অন্তিম শয়ানে সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরু

নিজস্ব প্রতিনিধি : ময়মনসিংহের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ‘শিক্ষাগুরু’ বীর মুক্তিযোদ্ধা আমীর আহাম্মদ চৌধুরী রতন সবাইকে কাঁদিয়ে অন্তিম শয়ানে চির বিদায় নিয়েছেন। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সোয়া ১১ টার দিকে রাজধানীর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে অনন্তলোকে যাত্রা করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

ময়মনসিংহ মুকুল ফৌজের প্রতিষ্ঠাতা, মুকুল নিকেতন উচ্চ বিদ্যালয়ের রেক্টর, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের জেলা আহবায়ক, জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা, কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির জেলা সভাপতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ক্রীড়াঙ্গনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব আমীর আহাম্মদ চৌধুরী রতনের মৃত্যুতে ময়মনসিংহবাসি গভীরভাবে শোকাহত। তাঁর অন্তিম শয়ানে সর্বত্রই শোকের ছায়া নেমে এসেছে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর। তিনি স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়েসহ আত্মীয় স্বজন এবং অসংখ্য গ্রণগ্রাহী রেখে গেছেন। সবাই তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করছেন।

শহীদ পরিবারের সন্তান মুক্তিযুদ্ধ ও অসা¤প্রদায়িক চেতনার বাতিঘর অধ্যক্ষ আমীর আহাম্মদ চৌধুরী রতন গত ৬ অক্টোবর বার্ধক্যজনিত নানা শারীরিক সমস্যা নিয়ে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করার পর ৮ অক্টোবর তাঁকে ঢাকায় ল্যাব এইড হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেয়া হয়। সেখানে তাঁর অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ১০ অক্টোবর রাজধানীর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে ভর্তি করা হলে তাঁকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সোয়া ১১ টায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। রাতেই তাঁর মরদেহ উত্তরায় বোনের বাসা হয়ে ময়মনসিংহের বাসায় নিয়ে আসা হয়। সকাল আটটায় মুকুল নিকেতন উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে মরদেহ রাখা হলে সেখানে সর্বস্তরের মানুষ তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।

আজ বাদ জুম্মা নগরীর আঞ্জুমান ঈদগাহ ময়দানে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ইমামতী করেন মাওলানা আব্দুল্লাহ আল মামুন। জানাযার আগে মরহমের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে বক্তব্য রাখেন, গৃহায়ণ ও গণপূূর্ত মন্ত্রী শরীফ আহমেদ এমপি, ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল এমপি, জেলা প্রশাসক মিজানুর রহমান, স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক আফজালুর রহমান বাবু, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আমিনুল হক শামীম, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেশামুল আলম, মরহুমের পুত্র অরূপ চৌধুরী। জানাজা শেষে তাঁর মরদেহ নিজ বাড়ী ফেনীতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জানাযা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

