এ যেন লেডি শাহেদ

লুপা তালুকদার। শিশু জিনিয়াকে অপহরণের দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাকে। গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন তিনি। লুপা ও তার মেয়ে নদী তালুকদার মিলে ফুলবিক্রেতা শিশু জিনিয়াকে অপহরণ করেন। লুপা গ্রেপ্তার হলেও নদী পলাতক। বহুরূপী নারী লুপা সম্পর্কে রয়েছে নানা অভিযোগ। অসামাজিক কার্যকলাপ, অপহরণকারী চক্রের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা থাকতে পারে বলে ধারণা করছে পুলিশ। সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, সরকারি দলের নেত্রীসহ নানা পরিচয় ব্যবহার করে এই নারী জড়িয়েছে নানা অপকর্মে।
চাকরি, বদলির তদবির থেকে শুরু নিজের অনুমোদনহীন নামসর্বস্ব টিভি চ্যানেলে চাকরি দেয়ার নামে লুটে নিয়েছেন বিপুল টাকা। তার যোগাযোগ ছিল শীর্ষস্থানীয় প্রভাবশালীদের সঙ্গে। তাদের অনৈতিক বিভিন্ন চাওয়া পূরণে তৎপর ছিল লুপা তালুকদার। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে তারা বিভিন্ন ছবি। প্রভাবশালী নেতা-নেত্রীদের সঙ্গে ছবি রয়েছে তার। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এসব ছবি ও নানা মিথ্যা পরিচয় ব্যবহার করে অপকর্ম করতো লুপা তালুকদার। তার বহুরূপী এসব কর্মকাণ্ডের তথ্য পেয়ে অনেকে বলছেন, এ যেন এক লেডি শাহেদ।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বাংলাদেশ আওয়ামী পেশাজীবী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক। কথিত অগ্নি টিভি’র ম্যানেজিং ডিরেক্টর। এই টিভি’র নামে একটি অফিসও নিয়েছে বাংলামোটর এলাকায়। একইভাবে লুপার মেয়ে নদী তালুকদারও ওই নামসর্বস্ব টিভি’র পরিচালক, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ও কোরিওগ্রাফার হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। এছাড়াও শীর্ষস্থানীয় নেতা, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে রয়েছে লুপার অসংখ্য ছবি। এসব ছবি, পরিচয় ব্যবহার করেই অবাধে অপকর্ম করছিলো লুপা। এ যেনো প্রতারক সাহেদ করিমের নারী সংস্করণ। লুপা গ্রেপ্তারের পর তার প্রতারণার শিকার অনেকেই পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। নিজ এলাকা পটুয়াখালী থেকেই কথিত টেলিভিশনে শেয়ার দেয়ার কথা বলে প্রায় ১৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে লুপা। প্রতারণা ছাড়া হত্যাকাণ্ডেও সম্পৃক্ততা ছিলো লুপার। রাজনৈতিক দলের নেতাদের তদবিরের কারণে রাজনৈতিক বিবেচনায় হত্যা মামলা থেকে রেহাই পায় এই নারী প্রতারক। যদিও রাজনৈতিক কোনো সম্পৃক্ততা এতে ছিলো না।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০০৩ সালে পটুয়াখালীর গলাচিপা থানায় দায়েরকৃত একটি হত্যা মামলার আসামি ছিলো লুপা ও তার পরিবারের সদস্যরা। তদন্তে এই হত্যাকাণ্ডে লুপার সম্পৃক্ততার প্রমাণও পাওয়া যায়। ওই সময়ে এক সন্তানের জননী শাহীনুর বেগম নামে গৃহকর্মী ধর্ষণ করে লুপার তৎকালীন স্বামী। শাহিনুর অন্তঃসত্ত্বা হয়ে গেলে বিষয়টি জানাজানি হয়। গৃহকর্মী এ বিষয়ে আইনের আশ্রয় নেয়ার হুমকি দিলে লুপা ও তার স্বামী মিলে গৃহকর্মী শাহিনুর ও তার শিশুকন্যাকে শ্বাসরোধে হত্যা করে। পরবর্তীতে বস্তাবন্দি করে লাশ দু’টি নদীতে ফেলে দেয়। এই হত্যা মামলার অন্যান্য আসামিরা ছিল- লুপার পিতা হাবিবুর রহমান নান্না মিয়া তালুকদার, তার দুই ভাই মোস্তাফিজুর রহমান লিটন তালুকদার ও মোস্তাইনুর রহমান লিকন তালুকদার, লুপার স্বামী রফিকুল ইসলাম বাদল ওরফে শহীদ বাদল, সুজন, হাকিম আলী, সেরাজ মিয়া, আলী হোসেন, ইছাহাক আলীসহ আরও কয়েকজন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে নয় বছরের শিশু জিনিয়াকে অপহরণ করার নেপথ্যে কী ছিল এ বিষয়ে লুপাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। অপহরণের বিষয়টি স্বীকার করলেও শিশুটিকে লালন পালন করার জন্যই নেয়া হয়েছিল বলে দাবি করছে লুপা। যদিও জিনিয়াকে অপহরণ করে কথিত এক বোনের বাসায় রেখেছিল লুপা। তদন্ত সংশ্লিষ্টদের ধারণা, লুপা নারী ও শিশু পাচারকারী সিন্ডিকেটের সদস্য। এছাড়াও অনৈতিক ব্যবসায় জড়িত থাকতে পারে এই নারী। তদন্তে বিভিন্ন বয়সের প্রায় এক ডজন পুরুষের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্কের তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। রাজনৈতিক দলের নেতা, কয়েক ব্যবসায়ী ও সাংবাদিক রয়েছেন এই তালিকায়। এখন পর্যন্ত লুপা চারটি বিয়ে করেছে। বর্তমানে কোনো স্বামী না থাকায় বন্ধু রয়েছে বলে স্বীকার করেছে লুপা। লুপা গ্রেপ্তারের পর তারা তার বন্ধুরা তার কোনো খোঁজ নিচ্ছে না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করে সে। এসব বিষয়কে কেন্দ্র করেই বেশ কয়েক মাস আগে লুপার একমাত্র ছেলে অগ্নি তালুকদার আত্মহত্যা করে বলে তার ঘনিষ্ঠরা জানান।

