ন্যাংটা রমু পাগলাকে দুই পায়ে বেঁধে স্টেশনের বেলগাছটায় ঝুলিয়ে শুরু হয় নির্যাতন। সেই দৃশ্য দেখাতে স্টেশনের আশপাশের বাড়িগুলোতে তল্লাশি চালিয়ে শ’খানেক দর্শকও ধরে আনা হয়। রমু পাগলার নাকে-মুখে প্রহার করায় ললাট বেয়ে টপটপ করে পড়া লাল রক্তে ভিজতে থাকে মাটি। এ দৃশ্য দেখতে ধরে আনা দর্শকদের বাধ্য করে তাদের দিকে তাক করা এক ঝাঁক বন্দুকের নল। মা-মেয়ে বাপ-ছেলে স্বামী-স্ত্রী শিশু-যুবক-বৃদ্ধ সব বয়সের লোকই আজ একসারিতে দন্ডায়মান । ন্যাংটা রমু পাগলার নির্যাতনদৃশ্য একসাথেই দেখতে হচ্ছে তাদের। পিঁপড়ে কিংবা মশার কামড়েও এক পা নড়ে না। কঠিন পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সবগুলো হৃদয়ে মৃত্যুভয় তাড়া করছে।
রমু পাগলার ওপর কেন এই অত্যাচার ? পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সী ওই পাগলের সেটাই কি অপরাধ, যতবার তাকে প্রহার করা হয় ততবার সে ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করে ওঠে। স্টেশনের পাশেই পাকি হায়েনার একটি ক্যাম্পে ঢুকে ‘জয় বাংলা’ বলায় তাকে আটক করা হয়। তারপর ন্যাংটো করে স্টেশনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। তখনো ‘জয় বাংলা’ বলায় ক্ষিপ্ত হায়েনারা রমু পাগলার দু’পায়ে বেঁধে বেলগাছটায় ঝুলিয়ে শুরু করে নির্যাতন। নাকে-মুখে প্রচন্ড প্রহারে টপটপ করে রক্ত ঝরে। লাইন ধরে রমু পাগলার মুখে পেশাব করে গোটা কয়েক জানুয়ার। কান দুটি কেটে চোখ দুটি উপড়ে ফেলে দেয় রমুর। মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রমু পাগলার কণ্ঠচিরে উচ্চারিত হয় ‘জয় বাংলা’। পাগলা কুকুরগুলো আরো ক্ষেপে যায়। পায়ুপথে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে গুলি করে। রমু পাগলার দেহ থেকে ছিন্ন ভিন্ন কিছু মাংসের টুকরা আশপাশে ছিটকে পড়ে। বেলতলায় রমু পাগলার উপড়ে ফেলা চোখ দুটো তখনও লাল রক্তে ছলছল করছিল।
কে এই রমু পাগলা? জেলা শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার উত্তরে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে মৌলাগঞ্জ উপজেলার মেছোয়াডাঙ্গায় বসতভিটা ছিল আবদুর রহমানের। নদীর ভাঙনে সব হারিয়ে আশ্রয় নেয় মৌলাগঞ্জ রেলস্টেশনে। কুলির কাজ করে সবার প্রিয় হয়ে ওঠে আবদুর রহমান। স্টেশনে আগত লোকদের নানা কৌতুক শুনিয়ে হাসিতে মাতিয়ে রাখতো সব সময়। হাস্যরসে ভরপুর আবদুর রহমানই মানুষের হৃদয়নিংড়ানো ভালোবাসায় সবার হৃদয়ে ঠাই করে নেয় ‘রমু পাগলা’ নামে। ছোট বেলায় মা মারা যাওয়ার পর বাবার সাথে নদীতে জাল ধরেই তার বড় হওয়া। বাবার পছন্দেই বিয়ে হয়েছিল বেনু মাঝির মেয়ে ফুলবানুর সাথে। দীর্ঘ কুড়ি বছরেও তাদের ঘরে সন্তান না আসায় ফুলবানু তাঁকে ছেড়ে শহরে চলে যায়। এক বর্ষায় নদীর তীরে টিকে থাকা বসতভিটাও নিয়তির ভাঙাগড়ার খেলায় চলে যায় ব্রহ্মপুত্রে। তখন থেকেই স্টেশনে কুলির কাজ করে কোনমতে দিন যেতো রমু পাগলার।
১৯৭১ সাল। চারদিকে পাকি হায়েনারা দল বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়ছে বাঙালিদের ওপর। মৌলাগঞ্জ রেলস্টেশনে ক্যাম্প করে রেললাইনের দু’পাশের বাড়ি গুলো আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিচ্ছে। সামনে যাকে পাচ্ছে তাকে ধরে এনে হত্যা করছে। এক রাতে চুপি-চুপি কয়েকটি লাশ মাটি খুঁড়ে দাফন করে রমু পাগলা। প্রতিবাদের নেশায় রমু পাগলার পাগলামী বেড়ে যায়। ‘জয় বাংলা’ বলতে বলতে পাকি হায়েনাদের ক্যাম্পে ঢুকে পড়ে। আটক হয় রমু পাগলা। ‘জয় বাংলা’ বলতে বলতেই নিজের প্রাণ উৎসর্গ করে হায়েনাদের হাতে। রমু পাগলার ‘জয় বাংলা’র জয় হয়েছে ঠিকই, এই জয় ছিনিয়ে আনতে রমু পাগলার মতো আরো কতো মানুষকে রক্ত দিতে হয়েছে তার হিশেব কি কেউ রাখে।
লেখক :
আবিদ আউয়াল, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী