নির্বাচনের নানা হিসাব-নিকাশ

রাত পোহালেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বাংলাদেশে এবারের মতো এতটা আলোচিত নির্বাচন সম্ভবত আর আসেনি। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অভ্যন্তরীণ ঘটনা দুর্ঘটনা যেমন অনেক ঘটেছে তেমনিভাবে আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা নানা অবয়বেই এবারের নির্বাচনে অনেক বেশি। নির্বাচনটা শেষ পর্যন্ত হলে এর ধরন কেমন হবে সেই অনিশ্চয়তাও রয়ে গেছে।

এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জাতিসঙ্ঘ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সবাই বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য জোর তাগিদ দিয়ে এসেছে। আমেরিকান রাষ্ট্রদূত মিলার প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সাথে দেখা করে বৃহস্পতিবার তার দেশের সরাসরি উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। তিনি জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের চিঠিটিও দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের হাতে। এমন কথাও বলা হচ্ছে, অবাধ মুক্ত বিশ্বাসযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হলে অবরোধের মতো শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও আসতে পারে।

এ দিকে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর এমন প্রকাশ্য ও জোর তৎপরতার সময়ে ভারত ও চীন আসন্ন নির্বাচন প্রশ্নে অনেকটা নীরবতা পালন করছে। আওয়ামী লীগের দাবি ভারত তাদের পেছনে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। আবার ভারতীয় সূত্রগুলো প্রকাশ্যে বলছে, তারা বাংলাদেশের নির্বাচনে কোনো পক্ষের সাথে নেই। টাকাসহ চীনা নাগরিক গ্রেফতার হওয়ার খবর প্রকাশের পর অনেকেই ভাবছেন বেইজিংয়ের সমর্থন সরকারের পেছনে আছে কি নেই।

নেপালে কমিউনিস্ট জোটের জয়ের আগে কংগ্রেস সরকারের সময় এ ধরনের অর্থসহ চীনা নাগরিক গ্রেফতারের খবর বের হয়েছিল।

বৃহস্পতিবার দেশজুড়ে বিরোধী জোটের ওপর আওয়ামী লীগ সমর্থকদের তাণ্ডব অনেকটাই কমে গেছে। পুলিশি গ্রেফতার বন্ধ না হলেও কিছুটা কমেছে। নির্বাচন পূর্ববর্তী সামনের সময়ে নির্বাচনী পরিস্থিতির আরো উন্নতি ঘটার ব্যাপক সম্ভাবনা আছে বলে স্থানীয় সূত্রগুলো উল্লেখ করছে। বিএনপি জোট ও ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা তাদের জন্য সামনের প্রতিটা মুহূর্ত মহামূল্যবান মনে করছে।

জাতীয় পার্টির এরশাদকে এক রহস্যজনক ব্যক্তি বলে মনে করা হয় বাংলাদেশের রাজনীতিতে। ধারণা করা হচ্ছে এবার শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের গ্রিপে তিনি থাকেননি। ২৬ থেকে ২৯টি আসনে নৌকার প্রার্থী নেই, আছে শুধু লাঙল। তার ওপর নৌকার বিরুদ্ধে ১৪০টির বেশি আসনে এরশাদের জাপার নিজস্ব প্রার্থী রয়ে গেছে। এই ১০০ আসনে নৌকার জেতার চান্স খুবই কম বা নেই বলে মনে করা হচ্ছে।

বিরোধী জোটের পক্ষে এর আগে অভিযোগ করা হয় যে, এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে পুলিশ, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন ও উচ্চতর বিচারালয় এই চারটি ফ্রন্ট রয়েছে। উচ্চতর আদালতে এখন ছুটি চলছে। বন্ধের আগ পর্যন্ত ১৬-১৭টি আসনে বিএনপি-ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীদের প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু বেশির ভাগ আসনেই বিএনপি-ঐক্যফ্রন্টের শক্তিশালী বিকল্প প্রার্থী রয়ে গেছে।