জিনিয়া অপহরণ মামলা সম্পর্কে ডিবি’র রমনা অঞ্চলের অতিরিক্ত উপকমিশনার মিশু বিশ্বাস বলেন, লুপার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। একাধিক পুরুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক রয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে তার ব্যক্তি জীবন মোটেও ভালো না। নারী ও শিশু পাচার চক্রের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা থাকতে পারে। বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

জানা গেছে, জিনিয়া অপহরণের বিষয় স্বীকার করে আজ আদালতে জবানবন্দি দিতে পারে লুপা। গত ১লা সেপ্টেম্বর রাত ৯টার দিকে জিনিয়াকে টিএসসি সংলগ্ন সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যানের ফটকের সামনে থেকে অপহরণ করা হয়। অনেক খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে পরদিন জিনিয়ার মা সেনুরা বেগম শাহবাগ থানায় গিয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। ৬ই সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে নারায়ণগঞ্জ থেকে লুপার কথিত বোনের বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় জিনিয়াকে। গ্রেপ্তার করা হয় লুপাকে। জিনিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ফুল বিক্রি করতো। থাকতো মায়ের সঙ্গে। যে কারণে ঢাবি শিক্ষার্থীদের স্নেহ পেতো এই শিশুটি। অপহরণের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে তৎপর হয়ে ওঠেন। এরমধ্যে অন্যতম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র আরাফাত চৌধুরী। প্রত্যক্ষদর্শীদের খুঁজে বের করার কথা বলেন তিনি। জিনিয়ার সঙ্গে যারা কথা বলেছে তাদের শারীরিক বর্ণনাসহ বিভিন্ন তথ্য নিয়ে তা শাহবাগ থানা পুলিশকে দেন। সিসি ক্যামেরা কোথায় আছে সেই তথ্যও পুলিশকে সরবরাহ করেন তিনি। আরাফাত চৌধুরীর দেয়া তথ্যের সূত্র ধরে পুলিশের তদন্ত বেগ পায়। তথ্য প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা সূত্রে ধরে অপহরণের পাঁচদিন পর গত সোমবার রাতে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার আমতলা থেকে শিশু জিনিয়াকে উদ্ধার করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

Share this post

scroll to top