দেড় বছরেও খোঁজ মেলেনি ময়মনসিংহের লিটনের

১৮ মাসেরও অধিক সময় ধরে নিখোঁজ ছোট ভাই। ছোট ভাইয়ের সন্ধানে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে থানা-পুলিশ ও আদালত চত্বরে ছুটে বেড়াচ্ছেন বড় ভাই মো. লোকমান (২৮)। যদি কেউ প্রাণপ্রিয় ভাইয়ের কোনো সন্ধান দিতে পারে। কিন্তু কারও কাছ থেকে এতটুকু সহায়তা পাচ্ছেন না তিনি।

থানা-পুলিশ-আদালত, কোথাও মিলছে না ভাইকে ফিরিয়ে দেয়ার সামান্যটুকু আশ্বাস। শুধুই ছোটাছুটি, আজ কোর্ট চত্বর, কাল থানা-পুলিশ। মামলা হলেও তদন্তের কোনো অগ্রগতি নেই, আসামিরা রিমান্ডে ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য’ দিলেও এখন তারা জামিনে মুক্ত; তদন্ত কর্মকর্তাও ফোন ধরেন না, আইনজীবীও দিতে পারেন না কোনো আশ্বাস। তবুও লোকমানের ছোটাছুটি, ছোট ভাইকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। কারণ, বৃদ্ধা মা তার ছোট সন্তানের অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে আছেন।

কারও কাছ থেকে ভাইকে ফিরে পাওয়ার আশ্বাস না পেয়ে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ চত্বরে উপস্থিত সংবাদকর্মীদের শরণাপন্ন হন গার্মেন্টকর্মী মো. লোকমান ও তার বড় ভাই ভ্যানচালক মো. আমিনুল (৩০)। প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাদের আকুল আবেদন, যেভাবেই হোক তাদের ছোট ভাই লিটনকে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেয়া হোক।

ছোট ভাইয়ের নিখোঁজ হওয়া প্রসঙ্গে বড় ভাই লোকমান জানান, রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অবস্থিত সোর্স অ্যান্ড ডিজাইন গার্মেন্টসে মালামাল লোড-আনলোডের কাজ করতেন ছোট ভাই মো. লিটন (২২)। একই গার্মেন্টসে লেবার সর্দার হিসেবে কাজ করতেন ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ থানার বৃপাচাশি গ্রামের মো. সুরুজ মিয়া (৫০)। বাড়ি একই জেলায় হওয়ায় দুজনের মধ্যে ভালো একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সম্পর্কের জেরে লিটন তার মাসিক আয়ের টাকা সুরুজ মিয়ার কাছে জমা রাখতে। এভাবে জমা করা অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় পাঁচ লাখে। একপর্যায়ে লিটন তার গ্রামের বাড়ি বিল্ডিং (দালান বাড়ি) করবেন বলে সুরুজ মিয়ার কাছে সমুদয় অর্থ ফেরত চান। কিন্তু সুরুজ মিয়া সেই অর্থ দিতে টালবাহানা করেন। সম্পর্কের অবনতি হয় তাদের। ২০১৯ সালের ৯ মার্চ বিকাল ৫টায় টাকা দেয়ার কথা বলে লিটনকে ময়মনসিংহে ডেকে পাঠান সুরুজ মিয়া। ‘রাতে নয়, পরদিন সকালে যাবেন’ বললেও পিড়াপিড়ি করতে থাকেন তিনি। অবশেষে রাতেই ময়মনসিংহের উদ্দেশে রওনা দেন লিটন। এরপর থেকে খোঁজ নেই তার ভাইয়ের। পরবর্তীতে ভাইয়ের সন্ধানে মামলা করেন তিনি। রাজধানীর তেজগাঁও থানায় দায়ের করা মামলা নং-২, ১ মে ২০১৯ ইং।

