ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের সিলাশী গ্রামের বাসিন্দা আবুল কাশেমের বড় ছেলে সোহেল রানাকে নব্য জেএমবির সদস্যরা হত্যা করেছেন বলে জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। গত বৃহস্পতিবার গ্রেপ্তার সংগঠনটির চার সদস্য এ হত্যা ঘটনার সঙ্গে যুক্ত বলে নিশ্চিত হয়েছে তারা। তবে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের পরিবারের অভিযোগ, এলাকা থেকে তুলে নেওয়ার ২৫ দিন পর গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে তাঁদের সন্তানদের।
গতকাল রোববার সোহেলের পরিচয় শনাক্তের সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর হত্যার তথ্য জানাল সিটিটিসি। বিশ্বব্যাপী জঙ্গিগোষ্ঠীর অনলাইন তৎপরতা পর্যবেক্ষণকারী সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ গত ১৬ আগস্ট সোহেল রানার দুটি ছবি প্রকাশ করে। ছবির শিরোনামে তারা লিখেছিল, ‘বাংলাদেশের রাজধানীর উত্তরে জাদুবিদ্যার চর্চাকারীকে আইএসের হত্যার প্রমাণাদি।’
সিটিটিসির উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম বলেন বলেন, গত বৃহস্পতিবার রাতে উত্তরার আজমপুর থেকে গ্রেপ্তার নব্য জেএমবির চার সদস্য সোহেলকে হত্যা করেছেন বলে তাঁরা প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছেন। সোহেলের লাশ তাঁরা এখনো পাননি। এ বিষয়ে আরও অনুসন্ধান চলছে। এই চারজন পল্টনে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায়ও সম্পৃক্ত। তাই তাঁদের ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন মামুন আল মোজাহিদ ওরফে সুমন ওরফে আবু আবদুর রহমান, মো. আল আমিন ওরফে আবু জিয়াদ, মো. মোজাহিদুল ইসলাম ওরফে রোকন ওরফে আবু তারিক ও সারোয়ার হোসেন রাহাত। তাঁদের গ্রেপ্তারের খবর গত শুক্রবার সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগ।
এতে আসামিদের বিস্তারিত পরিচয় দেওয়া হয়নি। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্রেপ্তার চারজনের মধ্যে মামুন আল মোজাহিদ ওরফে সুমনের বাড়ি শ্রীপুরের পাঠানটেক গ্রামে। বাকি তিনজনের বাড়িও পার্শ্ববর্তী বড়নল ও বড়কুল গ্রামে। এই তিন গ্রামই বরমিবাজার এলাকায়, যেখানে নিখোঁজ হওয়ার আগে সোহেল রানা বসবাস করতেন। তিনি তাবিজ-কবচ, আংটি, চুড়ি বিক্রি করতেন।
মামুন আল মোজাহিদ ওরফে সুমনের বাবা শেখ মোসলেহ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, সিটিটিসি তাঁর ছেলেসহ যে চারজনকে বৃহস্পতিবার ঢাকার উত্তরা থেকে গ্রেপ্তারের কথা বলছে, তা সঠিক নয়। এই চারজনকেই ১৭ আগস্ট রাতে তাঁদের নিজ বাড়ি বা আত্মীয়ের বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ২০-২৫টি গাড়িতে করে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) জ্যাকেট ও পুলিশের পোশাক পরা শতাধিক ব্যক্তি ওই দিন এসেছিলেন।
সুমনের ভাই শেখ সেলিম আল আজাদ বলেন, ২৫ দিন পর গ্রেপ্তার দেখিয়ে বলা হলো, তাঁর ভাই হত্যা করেছেন। এটা কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য বা গ্রহণযোগ্য নয়।
পরিবারের অভিযোগের বিষয়ে সিটিটিসির উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম বলেন, এ বিষয়ে তাঁদের কিছুই জানা নেই। চারজনকেই তাঁরা উত্তরার আজমপুর থেকে গ্রেপ্তার করেছেন।
বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএসের তৎপরতার কথা বরাবরই নাকচ করে আসছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ইতিপূর্বে আইএসের নামে যেসব হামলা ও হত্যা ঘটনার দায় স্বীকারের খবর বেরিয়েছে, সেগুলোতে দেশীয় জঙ্গিগোষ্ঠী নব্য জেএমবি জড়িত বলে সিটিটিসি বলে আসছে।
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস তাদের অনলাইন চ্যানেল বা সাইটে বাংলাদেশের এক ব্যক্তির দুটি ছবি প্রকাশ করে তাকে হত্যা করেছে বলে দাবি করেছে।
যদিও ওই ব্যক্তি এক মাসেরও বেশি সময় ধরে নিখোঁজ রয়েছেন বলে দাবি করেছে তার পরিবার। গত ১৬ অগাস্ট ছবি দুটি প্রকাশ করে আইএস এর অনলাইন তৎপরতা পর্যবেক্ষণকারী সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ।
জানা গেছে, প্রকাশিত ছবির ব্যক্তির নাম সোহেল রানা (৩৮)। তিনি ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের শিলাসী গ্রামের বাসিন্দা আবুল কাশেমের বড় ছেলে।
আইএসের প্রকাশিত দুটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, একটি ছবিতে গেরুয়া রঙের গেঞ্জি পরে সোহেল দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর মাথা ন্যাড়া। গলায় দুটি বড় পুঁতির মালা। আরেকটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ন্যাড়া মাথার গেরুয়া পোশাক পরা এক ব্যক্তি জঙ্গলে পড়ে রয়েছেন।
সাইট ইন্টেলিজেন্সের শিরোনামে বলা হয়েছিল, রাজধানীর উত্তরে আইএস জঙ্গিরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। ঢাকার উত্তর পাশে রয়েছে গাজীপুর। জেলার শ্রীপুর উপজেলার বরমীবাজার এলাকার লোকজন ছবি দেখে সোহেলকে শনাক্ত করেন। তারা জানান, সোহেল দুই বছর ধরে বরমীবাজার এলাকায় থাকতেন। বাজারে ঘুরে ফিরে আংটি, চুড়ি, তাবিজ বিক্রি করতেন। তার পোশাক ছিল বিচিত্র। বাজারের একটি সেলুনে তিনি রাত যাপন করতেন।
ওই সেলুন মালিক নিরু জানান, বাজারের বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাফেরা করতেন সোহেল। রাত হলে বেশির ভাগ সময় তার সেলুনে এসে ঘুমাতেন। তবে গত কোরবানির ঈদের কয়েক দিন আগে থেকে তিনি আর আসেন না। তার বাড়ি গফরগাঁওয়ের শিলাসী গ্রামে।
সোহেলের বাবা আবুল কাশেম জানান, পারিবারিক ভাবে তারা মাইজভান্ডারীর অনুসারী। বছর ১৫ আগে সোহেলও মাইজভান্ডারীর মুরিদ হন। নামের সঙ্গে মাইজভান্ডারী যোগ করেন। এরপর থেকে সোহেল মাজারে মাজারে থাকতেন। সর্বশেষ গাজীপুরের বরমীবাজার এলাকায় ছিলেন। সেখানে তাবিজ বিক্রি করতেন। এক-দুই মাস পর পর বাড়িতে যেতেন।
তিনি আরও জানান, করোনার সময় বাড়িতে মাসখানেক ছিলেন সোহেল। গত ঈদ-উল-আজহার এক সপ্তাহ আগে বরমীবাজারে ফিরে যান। ঈদের দিন বাড়িতে আসার কথা ছিলো। কিন্তু আসেননি। ফোনও বন্ধ। ছেলে কোথায় আছে তা তিনি জানেন না।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের (সিটিটিসি) উপ-কমিশনার সাইফুল ইসলাম জানান, সাইট ইন্টেলিজেন্সের প্রকাশিত ছবিটি ধরে তারা তদন্ত করছেন। এরই মধ্যে ওই ব্যক্তির একটি জাতীয় পরিচয়পত্র তারা পেয়েছেন। সেটি যাচাই-বাছাই করছেন।
তিনি আরও জানান, ঢাকার পল্টন ও নওগাঁর সাপাহারে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় সিলেট থেকে নব্য জেএমবির যে ৫ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, তাদের নিকট থেকে এ বিষয়ে তথ্য পেয়েছেন। প্রকাশিত ছবির ব্যক্তিটিকে হত্যা করা হয়েছে কি না, সে বিষয়ে সিটিটিসি এখনও নিশ্চিত নয়। কারণ, তাঁর লাশ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।