দেশের জনগণ ও নেতাকর্মীরা চাইলে জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে সক্রিয় হতে চান পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মরহুম হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিক। তিনি বলেন, জাতীয় পার্টি হচ্ছে আমার সন্তানের (এরিক এরশাদ) বাবার পার্টি। রংপুর তথা দেশের মানুষ বিশেষ করে নেতাকর্মীরা চাইলে জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে সক্রিয় হতে চাই। উত্তরাধিকার সূত্রে কিন্তু পার্টির চেয়ারম্যান তার সন্তানর বা স্ত্রীরাই হবেন। ভাই কখনো উত্তরাধিকার হয় না। আমাদের এই দক্ষিণ এশিয়াতে ভাইয়েরা কখনো (উত্তরাধিকার) হয় না। আর যিনি এখন হয়েছেন (জিএম কাদের) উনি তো অবৈধ চেয়ারম্যান। তার নামে কোর্টে রিট করা আছে। এটার এখনো ফয়সালা হয়নি। তবে, ফায়সালা হলে তাকে (চেয়ারম্যান হিসেবে) মেনে নেব।
বুধবার দুপুরে রাজধানীর বারিধারাস্থ প্রেসিডেন্ট পার্কের বাসভবনে দেয়া একান্ত সাক্ষাতকারে এসব কথা বলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদের এক সময়ের সহধর্মিনী।
১৯৯৮ সালেেএকে-অপরকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন এরশাদ ও বিদিশা। তাদের ঘরে একমাত্র সন্তান এরিক এরশাদ। ২০০৫ সালে এরশাদ-বিদিশার ছাড়াছাড়ি হয়। মোবাইল চুরির একটি মামলায় জেলে যেতে হয় বিদিশাকে। জাতীয় পার্টি প্রেসিডিয়ামের পদ থেকেও সরিয়ে দেয়া হয় তাকে। এরপর থেকেই রাজনীতিতে নিষ্ক্রীয় ছিলেন বিদিশা। ব্যস্ত ছিলেন ব্যবসা ও সামাজিক কর্মকাণ্ড নিয়ে।
এক বছর আগে (২০১৯ সালের ১৪ জুলাই) সাবেক এই রাষ্ট্রপতি মৃত্যুবরণ করেন। কয়েক মাস আগে প্রেসিডেন্ট পার্কে সাবেক স্বামীর বাসায় ওঠেন বিদিশা। যেখানে এরশাদের সাথেই থাকতেন তাদের ছেলে এরিক এরশাদ।
বিদিশা বলেন, নিজের হাতে এই বাড়ি সাজিয়ে-গুছিয়েছিলাম। কিন্তু ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে আমাকে এই বাড়ি থেকে চরম অপমানের সাথে বিদায় নিতে হয়েছিল। পুলিশ দিয়ে একটা মোবাইল চুরির কেস দিয়ে টেনে-হেঁচড়ে যখন বের করেছিল, তখন আমার পায়ে একটা সেন্ডেলও ছিল না। আমি চিন্তা করি মাঝে মধ্যে। আল্লাহপাক চাইলে কিনা সম্ভব? উনি মালিক, উনিই সব কিছু পারেন। উনিই আমাকে আবার ফেরত নিয়ে এসেছেন। এই সংসারটা এরশাদ সাহেবেরই ছিল। এখানে অন্য কারো জায়গা ছিল না। কেউ এখানে আসেওনি, আমার জায়গা কেউ নেয়ওনি। বরং এরশাদ সাহেব আমার সন্তানকে (এরিক এরশাদ) আগলে রেখেছিলেন। তিনি মারা যাওয়ার পর এরিকের অবস্থা খুব শোচনীয় ছিল, আমি এসে তাকে উদ্ধার করি। আরো দেরি হলে (প্রেসিডেন্ট পার্কে আসতে) আমার সন্তান মারাও যেতে পারতো।
এরশাদ ট্রাস্ট গঠন-পুনর্গঠন প্রসঙ্গে বিদিশা বলেন, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ নিজের হাতে এই ট্রাস্ট তৈরি করে দিয়ে গেছেন। তার সন্তান এরিককে একমাত্র এর বেনিফিসিয়ারি করে গেছেন। এরিক যেন সুস্থভাবে, স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে, এজন্য ট্রাস্টটি গঠন করেন।