মামলার আসামিরা হলেন- ১. মো. সুরুজ মিয়া (৫০), পিতা- মৃত ফজর আলী, মাতা- মৃত সুন্দরী, সাং- বৃপাচাশি, থানা- ঈশ্বরগঞ্জ, জেলা- ময়মনসিং; ২. মোছা. নাজমা খাতুন (৩৮), স্বামী- মো. সুরুজ মিয়া (১ নং আসামি); ৩. মো. আলাল (৪২); ৪. দুলাল (৫৫, ১ নং আসামির ভাই); ৫. মো. রসুল মিয়া (২৫); ৬. মো. বিল্লাল হোসেন (২১) ও ১নং আসামির ছেলে।

মামলার তদন্তে নেমে তদন্ত কর্মকর্তারা ভিকটিমের মোবাইল কললিস্টের সূত্র ধরে প্রধান আসামি মো. সুরুজ মিয়ার সঙ্গে সর্বশেষ কথোপকথনের সন্ধান পান। তাকেসহ অন্য আসামিদের গ্রেফতার করে রিমান্ডেও নেয়া হয়। রিমান্ডে তারা ‘গুরুত্বপূর্ণ’ তথ্য দিলেও এখন পর্যন্ত ভিকটিম লিটনের কোনো সন্ধান দিতে পারেননি তদন্ত কর্মকর্তা। এর মধ্যে পরিবর্তন হয় তদন্ত কর্মকর্তা, দায়িত্ব পান তেজগাঁও জোনাল টিমের (ডিবি, পশ্চিম, ডিএমপি) পরিদর্শক শেখ মোহাম্মদ শাহ্ আলম। তিনিও প্রধান আসামি সুরুজ মিয়াকে রিমান্ডে নেন। কিন্তু তিনিও ব্যর্থ হন লিটনের সন্ধান দিতে। অবশেষে হাইকোর্ট থেকে জামিনে বের হয়ে আসেন আটক আসামিরা। তারা এখন মুক্ত হওয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন, অন্যদিকে মামলার বাদী গার্মেন্টসকর্মী মো. লোকমান ও তার বড় ভাই ভ্যানচালক মো. আমিনুল ছোট ভাইয়ের সন্ধানে থানা-পুলিশ আর আদালত চত্বরে ঘুরে হয়রান।

মামলার এজাহারে যা বলা আছে

মামলার এজাহারে বাদী মো. লোকমান উল্লেখ করেন, “আমার ছোট ভাই মো. লিটন (২২) তেজগাঁও থানাধীন কারওয়ান বাজারস্থ সোর্স অ্যান্ড ডিজাইন গার্মেন্টসে ১নং আসামির (মো. সুরুজ মিয়া) সঙ্গে প্রায় আট বছর ধরে মাল লোড-আনলোডের কাজ করত। কাজ করার সুবাদে বিভিন্ন সময় আমার ভাইয়ের নিকট হতে ১নং আসামি টাকা ধার নিত। ২০১৯ সালের ১০ মার্চ সকাল (আনুমানিক) ৮টায় আমার ছোট ভাই লিটনকে তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরে ফোন করলে তা বন্ধ পাই। তার কর্মস্থলে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি যে, ১নং আসামি আমার ছোট ভাইকে গত ২০১৯ সালের ৯ মার্চ বিকাল (আনুমানিক) ৫টায় তেজগাঁও থানাধীন কারওয়ান বাজারস্থ কাঠপট্টি সংলগ্ন সোর্স অ্যান্ড ডিজাইন গার্মেন্টসের সামনে থেকে আসামি সুরুজ মিয়া, মোছা. নাজমা খাতুন, মো. আলাল, দুলাল, মো. রসুল মিয়া, মো. বিল্লাল হোসেনসহ অজ্ঞাতনামা ৭-৮ জন সহযোগীর সহায়তায় আমার ভাইকে ফুসলিয়ে অপহরণ করে খুন করার উদ্দেশ্যে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। অদ্যাবধি আমার ভাই লিটনের কোনো সন্ধান পাইনি।

