৩৬ বছর ছুটি না নিয়ে শিক্ষকতা শেষ করলেন তিনি

ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। ভর্তিও হয়েছিলেন। মন বসলো না। ফিরে এসে গ্রামের মাধ্যমিক স্কুলে শুরু করলেন শিক্ষকতা। তারপর, ৩৬ বছর ধরে তিনি ছুটি না নিয়েই শিক্ষকতা করেছেন।

বিদ্যালয়কেই বাড়ি মনে করেছেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন। শ্রম ও নিষ্ঠার কারণে এলাকার মানুষের কাছে খ্যাত হয়ে উঠেছেন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে অবসরে গেছেন তিনি।

মাগুরায় গণিত-বিজ্ঞানের এই আদর্শ শিক্ষকের নাম স্বপন কুমার চক্রবর্তী। মহম্মদপুর উপজেলা সদরের পূর্বনারায়নপুর গ্রামের বাসিন্দা তিনি। উপজেলা সদরের ঐতিহ্যবাহী আর এস কে এইচ ইনস্টিটিউশনের সহকারি শিক্ষক হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু।

নিজে ডাক্তার হতে পারেননি বলে আক্ষেপ নেই। নিজের হাতে গড়া অসংখ্য শিক্ষার্থী আজ চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বড় প্রশাসনিক ও সামরিক কর্মকর্তা। মানুষ গড়ায় তার নিষ্ঠতার গল্প এখন স্থানীয় মানুষের মুখে মুখে ফেরে।

স্থানীয় অভিভাবকেরা মনে করেন, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা স্বপন চক্রবর্তীর মতো নিষ্ঠাবান হলে এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার বেহাল দশা থাকতো না।

স্বপন কুমার চক্রবর্তী উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সময় থেকেই স্কুলে খন্ডকালীন শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৭৯ সালের ১৫ অক্টোবর তিনি সহকারি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ২০১০ সালে তিনি একই বিদ্যালয়ে সহকারি প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে অবসরে গেছেন তিনি। ৩৬ বছরের শিক্ষকতা জীবনে একদিনও প্রাপ্য নৈমিত্তিক ছুটি কাটাননি তিনি। বাবার মৃত্যু, স্ত্রীর অসুস্থতা, পারিবারিক সমস্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ কোনো কিছুই তাকে আটকে রাখতে পারেনি। স্কুলের হাজিরা বই ও অন্যান্য কাগজপত্র ঘেঁটে এ তথ্যের সত্যতা পাওয়া গেছে।

তার বাবা শিবনাথ চক্রবর্তী মারা যান ১৯৯৬ সালের ২১ জুন রাত সাড়ে ১১ টায়। দিনটা ছিল শুক্রবার। বাবার শেষকৃত্য সম্পন্ন করে পরদিন শনিবার সময়মতো স্কুলে হাজির হন স্বপন চক্রবর্তী।

পুরোনো দিনের কথা বলতে বলতে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন এই শিক্ষক। একটু জিরিয়ে নিয়ে বলেন, ‘প্রথম সন্তানের জন্ম হয় বাড়িতে। ছেলে হওয়ার খবর শুনে মনে সে কী আনন্দ! ইচ্ছে হচ্ছিল তখনই ছুটে যাই। কিন্তু স্কুলতো খোলা। তাই ছুটির পর গিয়ে দেখে আসি ফুটফুটে ছেলেটাকে।’

স্ত্রী রেখা চক্রবর্তী ও তিন ছেলে নিয়ে স্বপন চক্রবর্তীর সংসার। তিন ছেলেই জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।

তার বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য জিয়াউল হক বাচ্চু বলেন, স্বপন কুমার চক্রবর্তী এ জনপদের আলোর দিশারি। নিজের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে তিনি সবার হূদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। তার এই ত্যাগ অনুসরণযোগ্য।’

স্বপন চক্রবর্তীর ছাত্র বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহকারি অধ্যাপক এস এম. রেজাউল করিম বলেন, ‘গণিত বিজ্ঞানের পাশাপাশি সকল বিষয়ে স্যারের অগাধ পাণ্ডিত্য রয়েছে। স্যারকে নিয়ে আমরা গর্ব করি।’

ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের আরেক শিক্ষক শহিদুর রহমান স্বপন স্যারের ছাত্র। তিনি বলেন, ‘স্যারের অনুপ্রেরণা ও কার্যকরি পাঠদানের ফলেই আমরা এই পর্যায়ে আসতে পেরেছি ।’

স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাসনিম অরিন ও মুজাহিদ মিয়া বলেন, ‘স্বপন স্যার স্কুলের অন্য সব শিক্ষকের চেয়ে আলাদা। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত এ বিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমরা স্যারকে একদিনও অনুপস্থিত দেখিনি।’

স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষক এ কে এম নাসিরুল ইসলাম বলেন, ‘স্বপন চক্রবর্তী সরাসরি আমার স্যার। চাকরিজীবনে স্যারকে ছুটি না নেওয়ার নজির অন্য কোথাও আছে কি না জানা নেই।’ -রাইজিং বিডির সৌজন্যে

Share this post

scroll to top