তিনি বলেন, ট্রাস্টে সম্পদ বলতে বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কের এই ফ্লাটটি আছে। এরিকের কয়েকটা গাড়ি আছে। গুলশানে ছোট একটা ফ্লাট আছে। রংপুরে পল্লী নিবাস আছে। এরশাদ সাহেব তার দু’টি পলিটিক্যাল ঠিকানা (প্রেসিডেন্ট পার্কের বাসা ও পল্লী নিবাস) এরিককে দিয়ে গেছেন, আর কাউকে তা দেননি। মূলত এটার ওপরই তার আত্মীয়-স্বজনদের আক্রোষের কারণ। এরিককে এরশাদ সাহেবের পলিটিক্যাল ঠিকানা দেয়ার মানে তো অন্য উদ্দেশ্য বোঝায়। রাজনৈতিক ঠিকানা এটা। আর অন্য সম্পদের মধ্যে কোল্ড স্টোরেজ আছে একটা, যেটার দেখাশুনা এরশাদ সাহেবের এক কাজিন করেন। এছাড়া ১৩-১৪ কোটি টাকার এফডিআর আছে দু’টি ব্যাংকে। এই তো সম্পদ ট্রাস্টে। এর বাইরে কী আছে না আছে, এটা যদি কেউ জানায় আমরা তাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো। এরিক একটা প্রতিবন্ধী এতিম সন্তান। তার সম্পদ যেভাবে আত্মসাত করতে উঠে পড়ে লেগেছে, এটা অত্যন্ত দু:খজনক।
সম্মেলনের মাধ্যমেই চেয়ারম্যান হয়েছেন জিএম কাদের। তবে কেন তাকে অবৈধ বলছেন? জানতে চাইলে এক সময়ের জাতীয় পার্টির প্রভাবশালী এই প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, সম্মেলনটাই তো অবৈধ ছিল। আর তিনি যদি বৈধ চেয়ারম্যান হন (রিট নিষ্পত্তি হলে), মেনে নেব।
এক প্রশ্নের জবাবে বিদিশা বলেন, আমি সাকসেসফুল প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলাম ২০০৫ সাল পর্যন্ত। যখন আমি জেলে যাই, তখন আমার পদ স্থগিত করা হলো। আমার জনপ্রিয়তা কিন্তু কমেনি। পার্টির কোনো আসনে (পদে) আমি বসব তা রংপুর বলেন, উত্তরবঙ্গ বলেন আর দেশের মানুষ বলেন- তারাই সিদ্ধান্ত নেবেন। আমি চেয়ারম্যান হবো নাকি প্রেসিডিয়াম সদস্য হবো- এটা জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে। পার্টির নেতা-কর্মীরা নেবে। শুধু বলবো, আমি রাষ্ট্র পরিচালনা করার মতো ক্ষমতা রাখি, শুধু জাতীয় পার্টি না। আমার সেই কনফিডেন্স আছে।
তাহলে কী মনে করছেন চেয়ারম্যানেরই (জিএম কাদের) পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন? জবাবে বিদিশা সিদ্দিক বলেন, আমি চাইলে তো হবে না। যদি পার্টির নেতাকর্মীরা চায়, তৃণমূলের মানুষজন চায় তাহলে অবশ্যই। জিএম কাদের না থাকলে তো পার্টিতে রওশন এরশাদ আছেন, আপনি কি চান? জবাবে তিনি বলেন, আমি বলেছি নতুন নেতৃত্ব আসতে হবে। ইয়ং জেনারেশন আসতে হবে। স্পেসিফিক বলবো না যে, রওশন এরশাদ খারাপ, বিদিশা ভাল। ম্যাডামের যখন পার্টিকে বা দেশকে দেয়ার ছিল, উনি তখন দিয়েছেন। উনি বিরোধী দলের নেতা, দেশের ফার্স্ট লেডি ছিলেন। বয়সটা তখন ছিল। এখন আমাদের সুযোগ আসলে আমরা করবো, এটাই স্বাভাবিক। দেশের জন্য কিছু করতে চাই।
গত এক বছরে তারা (জিএম কাদের কমিটি) ক্যারিশমাটিক কিছুই দেখাতে পারেননি উল্লেখ করে তিনি বলেন, মানুষ আর একগুয়েমি, একই ফেস দেখতে চায় না। রাজনীতি একটা বড় প্লাটফর্ম। চাকরিজীবিরা কখনো রাজনীতিবিদ হতে পারে না। জাপায় এখন তরুণ নেতৃত্ব আসা উচিত।