খোঁজ নিয়ে আরও জানতে পারি যে, আমার ভাই লিটন ১নং আসামির (সুরুজ মিয়া) কাছে সর্বমোট পাঁচ লাখ টাকা পাওনা ছিল এবং পাওনা টাকা নিয়ে আমার ভাইয়ের সঙ্গে আসামিদের মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে ১নং আসামির সঙ্গে যোগাযোগ করলে সে জানায় যে, আমার ভাই লিটনের মোবাইলে চার্জ না থাকায় তার মোবাইল বন্ধ রয়েছে। মোবাইলে চার্জ দিয়ে আমার ভাই তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন খুলবে এবং ফিরে আসবে মর্মে ১নং আসামি জানায়। আমার ভাই ফিরে না আসায় এবং তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটিও বন্ধ থাকায় পুনরায় ১নং আসামির (সুরুজ মিয়া) সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে আসামির মোবাইল বন্ধ পাই এবং তার কর্মস্থলে সে অনুপস্থিত মর্মে জানায়।

২ ও ৩নং আসামির সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে আমার ভাই ফিরে আসবে মর্মে জানায়। কিন্তু আমার ভাই ফিরে না আসায় ২নং আসামির (মোছা. নাজমা খাতুন) বাড়ি গেলে তার বাড়ি তালা মারা দেখতে পাই এবং তার মোবাইলে যোগাযোগ করলে সে আমার ফোন রিসিভ করেনি। এছাড়া ৩নং আসামিও (মো. আলাল) কারওয়ান বাজার হতে কৌশলে পালিয়ে যায়। ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে সেও আমার ফোন রিসিভ করেনি। আমার ভাইকে বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করে আমার পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে আলোচনা করে থানায় এসে এজাহার দায়ের করতে বিলম্ব হলো। অতএব উল্লেখিত বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে মর্জি হয়।”

নিখোঁজ লিটনের ভাই লোকমান জানান, মামলা দায়েরের পর ১নং আসামি সুরুজ মিয়া ও ৩নং আসামি মো. আলালকে গ্রেফতার করে তেজগাঁও থানা পুলিশ। ২০১৯ সালের ৩ মে তাদের বিরুদ্ধে সাতদিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মোশারফ হোসেন চৌধুরী।

পুলিশি রিমান্ডে নেয়ার আবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা যা উল্লেখ করেন

মামলার এজাহারনামীয় ও গ্রেফতার ১নং আসামি সুরুজ মিয়া ও ৩নং আসামি মো. আলালকে সাতদিনের পুলিশি রিমান্ডে নেয়ার আবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদে আসামিদ্বয় কৌশলে প্রকৃত ঘটনা এড়াইয়া যাইতেছে। তদন্তকালে জানা যায়, ১নং আসামি সুরুজ ভিকটিম লিটনকে তাহার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বর হতে ফোন করে এবং বলে যে, তুই রাতেই চলে আয়। ভিকটিম বলে, সকালে আসি। কিন্তু আসামি রাতেই আসার জন্য পিড়াপিড়ি করে। ভিকটিম আসামির কাছে যাওয়ার সময় তাহার মোবাইল ফোনে ব্যবহৃত মেমোরি কার্ড কারওয়ান বাজারে তার বন্ধুর কাছে রেখে গেলে উক্ত মেমোরি কার্ডটি উদ্ধারপূর্বক জব্দ করা হইয়াছে। আসামির মোবাইল ফোনের সিডিআর পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ভিকটিমের সঙ্গে আসামির ময়মনসিংহে যাওয়ারত অবস্থায় রীতিমতো কথা হয়। সর্বশেষ ১০ মার্চ, ২০১৯ তারিখে ভিকটিমের সঙ্গে আসামির রাত ০১টা ২৪ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড-এর সময় ৩১ সেকেন্ড কথা হয়। এরপর হইতে ভিকটিমের মোবাইল ফোন বন্ধ রহিয়াছে। এমতাবস্থায় আসামিদ্বয়কে পুলিশ রিমান্ডে আনিয়া জিজ্ঞাসাবাদ করিলে মামলার প্রকৃত রহস্য উদঘাটন, ভিকটিম লিটনের অবস্থান শনাক্তকরণসহ পলাতক আসামিদের গ্রেফতারে সমূহ সম্ভাবনা রহিয়াছে।’

ভিকটিম লিটনের ভাই লোকমান জানান, সাতদিনের রিমান্ড আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের বিরুদ্ধে চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। রিমান্ডে তারা ‘গুরুত্বপূর্ণ’ তথ্য দেয়ার কথা বললেও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তার ভাইয়ের কোনো সন্ধান দিতে পারেননি। পরবর্তীতে দুই আসামিকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করা হয়।

আসামিদের রিমান্ড শেষে আদালতে দাখিলকৃত প্রতিবেদনে যা বলা হয়

২০১৯ সালের ১৬ মে আসামিদের চারদিনের রিমান্ড শেষে আদালতে প্রেরণ করেন তদন্ত কর্মকর্তা। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, ‘মামলার এজাহারনামীয় ১নং আসামি সুরুজ মিয়া এবং ৩নং আসামি মো. আলালকে চারদিনের রিমান্ড শেষে বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দপূর্বক এই মর্মে প্রতিবেদন দাখিল করিতেছি যে, আসামিদের চারদিনের পুলিশ রিমান্ডে আনিয়া মামলার ভিকটিম লিটনের অবস্থান এবং পলাতক আসামিদের অবস্থান সংক্রান্তে রিমান্ডে নেয়া আসামিদের আলাদা ও যৌথভাবে সতর্কতার সঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। যার মাধ্যমে এজাহারনামীয় অন্য আসামিদের গ্রেফতার ও ভিকটিম লিটনের অবস্থান শনাক্ত করা সম্ভব হইতে পারে।

আসামিদের নিকট থেকে প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক তাদের নিয়ে ঢাকা ও আশপাশ এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হয়। কিন্তু ভিকটিমকে উদ্ধার ও পলাতক আসামিদের গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। তবে জোর চেষ্টা অব্যাহত আছে। আসামিদের পুনরায় পুলিশ রিমান্ডের প্রয়োজন হলে আদালতে আবেদন করা হবে। আসামিরা জামিনে ছাড়া পেলে পলাতক হওয়ার সম্ভাবনা আছে।’

মামলা ডিবিতে হস্তান্তর

২০১৯ সালের ১ আগস্ট মামলাটি ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়। তদন্তের দায়িত্ব পান তেজগাঁও জোনাল টিমের (ডিবি, পশ্চিম, ডিএমপি) পরিদর্শক শেখ মোহাম্মদ শাহ্ আলম। তিনি দায়িত্বভার পেয়ে ২৮ আগস্ট মামলার ১নং আসামি হাজতি সুরুজ মিয়ার বিরুদ্ধে সাতদিনের রিমান্ড আবেদন করেন। আদালত শুনানি শেষে দুদিনের রিমান্ড আবেদন করেন।

দুদিনের রিমান্ড শেষে আদালতে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে যা বলা হয়

২০১৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর মামলার ১নং আসামি সুরুজ মিয়ার দুদিনের রিমান্ড শেষে আদালতে প্রেরণ প্রসঙ্গে লিখিত আবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা শেখ মোহাম্মদ শাহ্ আলম উল্লেখ করেন, ‘দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদে আসামি অত্র মামলা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করেছেন। তদন্তকালে ভিকটিমের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনের মেমোরি কার্ড পাওয়া যায়। যাহা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আসামি সুরুজ মিয়া কৌশলে তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বর হতে ভিকটিম লিটনকে ফোন করে পাওনা টাকা দেয়ার কথা বলে রাতেই ঈশ্বরগঞ্জ যেতে বলে। ভিকটিম সকালে যেতে চাইলে রাতেই যাওয়ার জন্য আসামি সুরুজ মিয়া পিড়াপিড়ি করে। তার পিড়াপিড়ির ফলে ভিকটিম ঈশ্বরগঞ্জ যায় এবং ঈশ্বরগঞ্জ যাওয়ার পর হতে ভিকটিম লিটনের আর কোনো খোঁজখবর নাই।

