মো. শহীদুল ইসলাম। ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের অফিস সহায়ক। ৩৭ বছর বয়সে ২০১৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর সরকারি চাকরিতে যোগ দেন তিনি। সবই ঠিক চলছিল। সার্ভিস বই ও জাতীয় পরিচয়পত্রে (নম্বর ৬১১৫২২….৯০৫) তার বয়স, বাবা ও মায়ের নামের মিল না থাকায় বিপত্তি ঘটে।
চাকরি বাঁচাতে এবার ঢাকার উত্তরার ভোটার হন ২০১৯ সালে। সংগ্রহ করেন নতুন জাতীয় পরিচয়পত্র (নম্বর ১৯৯০২৬৯৯৫০….৯৯৩)। এতে বয়স কমান ৮ বছর। মা-বাবার নামের বানানে ভিন্নতা আনেন। নির্বাচন কমিশনের তথ্যভাণ্ডারে তার দুটি জাতীয় পরিচয়পত্র এখনও সচল।
শহীদুল ইসলাম দাবি করেন, জন্মনিবন্ধন সনদ দিয়ে নিয়ম মেনে চাকরি পেয়েছেন তিনি। জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য সংশোধন করেছেন। তিনি দুইবার ভোটার হননি। তার এ দাবি সত্য নয়- এমন প্রমাণ দেয়ার পর তিনি অনুরোধের সুরে বলেন, ভাই, আমার সব শেষ করে দিয়েন না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এভাবে নিজের বয়স, বাবা, মায়ের নামসহ বিভিন্ন ধরনের অসত্য তথ্য দিয়ে দুই শতাধিক সরকারি কর্মচারী চাকরি করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ রেলওয়ে, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক কার্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে তারা নিয়োগ পেয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আছেন রেলওয়েতে।
তাদের অনেকের দুটি করে জাতীয় পরিচয়পত্রও আছে। শুধু ময়মনসিংহ জেলার ১৪ জন কর্মচারী পাওয়া গেছে, যাদের ১০ জনের দুইটি করে জাতীয় পরিচয়পত্র সচল। আবার কেউ কেউ চাকরি বাঁচাতে জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য সার্ভিস বুক অনুযায়ী পরিবর্তন করতে নির্বাচন কমিশনে আবেদনও করেছেন। তাদের কারও তথ্য সংশোধন হয়েছে, আবার কারও আবেদন প্রক্রিয়াধীন।
এ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ব্যক্তির তথ্য জালিয়াতির বিষয় নজরে এলে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। প্রতারণার কারণে বেতনের টাকা ফেরত ও জেলে পাঠানোরও নজির আছে। তিনি বলেন, চাকরি চূড়ান্ত করার সময় সব ধরনের ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশন করার বিষয়ে কঠোর অবস্থায় আছি।
এমনকি চাকরিপ্রার্থীদের ডোপটেস্ট করানোর বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কর্মরত কয়েকজন বলেন, সরকারি চাকরি নামের সোনার হরিণ ধরতেই তারা তথ্য জালিয়াতি করেছেন। তাদের অনেকেই উচ্চ মাধ্যমিক পাস হওয়া সত্ত্বেও বয়স কমাতে ৮ম শ্রেণির সার্টিফিকেট ও জন্মসনদ দিয়ে চাকরি নিয়েছেন।
এ চাকরি পেতে তাদের বেশির ভাগেরই টাকা দিতে হয়েছে অথবা প্রভাবশালীদের মাধ্যমে তদবির করতে হয়েছে। কিন্তু বেতন ওঠাতে জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক করায় তারা আটকে গেছেন। এ থেকে বাঁচতে কেউ টাকা দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন করেছেন, আবার কেউ দুইবার ভোটার হয়েছেন।
এভাবে তথ্য জালিয়াতি বা তথ্য গোপন করে চাকরি পেলে তা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার জন্য সুখকর নয় বলে মনে করেন সরকারি কর্ম কমিশনের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক। তিনি বলেন, তথ্য গোপন, জালিয়াতি ও বিকৃতি করে সরকারি চাকরিতে যোগ দেয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। চাকরির শুরুতেই যারা এ ধরনের কাজ করে, তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা থাকতে পারে। নিয়োগকারীদের অধিকতর তথ্য যাচাই-বাছাই করতে হবে।
তাদের একজন চাঁদ মোহাম্মদ। নিজের পুরো নাম পরিবর্তন করে পুলিশের কনস্টেবল হিসেবে চাকরি করছেন। সার্ভিস বুকে তার নাম মারুফ হোসেন। জন্মতারিখ ১৫ জানুয়ারি ১৯৯৭ সাল। অথচ জাতীয় পরিচয়পত্রের (নম্বর ৮১১০৭….২৪১) ভাণ্ডারের তথ্য, ভোটার হওয়ার সময় তিনি ছিলেন উচ্চমাধ্যমিক পাস।
