস্থ্য, কৃষি, বাসস্থান, নিরাপত্তা নিশ্চিতে তিনি ও তাঁর সরকার সিদ্ধহস্ত। ২০০৮ এর নির্বাচনের পর তাঁর সরকারের আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বড় সাফল্য ‘সমুদ্রবিজয়’। এ বিজয়ে আন্তর্জাতিক মামলায় বাংলাদেশ-ভারত ও মিয়ানমারের কাছ থেকে বঙ্গোপসাগরের বিপুল পরিমান জল সীমানা লাভ করা। প্রাপ্ত এই জল সীমানার ইকুয়ালভ্যালু বর্তমান বাংলাদেশের মোট আয়তন। ‘ছিটমহল’ ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত জটিলতার ৬৮ বছরের ইতিহাস। এর মধ্যে ৫১ টি ছিটমহল ছিল বাংলাদেশের, যার অবস্থান ছিল ভারতের অভ্যন্তরে। অপরদিকে ১১১ টি ছিটমহল ছিল ভারতের, যার অবস্থান ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। উভয় ছিটমহলের ভূমির পরিমান ১৭,০০০ একর। লোক সংখ্যা দুই প্রান্তের ৫৫,০০০। ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির বাস্তবায়ন ঘটে শেখ হাসিনার হাতে, ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের ৩১ জুলাই দিবাগত রাতে। শেখ হাসিনা সরকারের এই কুটনৈতিক সাফল্য ইতিহাসের মাইলফলক। তিনি মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে মানবতার ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন। সাহসের দ্রষ্টা, আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান শেখ হাসিনা কোভিড-১৯ কালীন সারা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছেন, অন্ধকারে ডুবে নয়, সজাগ, সতর্ক এবং সাবধানতার মধ্য দিয়ে সকল কর্মকান্ড সচল করেই অর্থনৈতিক মুক্তির চাকা ঘুরানো সম্ভব। কালের সাহসী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র শৈশব-কৈশোর কাটিয়েছেন নদীমাতৃক গ্রামের বাড়িতে। ওখানেই পড়াশোনা শুরু। ১৯৫৪ সালে মা ফজিলাতুননেছা রেণুর সাথে ঢাকায় আসেন। এখানে এসে প্রথম নারীশিক্ষা মন্দির ও আজীমপুর গার্লস স্কুলে পড়াশোনা করেন। উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অর্জন করেন ইডেন কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯৬৮ সালে পরমানু বিজ্ঞানী ড. এম ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর এক ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, যিনি কম্পিউটার সফটওয়্যার বিজ্ঞানী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবৈতনিক তথ্য ও প্রযুক্তি উপদেষ্টা; মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, যিনি একজন প্রখ্যাত অটিজম বিশেষজ্ঞ। যিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্যের উপর বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য এবং লাইসেন্সপ্রাপ্ত মনোবিজ্ঞানী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহজ সরল এবং শিশু মনের পরিচয় মিলে তাঁর কন্যার নাম ‘পুতুল’ থেকে। এতে বুঝতে বাকি থাকেনা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শৈশব-কৈশোরের প্রকৃতির আপন ছিলেন। পুতুল খেলায় যার সময় কেটেছে। ছাত্র অবস্থায় তিনি ছাত্র আন্দোলনের সাথে জড়িত হন। গৃহবধু শেখ হাসিনার সর্বসময় পার হয়েছে রাজনৈতিক পরিবেশে। তিনি এবছর আওয়ামীলীগের ৭৩ তম জন্মদিনে উচ্চারণ করেছেন, “জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশের মানুষের অধিকার রক্ষার লড়াই লড়ছে আওয়ামীলীগ, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের জন্ম, সব জায়গাতেই আওয়ামীলীগের অবদানের কথা সবাই জানেন। ১৭৫৭ সালের শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজের পতনের পরেই বাংলার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল তা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভের মধ্যে পুনরায় উদয় হয়। তারপর থেকে বাংলাদেশের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে, আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকলেই মানুষের মঙ্গল হয়েছে। সামনের দিকে এগিয়ে গিয়েছে বঙ্গবন্ধুর দেশ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু আজ তাঁর দেখানো পথেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। তাঁর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য।” বাবার অনুপ্রেরণা আন্দোলনের স্বপ্নসাধ কল্পনা করেই তাঁর বড় সন্তান সজীব ওয়াজেদ এর নামের সাথে ‘জয়’ যুক্ত হওয়ার কল্পনা উড়িয়ে দেবার নয়। তিনি শৈশবের ‘পুতুল’ খেলার ‘হাসু’ থেকেই সর্বকালের সর্বস্থানেই ‘জয়’র মালায় ভুষিত ৭৩ বছর ২ মাস ৯ দিন বয়স্ক আমাদের আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর ৭৪ তম জন্মদিনে শিশুদের ‘পুতুল’ খেলার আঙিনায় বেজে উঠুক ‘জয়’র বাঁশি।
লেখক: রহিম আব্দুর রহিম
শিক্ষক, গবেষক, নাট্যকার ও শিশু সংগঠক