সমঝোতার মাধ্যমে জিএম কাদের চেয়ারম্যান এবং রওশন এরশাদ প্রধান উপদেষ্টা হয়েছেন- তাহলে কেন এসব বলছেন। এমন প্রশ্নের জবাবে এরশাদের সাবেক স্ত্রী বলেন, কোনো সমঝোতা নয়। উনিও (রওশন) একটা কমিটি দিয়েছিলেন। উনিও তো মেনে নেননি। উনি হয়তো শারীরিকভাবে একটু দুর্বল আছেন। অতটা সক্রিয় উনি না। শরীরটা হয়তো এখন খারাপ। ওনারটা উনিই বলবেন। বেসিক্যালি (মূলত) অবৈধ চেয়ারম্যানকে তো অবৈধই বলবো। বৈধ হলে বৈধ বলবো।
রংপুরের রাজনীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি মনে করি রংপুরকে নার্সিং করলে আরো বেশি সিট (নির্বাচনী আসন) বেরিয়ে আসবে। বিদিশা বলেন, এরশাদ সাহেবের দাফনের সময় এরিককে সাথে নেননি চেয়ারম্যান সাহেব (জিএম কাদের)। বাপের দাফনের অংশ নিতে না দেয়ায় সে (এরিক) অনেক কষ্ট পেয়েছে, রংপুরের মানুষ এটাকে ভাল চোখে দেখেনি।
আপনি প্রেসিডেন্ট পার্কে আসার অনেক দিন হয়ে গেল, এরশাদ সাহেব মারা যাওয়ার বছর পার হয়েছে, কেন তাহলে এতো দিনেও সেখানে (রংপুরে) গেলেন না? এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রংপুরে যাওয়ার কথা বললেই বিভিন্ন থ্রেট (হুমকি) আসে। এখানে আসতে দেয়া হবে না। অবাঞ্চিত ঘোষণা করা হবে। হেনতেন করা হবে। কিন্ত, তারা বুঝে না সন্তান যাবে বাবার কবর দেখতে। এ ব্যাপারে তো কেউ তাকে বাধা দিতে পারে না। তবে আমি অচিরেই এরিককে নিয়ে (রংপুরে) যাবো।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব পরিবর্তন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পরিবর্তনটা আসলে নাটকীয়তার মাধ্যমে হঠাৎ করেই হলো। সব চাইতে অবাক লাগে বিদায়ী মহাসচিব রাঙা সাহেব (মসিউর রহমান রাঙা) এরশাদ সাহেবকে যেদিন কবর দেয়া হয় সেদিন উনিই প্রথম নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে এরশাদ সাহেবের ছোট ভাইকে (জিএম কাদের) ঘোষণা দেন। এখন রাঙা সাহেবকেই সরিয়ে দেয়া হলো। বাবলু সাহেবকে (জিয়াউদ্দিন বাবলু) আনা হলো। তিনি খুবই ভাল মানুষ। কিন্তু, দেখা যাবে কয়দিন পরে তো বাবলু সাহেবকেও এভাবেই বিদায় করে দেয়া হবে। সবার সাথে আলাপ আলোচনা করে এটা (মহাসচিব পরিবর্তন) করলে ভাল হতো।
বিদিশা অভিযোগ করেন, জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের বা তার পরিবারের পক্ষ থেকে কেউই এরিকের খোঁজ খবর নেন না। তবে, রওশন এরশাদ এরিকের খোঁজ খবর নেন।
জাতীয় পার্টিকে গৃহপালিত বিরোধীদল বলা হয়ে থাকে- এমন প্রসঙ্গে বিদিশা বলেন, তারা তো নিজেদের মান এভাবেই নষ্ট করেছে। বিরোধী দলের কাজ তো সরকারের মন্দ কাজকর্মের বিরোধতা করা। কিন্তু, এটা সরকারই করছে। সরকারি নেগেটিভ কর্মকাণ্ড নিজেরাই (সরকার) সামনে আনছে। কিন্তু, এটা করার কথা ছিল জাতীয় পার্টির। বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টি ভূমিকা রাখতে পারছে না বলেও মত তার।