নির্বাচন কমিশনের তফসিল মোতাবেক আজ শুক্রবার সকাল ৮টায় শেষ হয়েছে প্রচারণা কার্যক্রম। কিন্তু নির্বাচনের প্রচারণায় হামলা, মামলা, গ্রেফতারসহ চরম বৈরী পরিবেশ মোকাবেলা করতে হয়েছে বিএনপিকে। এক ভীতি ও অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই প্রচারণা শেষ করছে বিএনপি-জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। গণসংযোগকালে ধানের শীষের অন্তত ৩০জন প্রার্থী ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও পুলিশের হামলার শিকার হয়েছেন। এখনো অন্তত ১০ জন প্রার্থী অবরুদ্ধ। একাধিক প্রার্থী পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছেন। সারা দেশেই বেশির ভাগ আসনে ধানের শীষের প্রার্থীর প্রচারণায় হামলার ঘটনা ঘটেছে। হামলা থেকে রেহাই পাননি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাস, ড. আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর মতো হেভিওয়েট প্রার্থীরাও। তবে এমন চরম ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যেও নির্বাচনের মাঠে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে চাইছে বিএনপি-ঐক্যফ্রন্ট। নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবেন না তারা। এই রাজনৈতিক জোটের বিশ্বাস, মানুষ অবাধে ভোট প্রয়োগের সুযোগ পেলে ধানের শীষের বিজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না। ৩০ ডিসেম্বর নীরব ভোট বিপ্লব হবে। প্রচারণার শেষ দিনে গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীতে সমাবেশের কর্মসূচি ছিল ঐক্যফ্রন্টের। প্রতিকূল পরিবেশেও শেষ মুহূর্তে এ সমাবেশে ব্যাপক জনসমাগম ঘটিয়ে দেশবাসীর কাছে নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি ও জনপ্রিয়তার বার্তা দেয়ার পরিকল্পনা ছিল ফ্রন্টের। কিন্তু অনুমতি না পাওয়ায় সে সমাবেশ করতে পারেনি।
বিএনপির নির্বাচনী মনিটরিং সেল ও কেন্দ্রীয় দফতরের তথ্য অনুযায়ী, গত ৮ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার পর থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত সারা দেশে মোট ৯ হাজার ২০২ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ সময়ে মোট ৮০৬টি গায়েবি ও মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। সারা দেশের ৩০০ আসনে মোট দুই হাজার ৭১৬টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে মোট ১২ হাজার ৫৮৮ জন নেতাকর্মী ও সমর্থক আহত হন। এসব ঘটনায় কমপক্ষে আটজন মারা গেছেন।
জানা যায়, নির্বাচন সামনে রেখে গত ১ ও ৭ নভেম্বর গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্টে নেতাদের দুই দফা সংলাপ হয়। সংলাপে ঐক্যফ্রন্ট ৭ দফা দাবি তুলে ধরে তা নিয়ে আলোচনাও হয়। এর মধ্যে বিএনপির নেতাকর্মীদের মামলা প্রত্যাহার ও নতুন করে মামলা না দেয়ার দাবি ছিল। প্রধানমন্ত্রী মামলার তালিকা দিতে বলেন বিএনপি নেতাদের। পরে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল দুই দফা তালিকাও দিয়েছেন। কিন্তু সংলাপে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর সেইসব প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন নির্বাচনের প্রচারণাকালে দেখতে পায়নি বলে দাবি বিএনপির।
দলটির মহাসচিবের দাবি, প্রধানমন্ত্রী কথা রাখেননি। নির্বাচনী প্রচারণাকালে হামলা-মামলা-গ্রেফতার আগের চেয়েও ন্যক্কারজনক রূপ নেয়। গণসংযোগ শুরু হওয়ার পর বিএনপির প্রার্থী ও নেতাকর্মীদের ওপর হামলা, মামলা ও গ্রেফতারের ঘটনা শুধু অব্যাহতই থাকেনি বরং তা আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। ভোটের প্রচারে নেমে ধানের শীষের প্রার্থীদের মধ্যে ঢাকায় মির্জা আব্বাস, সালাহউদ্দিন আহমেদ, সুব্রত চৌধুরী, আফরোজা আব্বাস, কেরাণীগঞ্জে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নোয়াখালীতে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, জয়নুল আবদিন ফারুক, ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন, নরসিংদীতে ড. আবদুল মঈন খান, ভোলায় মেজর (অব:) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, পাবনায় হাবিবুর রহমান হাবিব, লক্ষ্মীপুরে শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, কিশোরগঞ্জে শরিফুল আলম, মেজর (অব:) আক্তারুজ্জামান, শরীয়তপুরে মিয়া নূরউদ্দিন আহমেদ অপু, সিরাজগঞ্জে রুমানা মাহমুদ, নাটোরে সাবিনা ইয়াসমিন ছবি, শেরপুরে ডা: সানসিলা জেবরিন প্রিয়াংকা, বরিশালে সরদার সরফুদ্দিন আহমেদ সান্টু, চট্টগ্রামে মেজর জেনারেল (অব:) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক হামলার শিকার হয়েছেন। প্রচারণাকালে সিরাজগঞ্জে রুমানা মাহমুদ ও নোয়াখালীতে মাহবুবউদ্দিন খোকন গুলিবিদ্ধ হন। এ ছাড়া, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, গৌতম চক্রবর্তী, জি এম সিরাজসহ অনেক প্রার্থীর গাড়িবহরে হামলা চালানো হয়েছে। এ দিকে, ধানের শীষ প্রতীকের ১৫ জন প্রার্থী বিভিন্ন মামলায় কারাগারে রয়েছেন। তাদের মধ্যে কারো কারো কর্মীসমর্থকরা এলাকায় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছে, আবার কারো কর্মীরা নীরব থেকেছে।
