উত্তরায় বেপরোয়া ছিনতাইকারী

রাজধানীর উত্তরা এলাকায় ছিনতাইকারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। হেঁটে কিংবা রিকশায়, বাসে অথবা ব্যক্তিগত গাড়ি, জনাকীর্ণ এমনকি ফাঁকা রাস্তায়ও প্রতিনিয়ত ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। সকালে-দুপুরে-সন্ধ্যায় হরহামেশাই ঘটছে এরকম নানা অপ্রীতিকর ঘটনা। কিন্তু ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো-ছিনতাইকারীরা এখন শুধুু টাকা-পয়সা ও মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিয়েই ক্ষান্ত থাকছে না, করছে ছুরিকাঘাত, এমনকি কখনো গুলি করতেও দ্বিধা করছে না।

কোথাও কোথাও আবার ফিল্মি স্টাইলেও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। শুধু উত্তরা নয়, সন্ধ্যার পর রাজধানীর কয়েকটি বাস স্ট্যান্ডে পুলিশের নাকের ডগায়ও চলছে ছিনতাই। পুলিশে দেখে না দেখার ভান করছে বলে অভিযোগ ভোক্তভোগীদের। এছাড়া থানায় গেলেও নেওয়া হয় না মামলা, চুরির কথা বলে করতে হয় সাধারণ ডায়রি। এতে ভোক্তভোগীরা থানায় যেতেও আগ্রহ হারিয়েছেন।

গতকাল উত্তরা এলাকার বাসিন্দারা জানান, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের আবদুল্লাহপুর-হাউস বিল্ডিং, আজমপুর ও বিমানবন্দর এলাকা দিয়ে হাজার হাজার পথচারী ও যানবাহন চলাচল করে। এছাড়া বিমানবন্দর রেলস্টেশন ব্যবহার করে দেশের বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত করে হাজারও মানুষ। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ছোট ছোট কয়েকটি সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী চক্র গড়ে উঠেছে উত্তরার এলাকায়। ওই চক্রের সদস্যরা বাসস্টেশন, রেলস্টেশন ও গলিপথে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এতে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন।

স্থানীয়রা আরো জানান, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী, আব্দুল্লাহপুর, হাউস বিল্ডিং, বিমানবন্দর এলকায় রাস্তার দুই পাশে প্রতিনিয়ত যানজট লেগেই থাকে। এ সময় সড়কের পাশে ওৎপেতে থাকা ছিনতাইকারীরা বাসের জানালা দিয়ে যাত্রীদের মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়। এছাড়া সিএনজির ওপরের কাপড় কেটে যাত্রীর ব্যাগ, মোবাইল ফোন ও মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে পালিয়ে যায়। আর এসব ঘটছে দিন-দুপুরে।

জানা যায়, গত ১৮ জানুয়ারি দিন-দুপুরে ফিল্মি স্টাইলে উত্তরার ৫ নম্বর সেক্টরের ৩ নম্বর সড়কে প্রকাশ্যে মোটরসাইকেলে চড়ে আসা দুই ছিনতাইকারী স্কুল শিক্ষিকার ব্যাগ-স্বর্ণালঙ্কার ছিনতাই করে। তার রিকশা আটকে প্রথমে ব্যাগ এবং পরে গলার স্বর্ণের চেইন নিয়ে চলে যায়। ওই সময়ে সেই সড়কে কোনো লোকজন না থাকায় রিকশা চালকও হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরবর্তীতে সেই ছিনতাইয়ের সময়ের একটি সিসিটিভি ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগে মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এতে দেখা গেছে, ছিনতাইকারীরা ঘটনাটি ঘটাতে মাত্র ৩৪ সেকেন্ড সময় নিয়েছে। ওই ভিডিওতে আরো দেখা যায়, ১৮ জানুয়ারি সকাল ৭টা ৫৮ মিনিটে মোটরসাইকেল আরোহী দুই ছিনতাইকারী রিকশার সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায়। তারা দুজনই ছিলো হেলমেটপরা। তাদের মধ্যে একজন মোটরসাইকেল থেকে নেমে এসে প্রথমে ভুক্তভোগী নারীর ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। এরপর সামনে চলে গিয়ে আবার ফিরে এসে দ্বিতীয় দফায় ওই নারীকে শারীরিকভাবে হেনস্তা করে তার গলার চেইনসহ স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে যায়। গতকাল উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি তপন চন্দ্র সাহা দৈনিক বলেন, এই ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে এবং ভিডিও ফুটেজ দেখে অপরাধীদের চিহিৃত করে গ্রেফতার করা হয়েছে। বর্তমানে তারা কারাগারে রয়েছেন।
এর আগে ২০১৭ সালে উত্তরা এলাকায় মা ও মেয়েকে গুলি করে সোয়া পাঁচ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটেছিল। এছাড়া গত জুলাই মাসে উত্তরা নওয়াব হাবীবুল্লাহ স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে ভুয়া পুলিশ সেজে মো. রুয়েল মিয়া নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। তবে এ ঘটনা মো. নাছির (৪৩) নামের একজনকে গ্রেফতার করা হয়।