১৯৪৩ সালের ৮ নভেম্বর ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার আনন্দপুর ইউয়িননের হাসানপুর চৌধুরী বাড়িতে আমীর আহমেদ চৌধুরীর জন্ম গ্রহণ করেন। জন্ম ফেনীতে হলেও তাঁর পড়াশুনা, বেড়ে উঠা সবই ময়মনসিংহকে ঘিরেই। ফেনীর আদিনিবাসী রতন চৌধুরীর পরিবার ময়মনসিংহ শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন বাবার চাকরির সুবাদে। তাঁর বেড়ে ওঠা ও পড়াশোনা ময়মনসিংহ শহরেই। শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর ঠিকানা ছিল মহানগরীর মহারাজা রোডেই। ময়মনসিংহের আপামর জনসাধারণের নিকট ‘রতনদা’ বা ‘রতন স্যার’ অভিধায় সমধিক পরিচিত ছিলেন। ছাত্রজীবনে তাঁর স্বপ্ন ছিল ব্যারিস্টার হওয়ার। কিন্তু ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ছিলেন সংগঠক, খেলোয়াড় এবং সৃজনশীল চেতনায় উদ্ভাসিত মানুষ। তাই ব্যারিস্টার না হয়ে তিনি হলেন মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষক। মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, শিক্ষা, সামাজিক, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সংগঠক ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। তার বড় ভাই ফেনী জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মরহুম আজিজ আহমেদ চৌধুরী এবং ছোট ভাই মরহুম বীরমুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অব.) আমীন আহমেদ চৌধুরী বীরবীক্রম। তিনি ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। জেলা ক্রীড়া সংস্থার সিনিয়র সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি ময়মনসিংহ শাখার সাধারণ সম্পাদক, জেলা নাগরিক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, সার্বজনীন বাংলা নববর্ষ উদযাপন কমিটির আহবায়ক, ঘাতক-দালাল নির্ম‚ল কমিটি ময়মনসিংহ শাখার আহŸায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। পহেলা বৈশাখ আর ত্রিশালের কবি নজরুলের জন্মজয়ন্তির সাংস্কৃতিক পর্বের বিশাল কর্মযজ্ঞ তাঁর মতো সুচারুরূপে সমন্বয় করতে অন্য কেউ পারবেন কিনা সন্দেহ রয়েই গেলো। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আনন্দমুখর পরিবেশে শিক্ষায় আলোকিত করতে তিনি গড়ে তুললেন ময়মনসিংহের জনপ্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মুকুল নিকেতন উচ্চ বিদ্যালয়। বলতে গেলে মুকুল নিকেতন আর রতন স্যার ছিলেন এক সুতোয় গাঁথা। ১৯৫৬ সালে সিটি কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৫৮ সালে আনন্দ মোহন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন তিনি। ১৯৬০ সালে একই কলেজ থেকে বিএ পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে মাস্টার্স করেন। ময়মনসিংহ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাপর্ব শেষ করে সফল এই সংগঠক ১৯৫৯ সালে শহরের মহারাজা রোডে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ময়মনসিংহ মুকুল ফৌজ’। ১৯৬৪ সালের আগস্ট মাসে ময়মনসিংহের গৌরীপুর কলেজে অধ্যাপনার মাধ্যমে শুরু হয় তার শিক্ষকতার জীবন। সেখানে তিনি ছিলেন ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত। ওই বছরই সেপ্টেম্বরে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ময়মনসিংহের মুকুুল নিকেতন উচ্চ বিদ্যালয়ে। ২০১৪ সাল থেকে তিনি স্কুলের রেক্টরের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। শিশু-কিশোরদের মেধা বিকাশ ও চরিত্র গঠনের এই প্রতিষ্ঠানটিই ১৯৭০ সালে মুকুল নিকেতন স্কুল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। জরাজীর্ণ একটি ঘরে ৪২ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে মুকুল নিকেতন। বর্তমানে এর শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা ১৭৮ জন। ছাত্রছাত্রী পাঁচ হাজারেরও বেশি। তিন দশকের অধিক সময়ে তিলে তিলে গড়ে তোলা মুকুল নিকেতন এখন জরাজীর্ণ টিনশেডের স্থলে স্থাপিত হয়েছে বহুতল ভবন। সময় অতিবাহিত হয়েছে নিজস্ব গতিতে। তার স্নেহ-শাসনে ধন্য হয়েছে অগণিত মেধাবী। তারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে অধিষ্ঠিত হয়েছেন স্ব-মহিমায়। স্বপ্নবান রতন চৌধুরী তাঁর বর্ণাঢ্য সাফল্যময় জীবনে অর্জন করেছেন অনেক সম্মানজনক পুরস্কার। আলোকিত মানুষ তৈরির প্রবাহমান যে ধারা তিনি প্রতিষ্ঠিত করলেন, তাঁর সুফল পৌঁছে গেছে ঘরে ঘরে, সমাজে এবং রাষ্ট্রে। এই স্রোত অনন্তকালের। অসীম ও অশেষ। ময়মনসিংহের শিক্ষা, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়াঙ্গনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়।