ধানের শীষের প্রচারণায় হামলার বর্ণনা দিয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, গত কয়েকদিন ধরে সারা দেশে প্রতিদিন ৩৫০ থেকে ৫০০ জন ধানের শীষ প্রতীকের কর্মী-সমর্থকদের গ্রেফতার করা হচ্ছে, ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে। আওয়ামী সশস্ত্র কর্মীরা প্রতিদিন শত শত হামলা করছে ধানের শীষের প্রচারণায়। আওয়ামী সন্ত্রাসী ও তাদের হুকুমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হয়ে শত শত ধানের শীষের প্রার্থী ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা রক্তাক্ত-ক্ষতবিক্ষত। পুলিশ ও আওয়ামী ক্যাডারদের নিক্ষিপ্ত গুলিতে হাজারো নেতাকর্মীকে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হচ্ছে। হাজার হাজার নেতাকর্মী আটক হয়ে কারাবন্দী। এরমধ্যেও বিএনপির অনেক নেতাকর্মী গুম-খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হচ্ছেন। বিএনপি, ঐক্যফ্রন্ট ও জোটের শত শত নেতাকর্মীর বাড়ি-ঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট এমন শত শত অভিযোগ নিয়ে নির্বাচন কমিশনে গেলেও বেশির ভাগ অভিযোগের ফল থেকে গেছে শূন্য।
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ইসিতে যান ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। কিন্তু নির্বাচনে নানা অনিয়মের অভিযোগ শুনতে অনীহার কারণে সিইসির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলে বৈঠক বর্জন করেন ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় ওইদিন রাতেই বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে ফ্রন্টের নেতারা জরুরি বৈঠক করে অবিলম্বে সিইসির পদত্যাগ দাবি করেন। এরপর গত বুধবার একইস্থানে ২০ দলীয় জোটের বৈঠক হয়। উভয় বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়- সরকারি দল, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে যতই বৈরী পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হোক, কোনোভাবেই মাঠ ছাড়া যাবে না। সরকার একতরফা নির্বাচনে আর কী কী করতে পারে, তা চূড়ান্তভাবে দেশবাসী ও আন্তর্জাতিক মহলের সামনে উন্মোচন করার জন্য শেষ পর্যন্ত মাটি কামড়ে মাঠে থাকতে হবে। ঐক্যফ্রন্টের নেতারা বলছেন, কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি যাতে বাড়ে, সে লক্ষ্যে চেষ্টা চালানোই এখন তাদের মূল কাজ। কারণ, ভোটাররা ব্যাপকভাবে ভোটকেন্দ্রে গেলে সরকারি দলের ভোট কারচুপির নির্বাচনী ছক কাজ করবে না।
জানা গেছে, এবারের নির্বাচনে তরুণ ভোটারের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি ৪০ লাখ হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারাণা, তারাই ভোটের ফলাফলে বড় ভূমিকা রাখবেন। ইতোমধ্যে তরুণ ভোটারদের উদ্দেশে ড. কামাল হোসেন ও মির্জা ফখরুল ইসলামসহ সিনিয়র নেতারা পৃথক ভিডিওবার্তা দিয়েছেন। সেখানে তরুণদের জেগে উঠতে এবং পছন্দের প্রার্থীকে সকাল সকাল ভোট দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে কোনো দল বা প্রার্থীকে ভোট দেয়ার কথা বলা হয়নি ভিডিওবার্তায়। সূত্র জানায়, নির্বাচনের শেষ দুই দিনকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।
তাদের মতে, ভোটের দিন ক্ষমতাসীন দলের একতরফা মাঠ দখলে নেয়ার প্রচেষ্টা রুখে দিতে পারলে, বিফল হতে হবে না। এ কারণে গ্রেফতার এড়িয়ে ভোটের দিন কেন্দ্রে পর্যাপ্ত সংখ্যক নেতাকর্মী রাখার কৌশল নিয়ে এগোচ্ছেন তারা। তবে হামলা-মামলা-গ্রেফতারের কারণে বর্তমান আতঙ্কজনক পরিস্থিতিতে প্রতিটি কেন্দ্রে ধানের শীষের পোলিং এজেন্ট দেয়াকে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং মনে করছে বিএনপি। বিগত স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোর অভিজ্ঞতাকে এক্ষেত্রে কাজে লাগিয়ে প্রতিটি কেন্দ্রের জন্য একাধিক পোলিং এজেন্ট প্রস্তুত ও গ্রেফতার এড়াতে তাদের ‘নিরাপদে’ রাখার চেষ্টাও রয়েছে বিএনপির। ভোট রক্ষায় ‘কেন্দ্র পাহারা কমিটি’ গঠনের নির্দেশনা দিয়ে বলা হয়েছে, ভোটের ফলাফল গণনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত যেকোনো মূল্যে কেন্দ্রে অবস্থান করতে হবে এবং কোনো কেন্দ্র এজেন্টশূন্য রাখা যাবে না।