গতকাল উত্তরা ইউনিভার্সিটির শিক্ষক রাজন মিয়া জানান, সম্প্রতি তাদের প্রতিষ্ঠানে এক শিক্ষার্থী ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন। ওই এলাকায় সড়কগুলোতে রাতে কোনো বাতি না থাকা ও অনেক সড়কে সন্ধ্যায় লোক চলাচল কম থাকার ছিনতাইকারীরা সুযোগ নিচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।

গতকাল সরেজমিন আবদুল্লাহপুর, হাউস বিল্ডিং, আজমপুর, রাজলক্ষী, ও বিমানবন্দর ঘুরে জানা যায়, এসব এলাকা থেকে প্রতিদিন একাধিক মোবাইল ফোন, টাকা ও মূল্যবান জিনিসপত্র পথচারী ও পরিবহনের যাত্রীদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছে একটি সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী চক্র। শুধু ওইসব এলাকাই নয়, কাওরান বাজার, ফার্মগেট, মৎস ভবন, শাহবাগসহ বিভিন্ন এলাকায়ও ছিনতাই চক্রের সদস্যরা সক্রিয় রয়েছেন। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর থেকে কাওরান বাজার, বাংলামটর ও ফার্মগেট এলাকায় বাসের জানালা নিয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে মোবাইল ছিনতাইয়ের ঘটনা নিত্য দিনের সঙ্গী। যাত্রীদের অভিযোগ, সন্ধ্যার পর বাংলামটর থেকে ফার্মগেট এলাকা পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে দীর্ঘ যানজট লেগে যায়। এ সময় ওৎপেতে থাকা ছিনতাইকারীরা বাসের জানালা দিয়ে ঝাপটা দিয়ে মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়।

সম্প্রতি রাতে কাওরান বাজার এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, কাওরান বাজার মোড়েই একটি পুলিশ বক্স রয়েছে। ওই বক্সে পুলিশ ডিউটি করছে। কিন্তু প্রচÐ যানজট ও বাসগুলোর প্রতিযোতার মধ্যে ছিনতাইকারী ওৎপেতে রয়েছেন। যদি কোনো বাসের জানালার পাশে কোনো যাত্রীর হাতে মোবাইল দেখতে পান; তা হলে ছিনতাইকারীরা জানালা দিয়ে ঝাপটা দিয়ে মোবাইলটি ছিনিয়ে দিয়ে দৌঁড় দেয়। কিন্তু ভোক্তভোগীদের অভিযোগ না করায় পুলিশও নীরব ভ‚মিকা পালন করে। ডিএমপির উত্তরা জোনের ডিসি নাবিদ কামাল শৈবাল জানান, প্রতিনিয়ত দু-চারজন ছিনতাইকারী ধরে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। ছিনতাইয়ের ঘটনা সম্পর্কে থানায় কোনো অভিযোগ পাওয়া মাত্রই ব্যবস্থা নেয়া হয়। এছাড়া ছিনতাইকারীদের নিয়ন্ত্রণে পুলিশ সতর্ক রয়েছে বলেও জানান তিনি।

ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড রিলেশন্স বিভাগের ডিসি মো. ওয়ালিদ হোসেন বলেন, ছিনতাইকারীদের তালিকা করে অভিযান চালানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে অনেকেই গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদেরও গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হবে। বাসের জানালা দিয়ে মোবাইল ছিনতাইয়ের ব্যাপারে তিনি বলেন, এসব ঘটনায় কেউ অভিযোগ করে না। তবে অভিযোগ করলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Share this post

scroll to top