জামায়াতের ২২ জন প্রার্থীর প্রার্থিতাও হাইকোর্টে টিকে গেছে। সুপ্রিম কোর্ট দিয়ে বিএনপি-ঐক্যফ্রন্টকে আদালতে ব্যস্ত রেখে ক্ষতি করা গেলেও চূড়ান্ত কোনো আঘাত দেয়া যায়নি। জনপ্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনও এখন পর্যন্ত বিএনপি-ঐক্যফ্রন্টের বড় ধরনের কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। প্রবল আন্তর্জাতিক চাপে আগামী দুই-তিন দিনে নির্বাচন কমিশন ও জনপ্রশাসন মোটামুটি নিরপেক্ষ থাকতে বাধ্য হবে বলে অনেকের ধারণা। ফলে এখন থেকে কেবল ১ নম্বরটিই আওয়ামী লীগের পক্ষে সক্রিয় থাকার সুযোগ পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বিরোধী জোটের পর্যবেক্ষণ অনুসারে, পুলিশ অবশ্য শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় সহায়ক ফোর্স হিসেবে মাঠে আছে। পুলিশ দেশজুড়ে বিএনপি-জামায়াতের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে। পুলিশের সামনেই ধানের শীষের প্রার্থীদের ওপর আওয়ামী লীগ সমর্থকেরা হামলা চালিয়েছে। অপর দিকে আওয়ামী লীগের যেসব প্রার্থী ও নেতা ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে প্রকাশ্যে ভয়ভীতি দেখিয়েছেন, সেসবের ভিডিওক্লিপ ভাইরাল হওয়ার পরও পুলিশ/ইসি কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়েও পুলিশের এমন ভূমিকা অব্যাহত থাকতে পারে, বিশেষত বিএনপি-ঐক্যফ্রন্টের নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের ক্ষেত্রে। তাই বিএনপি-ঐক্যফ্রন্টের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার এড়ানোর কৌশল নিয়ে মাঠে টিকে থাকতে হবে বলে নির্বাচন পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন।

বিশ্লেষকদের মতে, এতদিন ধরে আওয়ামী লীগের ব্যাপক সন্ত্রাস-নৈরাজ্য-কেন্দ্রে না যাওয়ার হুমকি সবকিছুর উদ্দেশ্য ছিল ভোটারদের মনে ভয় ধরিয়ে দেয়া। শেষ সময়ে চাপে পড়ে বিএনপি ভোট বর্জনের ঘোষণা দিলে স্বস্তি পেত আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী একাধিক সূত্র এমন আভাস দিয়েছিল। কিন্তু শত দমন-নিপীড়নের মধ্যে বিএনপি জোট-ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা মাঠে টিকে থেকে আওয়ামী লীগের সেই আশাটি ভেঙে দিয়েছে। মুক্ত অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশী আন্তর্জাতিক শক্তি এবং বিএনপি-ঐক্যফ্রন্ট মোটামুটি তাদের ভূমিকায় সফল বলে মূল্যায়ন করা হচ্ছে।

বলা হচ্ছে, এখন শেষ চাবিটি ভোটারদের হাতে। ভোটারেরা কি ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারবেন? অপেক্ষাকৃত উন্নততর পরিবেশে ভোটারেরা কি আশ্বস্ত হবেন, নাকি গত এক মাসের ভয়াবহ তাণ্ডবে ভোটারেরা চুপসে যাবেন? ধারণা করা হচ্ছে এই প্রশ্নের উত্তরেই পাওয়া যাবে আগামীর বাংলাদেশের গতিপথ।

এ প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে, নির্বাচনের আগের সময়ে জনমতের অবস্থা দেখলে জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন আর ঝুঁকি নিতে চাইবে না। …নিজের ক্যারিয়ারকে বিপদে ফেলে খুব কম অফিসারই একটি অজনপ্রিয় সরকারকে বাঁচানোর তাড়না অনুভব করতে পারেন। আর সেনাবাহিনী দলীয় ভূমিকায় নামবে না বলে মনে করা হচ্ছে।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top