রিমান্ডপ্রাপ্ত আসামি মো. সুরুজ মিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, ভিকটিম মো. লিটন ও আসামি মো. সুরুজ মিয়া তেজগাঁও থানাধীন কারওয়ান বাজারস্থ সোর্স অ্যান্ড ডিজাইন গার্মেন্টসে প্রায় ৮-৯ বছর ধরে মালামাল লোড-আনলোডের কাজ করত। গত ৯ মার্চ ২০১৯ ইং তারিখ বিকাল থেকে বিভিন্ন সময় আসামি সুরুজ মিয়া মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ভিকটিম লিটনকে ঈশ্বরগঞ্জ যাওয়ার জন্য পিড়াপিড়ি করে। আসামি সুরুজ মিয়ার পিড়াপিড়ির ফলে ভিকটিম লিটন ঈশ্বরগঞ্জ যায়। লিটন ঈশ্বরগঞ্জ পৌঁছলেই তার সাথে আসামি সুরুজ মিয়ার মোবাইলে কথা হয় মর্মে তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়। ভিকটিম লিটন ঈশ্বরগঞ্জ যাওয়ার পর থেকে নিখোঁজ। লিটনকে অদ্যাবধি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। হাজতি আসামি সুরুজ মিয়া জামিনে মুক্তি পেলে চিরপলাতক হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আসামি সুরুজ মিয়া অত্র মামলার ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত মর্মে তদন্তে তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাচ্ছে। পরবর্তীতে মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে হাজতি আসামি সুরুজ মিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ রিমান্ডের প্রয়োজন হতে পারে। তাই ভিকটিম লিটন উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত হাজতি আসামি সুরুজ মিয়াকে জেলহাজতে আটক রাখতে বিজ্ঞ আদালতের সবিনয়ে প্রার্থনা করছি।’

ভিকটিমকে উদ্ধারে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ তথ্য দিলেও জামিনে মুক্ত আসামিরা

বাদীপক্ষের আইনজীবী শোহেল মো. ফজলে রাব্বী বলেন, এটি একটি অপহরণ মামলা, পুনঃমোকদ্দমা। প্রায় দেড় বছর হয়ে গেল ভিকটিম উদ্ধার হয়নি। ভিকটিম লিটন, আর ১নং আসামি সুরুজসহ মোট ছয়জন আসামি।

তিনি আরও জানান, ঘটনার দীর্ঘ তিন মাস পর মামলাটি দায়ের হয়। মামলাটি দায়েরের পর আসামিরা গ্রেফতার হয়। দীর্ঘদিন জেলহাজতে থাকার পর হাইকোর্ট থেকে আসামিরা জামিন নেন। জেল থেকে বের হয়ে তারা রীতিমতো ভিকটিমের পরিবার, বাদী ও সাক্ষীদের হুমকি দিয়ে আসছেন। বাদী ও সাক্ষীরা খুবই অসহায়, গরিব মানুষ। অন্যদিকে আসামিরা খুবই প্রভাবশালী বিধায় তারা পার পেয়ে যাচ্ছেন। তারা এখনও বিভিন্নভাবে বাদীপক্ষকে হুমকি দিয়ে আসছেন। আমি আশা করব, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা মামলার তদন্তভারের দায়িত্বে থাকা ডিবি দ্রুত ভিকটিমকে উদ্ধার করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে।

গরিব বলে কি বিচার পাব না : ভিকটিম লিটনের বড় ভাই

মামলার বাদী ও ভিকটিম লিটনের বড় ভাই গার্মেন্টসকর্মী মো. লোকমান বলেন, গরিব বলে কি আমরা বিচার পাব না? সুরুজের কাছে পাওনা টাকা চাইতে গিয়ে আমার ভাইকে গুম করা হয়েছে। আমরা টাকা চাই না। আমরা ভাইটাকে ফেরত চাই।