পেশায় ছাত্র। জন্মতারিখ ২২ নভেম্বর ১৯৮৬। এ হিসাবে নিজের পুরো নাম পরিবর্তন ও বয়স ১১ বছর কমিয়ে চাকরি নেন তিনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে চাঁদ মোহাম্মদ বলেন , এটি তার ডাকনাম। প্রকৃত নাম মারুফ হোসেন। জাতীয় পরিচয়পত্রে ভুল তথ্য থাকায় চাকরি যায় যায় অবস্থায়। চাকরি নিতে যে খরচ করেছি, সেটির পুরোটাই লস।
দিনাজপুরের পার্বতীপুর পৌরসভার চতুর্থ শ্রেণির অস্থায়ী কর্মচারী মো. আনিসুর রহমান চাকরি নিয়েছেন বাংলাদেশ রেলওয়ের খালাসি পদে। বর্তমানে তিনি দিনাজপুরে রেডিও অপারেটর হিসেবে কর্মরত আছেন। চাকরি নিতে নিজের বয়স ১০ বছর কমিয়েছেন। জাতীয় পরিচয়পত্রের (নম্বর ২৭২৭৭…..৬৯৪) তথ্যভাণ্ডারের তথ্য হচ্ছে তিনি উচ্চমাধ্যমিক পাস এবং জন্মতারিখ ১ মার্চ ১৯৭৬।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মো. আনিসুর রহমান বলেন, বয়স কমানোর কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমি প্রকৃতপক্ষে এইচএসসি পাস হলেও চাকরিতে যোগ দিতে অষ্টম শ্রেণি পাসের সার্টিফিকেট জমা দিয়েছি। চাকরি নিতে কোনো টাকা দেননি বলেও জানান তিনি।
নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, নিজের ২৮ বছর বয়স কমিয়ে ময়মনসিংহ প্রশাসন শাখায় অফিস সহায়ক পদে কর্মরত রয়েছেন মো. আবদুল কাদির। তার জাতীয় পরিচয়পত্রে (নম্বর ১৪৫৬…০৭৫) জন্মতারিখ ১৯৬৫ সালের ১ অক্টোবর থাকলেও সার্ভিস বুকে উল্লেখ করেছেন ১৯৯৩ সালের ৩০ নভেম্বর।
একইভাবে ফরিদপুরের পলি রানী দাস নিজের পুরো নাম পরিবর্তন করে চন্দনা বিশ্বাস ও বয়স ৫ বছর কমিয়ে এবং নাটোরের বড়াইগ্রামের মো. বিপুল হোসেন নিজ নাম পরিবর্তন করে বিপ্লু ও বয়স ৭ বছর ৬ মাস কমিয়ে রেলওয়েতে চাকরি নিয়েছেন। জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার রীনা বাশফোর নিজের বয়স ১০ বছর কমিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের পরিচ্ছন্নতা কর্মী, ঢাকার তেজগাঁওয়ের ভবরঞ্জন দাস ৬ বছর কমিয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের পরিচ্ছন্নতা কর্মী এবং নোয়াখালীর সোনাইমুড়ির লিটন চন্দ্র দাস ৪ বছর কমিয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দফতরি কাম প্রহরী পদে চাকরি করছেন।
এক জেলায় ১০ জন কর্মচারীর দুইটি জাতীয় পরিচয়পত্র : জানা গেছে, ময়মনসিংহ জেলার ১৪ জন বাসিন্দার তথ্য পাওয়া গেছে, যারা সবাই সরকারি কর্মচারী। তাদের মধ্যে ১০ জনেরই দুইটি জাতীয় পরিচয়পত্র রয়েছে। এই ১০ জনের ৫ জন রাজধানীর উত্তরা, তিনজন তুরাগ ও দুইজন মিরপুরের ঠিকানায় ভোটার হয়েছেন।
তাদের দুইটি জাতীয় পরিচয়পত্র সচল। প্রত্যেকেই দ্বিতীয়বার ভোটার হওয়ার সময় ৩ থেকে ২৮ বছর পর্যন্ত বয়স কমিয়েছেন। সবাই ২০১৯ সালে ভোটার তালিকা হালনাগাদের সময়ে দ্বিতীয়বার ভোটার হন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নির্বাচন কমিশনের তথ্যভাণ্ডারের সার্ভারের ত্রুটি ও দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তারা দ্বিতীয়বার ভোটার হন। দ্বিতীয় জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়েই তারা চাকরিতে বহাল রয়েছেন। আরও জানা গেছে, কেউ নতুন ভোটার হওয়ার সময়ে তার আঙুলের ছাপ ম্যাচিংয়ের মাধ্যমে দ্বিতীয়বার ভোটার হয়েছেন কি না, তা যাচাই করা হয়। কিন্তু ২০০৭-০৮ সালে নেয়া অনেক ভোটারের আঙুলের ছাপ মানসম্মত না হওয়ায় তাদের শনাক্ত করা যাচ্ছে না।
দুইবার ভোটার হওয়ার বিষয়ে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম বলেন, অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ ও দুর্নীতি করার জন্য অসৎ উদ্দেশ্য নিয়েই বেশির ভাগ দু’বার ভোটার হন। আমরা প্রযুক্তির মাধ্যমে তাদের শনাক্ত করে আসছি। ২০১৯ সালে ভোটার তালিকা হালনাগাদে এভাবেই ২ লাখ ৭ হাজার ভোটার হতে যাওয়া ব্যক্তিকে শনাক্ত করেছি। সার্ভারে দুটি জাতীয় পরিচয়পত্র সচল থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, সার্ভারের গ্যাপ খুঁজে বের করছি। সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিচ্ছি।