২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে দেশে মোট ভোটার সংখ্যা ১০ কোটি ৪২ লক্ষ। এর প্রায় ২১% ভোটারের বয়স ১৮-২৪। এদের বড় একটি অংশ শিক্ষার্থী যারা অনার্স কিংবা মাস্টার্সে পড়াশুনা করছে। এই শিক্ষার্থীদের নিয়ে সম্প্রতি পরিচালিত একটি সমীক্ষার ফলাফলে জানা যাচ্ছে, ২০১৮ সালের নির্বাচনে যেসমস্ত বিষয় তাদের ভোটের সিদ্ধান্তকে খুব বেশি প্রভাবিত করেছে তাদের মধ্যে শীর্ষে আছে প্রতিপক্ষ দল বা জোটের ক্ষতিকর ও অপছন্দনীয় কাজ (৪২%)। দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে আছে যথাক্রমে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি (৩৮.১%) এবং মুক্তিযুদ্ধ (৩৭.৬%)।
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মান্ডায় অবস্থিত স্থায়ী ক্যাম্পাসে ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ আয়োজিত ‘পলিটিকাল মার্কেটিং’ বিষয়ক এক সেমিনারে সমীক্ষার রিপোর্টে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়।
মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষক ইকবাল মাহমুদ সোহেলের নেতৃত্বে ১৬ জনের একটি গবেষণা টিম নভেম্বরের ২০ তারিখ থেকে প্রায় একমাস ব্যাপী সারা দেশের ৫ টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ৩ টি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় এবং ২ টি সরকারি কলেজ থেকে গুচ্ছ নমুনায়নের মাধ্যমে মোট ৫৭৬ জন উত্তরদাতার নিকট থেকে প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে এ গবেষণা পরিচালনা করে অতপর বৃহস্পতিবার সেমিনারের মাধ্যমে ফলাফল প্রকাশ করে। উত্তরদাতাদের মধ্যে ৫৭% পুরুষ এবং ৪৩% নারী।
উত্তরদাতাদেরকে ১৬ টি বিষয়ে আলাদা আলাদাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এই বিষয়টি আপনার ভোটের সিদ্ধান্তকে কতটুকু প্রভাবিত করেছে। উত্তরের ক্ষেত্রে তিনটি অপশন রাখা হয় যথাক্রমে খুব বেশি, কিছুটা এবং তেমন না।
সমীক্ষার ফলাফলে দেখা যায় তরুণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে শতকরা ৯ সব কিছু ঠিক থাকলেও ভোট দিতে ইচ্ছুক নয়। ছেলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ হার শতকরা ৬ ভাগ এবং নারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১২ ভাগ।
সমীক্ষায় দেখা যায়, শিক্ষার্থী ভোটারদের শতকরা ২৩ ভাগ ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ভোটের জন্য দল বা প্রতিক ঠিক করতে পারেনি। এক্ষেত্রে মেয়েদের মধ্যে ৩২ শতাংশ এবং ছেলেদের মধ্যে ১৫ শতাংশ।
শিক্ষার্থী ভোটারদের মধ্যে শতকরা ৫৪ ভাগ দল বা প্রতিক ঠিক করেছে চলতি বছর। ছেলেদের মধ্যে এ হার ৪৯% এবং মেয়েদের মধ্যে ৬২%। অন্যদিকে ২ বছরের অধিক সময় আগেই ভোটের জন্য দল বা প্রতিক নির্ধারণ করে রেখেছে ৩৯% শিক্ষার্থী। সেক্ষেত্রে ছেলেদের মধ্যে ৪৬% এবং মেয়েদের মধ্যে ২৯%।
মাত্র ২৯ ভাগ শিক্ষার্থী জবাব দিয়েছেন যে তার ভোটের সিদ্ধান্তে প্রার্থীর ব্যক্তিগত ইমেজ খুব বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। অন্যদিকে ২৫ ভাগ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন তাদের ভোটের সিদ্ধান্তে প্রার্থীর ব্যক্তিগত ইমেজের তেমন কোন ভূমিকা নেই।
পরিবার বা আত্মীয় স্বজনের মধ্যে বিশেষ কোন ব্যক্তির দ্বারা ভোটের সিদ্ধান্তে খুব বেশি প্রভাবিত হয়েছেন এমনটি জানিয়েছেন ১৭ ভাগ শিক্ষার্থী। মোটেও প্রভাবিত হননি বলে জানিয়েছেন ৪৮ ভাগ শিক্ষার্থী।