আমীর আহমেদ চৌধুরীর ছেলে অরুপ চৌধুরী বলেন, ‘আমার বাবার জানাজার নামাজ শুক্রবার বাদ জুম্মা আঞ্জুমান ঈদগাহ ময়দানে অনুষ্ঠিত হওয়ার পর পারিবারিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নিজ বাড়ি ফেনীতে কবরস্থ করা হবে। বাবার জন্য সবার কছে দোয়া চাই।’ ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন, আমীর আহমেদ চৌধুরী রতন স্যার ছিলেন মানুষ গড়ার কারিগর। রতনদা শুধু একজন ব্যক্তি নন! তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। তিনি একজন দক্ষ সংগঠক। তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা দিয়ে অনেক আগেই হিমালয় অতিক্রম করেছেন! ময়মনসিংহের ক্রীড়াঙ্গন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জগতে কর্মজীবনের যে বর্ণাঢ্য অতীত তিনি রচনা করে গেছেন, তা কখনো মুছে যাবার নয়। তিনি আজ জীবিত নেই সত্যি! কিন্তু তাঁর সৃষ্টিশীল কর্মের ফসল যতদিন এই দুনিয়াতে থাকবে, ততদিন তিনি বেঁচে থাকবেন ময়মনসিংহের মাটিতে। মুকুুল নিকেতন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শামসুল আলম বলেন, ‘তার যোগ্য নেতৃত্ব, দক্ষতা ও পরিশ্রমের ফলেই ময়মনসিংহের মুকুল নিকেতন আজ দেশসেরা বিদ্যালয়গুলোর একটি।’

বিএফইউজে-বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিযনের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘এই জীবন যে কত জনের স্নেহ ভালবাসায় ভিত্ পেয়েছে! ময়মনসিংহে তুমুল উচ্ছল জীবনে রতন দা, রতন ভাই, রতন স্যারের অবারিত স্নেহে ধন্য হয়েছি । আমির আহমেদ চৌধুরী রতন ভাই ছিলেন মুকুল ফৌজের সংগঠক, পরে গড়ে তুলেন মুকুল নিকেতন। মুক্তিযোদ্ধা আমিন আহমেদ চৌধুরীর বড় ভাই তিনি। ময়মনসিংহে অগ্রসর চিন্তা চেতনার সব উদ্যোগেই তিনি যুক্ত ছিলেন। আমার সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ তারুণ্যে তাঁর স্নেহমাখা স্পর্শ জীবন্ত আজও। আমি যখন বিএফইউজে’র মহাসচিব তখন ময়মনসিংহ সাংবাদিক ইউনিয়নের উদ্যোগে আয়োজিত এফইসি সভায় তিনি এবং তাঁর মুকুল নিকেতন সম্মান জানিয়েছিল সারাদেশের সাংবাদিক নেতাদের। তিনি ও মুকুল নিকেতন সারাদেশের সাংবাদিকদের শ্রদ্ধার পাত্র হন সেদিন। সে আন্তরিকতা ভুলবার নয়। সারাদেশের সাংবাদিক সমাজের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি শ্রদ্ধা। রতন দা, রতন ভাই, রতন স্যার – যে পরিচয়েই হোক ময়মনসিংহ আপনাকে মনে রাখবেই। আপনি বিস্মৃত হবার নন।’

ঐতিহ্যবাহী ময়মনসিংহের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক পরিবর্তনে আমির আহমেদ চৌধুরী রতনের রয়েছে অপরিসীম অবদান। শিক্ষার সাথে সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমে সুস্থ সমাজ বিনির্মাণে তিনি গড়ে তুলেছিলেন মুকুল নিকেতন ও মুকুল ফৌজ। আমরা তার বিদেহী আতœার মাগফেরাত কামনা ও শোক-সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক আমীর আহাম্মদ চৌধুরীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন সংগঠন। আওয়ামী লীগ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, ময়মনসিংহ সেবা নিকেতন, স্বাধীনতা সাহিত্য পরিষদ, ময়মনসিংহ লোক নাট্য সংস্থা ও সম্প্রীতি সংস্থার পক্ষ থেকে তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করে মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিনের নিকট প্রার্থনা করেছেন তিনি যেন তাঁকে বেহেশতবাসী করেন।

Share this post

scroll to top