কীভাবে বুঝলেন সুরুজই আপনার ভাইকে গুম করেছে— এমন প্রশ্নের জবাবে লোকমান বলেন, মার্চের ৯ তারিখ (২০১৯ সাল), শনিবার সকালে সে বাসা থেকে বের হয়। বিকালে তাকে ফোনে ময়মনসিংহে ডেকে নেয় সুরুজ। তিনদিন পর ভাইয়ের কোনো খোঁজ না পাওয়ায় কারওয়ান বাজারস্থ সোর্স অ্যান্ড ডিজাইন গার্মেন্টসে যায়। সেখানে ভাইয়ের খোঁজ নেই। পরে গার্মেন্টসের সামনের চায়ের দোকানে খোঁজ নিলে তারা বলে, সুরুজ তাকে বাড়ি (ময়মনসিংহ) ডেকে নিয়ে গেছে। যাওয়ার সময় ভিকটিম লিটন ওই দোকানদারকে তার মোবাইলের মেমোরি কার্ডটা দিয়ে যায়। সেখানে আমার ভাইকে ময়মনসিংহে ডেকে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি রেকর্ড হয়ে আছে। এছাড়া গার্মেন্টসে আমার ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করা আল-আমিনও জানায়, সুরুজের বাড়িতে গেছে লিটন।

‘ঘটনার তিনদিন পর সুরুজ ঢাকায় আসে। আমি তাকে বলি, লিটনকে যে তুমি ময়মনসিংহে ডেকে নিয়ে গেছ, আমার কাছে তার প্রমাণ আছে। কী প্রমাণ আছে, জানতে চাইলে আমি মেমোরি কার্ডে তাদের কথাবার্তার রেকর্ডের কথা জানাই। রেকর্ড শোনানোর পর থেকে সে (সুরুজ) উধাও।’

তিনি বলেন, বিষয়টি আমার আপন বড় ভাইকে জানাই। তিনি মেমোরি কার্ড নিয়ে বাড়ি (ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ) আসতে বলেন। এরপর ঈশ্বরগঞ্জে মামলা করতে গেলে থানা পুলিশ আমাদের মামলা নেয়নি। টাকা-পয়সা খেয়ে তারা আমাদের মামলা নেয় না। পরে ময়মনসিং ডিবিতে যায়। তারাও মামলা নেয় না। বলে, ঘটনা যেহেতু তেজগাঁও থানায়, সেখানে মামলা কর। তেজগাঁও গেলে তারাও মামলা নেয় না। পরে তেজগাঁও ডিসি অফিসে সহায়তায় থানায় মামলা নেয়।

ভিকটিম লিটনের ভাই আরও বলেন, আমার একটাই দাবি, আমার ভাইয়ের সন্ধান চাই। মামলার আগে তারা (আসামিরা) দুই-তিন লাখ টাকা দিয়ে বিষয়টি মীমাংসার প্রস্তাব দেয়। বলে, মামলা করে কোনো লাভ হবে না। কিন্তু আমি কিছুই চাই না। আমার ভাইকে শুধু ফেরত চাই। তারা সবাই এখন জামিনে, আদালতে আসছে-যাচ্ছে কিন্তু আমার ভাইয়ের কোনো সন্ধান মিলছে না। আমার বৃদ্ধা মা খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, ছোট সন্তানের পথ চেয়ে আছে, কবে সে ফিরে আসবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার দাবি, যেভাবেই হোক আমার ভাইকে যেন আমার মায়ের বুকে ফিরিয়ে দেয়া হয়।

এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তেজগাঁও জোনাল টিমের (ডিবি, পশ্চিম) পরিদর্শক শেখ মোহাম্মদ শাহ্ আলম বলেন, ‘মামলার পর আসামিদের গ্রেফতার করে রিমান্ডে আনা হয়। তারা রিমান্ডে কিছু স্বীকার করেননি। মামলাটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। ভিকটিমের কললিস্ট যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। আশা করছি, শিগগিরই একটা ভালো কিছু জানা যাবে।’

Share this post

scroll to top