পারিবারিক বা গোষ্ঠীগত পছন্দ দ্বারা ভোটের সিদ্ধান্তে খুব বেশি প্রভাবিত হয়েছেন এমন পাওয়া গেছে ২১ ভাগ শিক্ষার্থীর জবাবে। পারিবারিক পছন্দ দ্বারা মোটেও প্রভাবিত হয়নি এমনটি জানিয়েছেন ৩৭ ভাগ শিক্ষার্থী।
এলাকা বা অঞ্চল দ্বারা ভোটের সিদ্ধান্তে খুব বেশি প্রভাবিত হওয়া বা মোটেও প্রভাবিত না হওয়ার হারও একই, যথাক্রমে ২১ ও ৩৭ ভাগ শিক্ষার্থী।
উন্নয়নমলক কর্মকাণ্ড ভোটের সিদ্ধান্তকে খুব বেশি প্রভাবিত করেছে এমনটি জানিয়েছেন ৩৫ ভাগ শিক্ষার্থী। বিষয়টিকে বিবেচনায় আনেননি এমনটি জানিয়েছেন ২১ ভাগ শিক্ষার্থী।
মুক্তিযুদ্ধ ভোটের সিদ্ধান্তকে খুব বেশি প্রভাবিত করেছে ৩৮ ভাগ শিক্ষার্থীর। সেক্ষেত্রে ছেলেদের মধ্যে ৪২ ভাগ এবং মেয়েদের মধ্যে ৩১ ভাগ। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ খুব একটা প্রভাব ফেলেনি এমনটি জানিয়েছে ২২% শিক্ষার্থী। ছেলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ হার ১৯% এবং মেয়েদের মধ্যে ২৭%।
দলের প্রতিষ্ঠাতার ইমেজ ভোটের সিদ্ধান্তে খুব বেশি প্রভাবিত করেছে এমনটি জানিয়েছে ২৯ ভাগ শিক্ষার্থী। ছেলেদের মধ্যে এ হার ৩৫ ভাগ এবং মেয়েদের মধ্যে ২১ ভাগ। অন্যদিকে দলের প্রতিষ্ঠাতার ইমেজ ভোটের সিদ্ধান্তে খুব একটা গুরুত্ব পায়নি এমনি জানিয়েছে ২২ ভাগ শিক্ষার্থী। ছেলেদের মধ্যে এ হার ১৯ ভাগ এবং মেয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ হার ২৭ ভাগ।
শতকরা ৩২ ভাগ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের ইমেজ তাদের ভোটের পছন্দে খুব বেশি প্রভাব ফেলেছে। অন্যদিকে ২৫ ভাগ জানিয়েছে এ বিষয়টি তাদের নিকট তেমন গুরুত্ব পায়নি।
দলের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি ভোটের সিদ্ধান্তে খুব বেশি প্রভাব ফেলেছে এমনটি জানিয়েছেন ৩৩ ভাগ শিক্ষার্থী। তবে ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে এ বিষয়ে পার্থক্য লক্ষ্য করা গেছে বেশ। ছেলেদের মধ্যে এ হার ৩৮ ভাগ এবং মেয়েদের মধ্যে এ হার ২৫ ভাগ। অন্যদিকে ২৯ ভাগ শিক্ষার্থী জানিয়েছে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি ভোটের সিদ্ধান্ত নিতে তাদের কাছে তেমন গুরুত্ব পায়নি।
নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ভোটের সিদ্ধান্তে খুব বেশি প্রভাবিত করেছে এমনটি জানিয়েছে শতকরা ৩৮ ভাগ শিক্ষার্থী। সেক্ষেত্রে ছেলেদের মধ্যে এ হার ৩৪ ভাগ এবং মেয়েদের মধ্যে ৪৪ ভাগ।
দলীয় আদর্শ ভোটের সিদ্ধান্তকে খুব বেশি প্রভাবিত করেছে এমনটি জানিয়েছে ৩৫ ভাগ ভোটার। তবে ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে এখানে পার্থক্য অনেক বেশি। ছেলেদের মধ্যে এ হার ৪১ ভাগ এবং মেয়েদের মধ্যে ২৭ ভাগ।
প্রতিপক্ষ দলের বা জোটের দ্বারা ব্যক্তিগত বা পারিবারিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়াটা ভোটের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছে এমনটি জানিয়েছে ২৮ ভাগ শিক্ষার্থী। ২৮ ভাগ শিক্ষার্থী জানিয়েছে তারা আংশিকভাবে প্রভাবিত হয়েছে। বাকি ৪৪ ভাগ জানিয়েছে বিষয়টি তাদেরকে তেমন প্রভাবিত করেনি।
গবেষণায় আরো উঠে আসে তরুণ শিক্ষার্থী ছেলে ভোটাররা তাদের ভোটের পছন্দে যে বিষয়গুলো দ্বারা খুব বেশি প্রভাবিত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে শীর্ষ তিনটি বিষয় হচ্ছে যথাক্রমে প্রতিপক্ষ দল বা জোটের ক্ষতিকর কাজ (৪৯.৩%), মুক্তিযুদ্ধ (৪২.৪%) এবং দলীয় আদর্শ (৪১.৩%)। অন্যদিকে তরুণ নারী শিক্ষার্থী ভোটারদের ভোটের সিদ্ধান্তে খুব বেশি প্রভাব বিস্তারকারী শীর্ষ তিনটি বিষয় হচেছ নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি (৪৪%), দৃশ্যমান উন্নয়ন (৩২%) এবং প্রতিপক্ষ দল বা জোটের ক্ষতিকর ও অপছন্দনীয় কাজ (৩১.৫%)।
সেমিনারে গবেষেণার ফলাফলের উপর অতিথিবৃন্দ আলোচনা করেন। ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সুলতান আহমদের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপার্চায প্রফেসর শের মোহাম্মদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন র্বোড অব ট্রাস্টিজের ভাইস চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আ.ন.ম রফিকুর রহমান। আরো আলোচনা রাখেন সহযোগী অধ্যাপক ড. জুলফকিার হাসান ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার মোর্শেদুর রহমান।
আলোচকরা বলেন, ভোটের পছন্দে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির খুব বেশি প্রভাব থাকার ক্ষেত্রে পুরুষ শিক্ষার্থীদের তুলনায় নারী শিক্ষার্থীদের পরিমাণ এতখানি কম থাকাটা উদ্বেগজনক। সমাজ ও রাষ্ট্রে ইসলামের কল্যাণকর প্রভাবের আহ্বান নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের জন্য এই গবেষণার রিপোর্ট একটি সিগনাল যে, নারীদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে তারা ব্যর্থ হচ্ছেন, নারীদেরকে ইসলামের সংর্স্পশে আসার সুযোগ তৈরি করে না দেয়ার ফলস্বরূপ শিক্ষিত নারীরা ইসলামের দাওয়াত থেকে দূরে থেকে যাচ্ছে এবং ফলস্বরূপ রাষ্ট্র পরিচালনায় ইসলামের প্রভাব বিষয়ে নারীদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। শিক্ষিত নারীদের মধ্যে ইসলামের এই ক্রমহ্রাসমান প্রভাব আগামী প্রজন্মের উপরও ভয়াবহ প্রভাব পড়ার ইঙ্গতি দেয়।
এর বিপরীতে ভোটের পছন্দে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি খুব বড় প্রভাবক হওয়াটা ইতিবাচক বটে, কিন্তু উদীয়মান শিক্ষার্থীরা তথাকথিত নারী স্বাধীনতা বা নারীর ক্ষমতায়নের ভুল দৃষ্টিভঙ্গির ফাঁদে আটকে যাচ্ছে কিনা সে বিষয়ে গবেষণা হওয়া দরকার। যারা নারীর সত্যিকারের মর্যাদা ও কল্যাণ নিয়ে কাজ করছেন তাদেরকে তরুণদের আরো কাছাকাছি হওয়ার, বিশেষ করে শিক্ষার্থী নারীদের কাছে যুক্তি ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে পৌঁছানোর প্রয়াজনীয়তা নির্দেশ করে এই গবষেণার ফলাফল।
আলোচকরা আরো বলেন, মুক্তযুদ্ধ বিষয়টি ভোটের সিদ্ধান্তে বড় প্রভাবক হওয়াটা ইতিবাচক। কিন্তু মুক্তযুদ্ধকে জাতিগত বিভেদ ও প্রতিহিংসার পরিবরর্তে ঐক্য ও অগ্রগতির অবলম্বন হিসেবে এই তরুন প্রজন্ম নিচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করাটা ইতিবাচক রাজনীতি করা দলগুলোর জন্য জরুরী বলে নির্দেশনা দেয় এই গবেষণা রিপোর্ট।
গবেষণায় পরিসংখ্যানগত পরামর্শক ছিলেন একই বিভাগের শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল মামুন। গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করেন বিভাগে চারজন শিক্ষার্থী যথাক্রমে কামরুন্নাহার সোনিয়া, মোসাম্মাৎ নুসরাত আরা, শামীম আহমেদ ও মনিরুজ্জামান।