বাসের হেলপার থেকে ফ্যাক্টরির মালিক

দুলাল ফরাজী ছিলেন বাসের হেলপার, এখন তিনি ‘মায়ের দোয়া আব্দুল্লাহ প্লাস্টিক’ নামে ফ্যাক্টরির মালিক। কেমন করে তার এই অর্জন!

শোনালেন সে নেপথ্য কাহিনী। খুলে বললেন তার জীবনে সচ্ছলতা ফিরে আসার পেছনের কষ্টভরা দিনগুলোর কথা।

১৯৯৫ সাল মোরেলগঞ্জ-শরণখোলা সড়কে বাসের হেলপার হিসেবে কর্মজীবন শুরু। প্রতিদিনের বেতন ৬০ থেকে ৮০ টাকা। তা দিয়ে কোন মতে সংসার চলতো।

দুলাল ফরাজী বলেন, ‘আশা ছিল ড্রাইভার হবো। তখন সংসার একটু ভাল চলবে। কিন্তু ২০০০ সালের দিকে হঠাৎ করে মালিক বাসের ব্যবসা বন্ধ করে দেন। বেকার হয়ে অন্য বাসে কাজ খুঁজতে থাকি। এরই মধ্যে বিয়েও করে ফেলি। অভাবের তাড়নায় নববধূকে বাড়িতে রেখে কাজের সন্ধানে পাড়ি জমাই ঢাকায়। ‘

এরপর ঢাকায় এসে লালবাগে ইসলামবাগ এলাকায় প্লাস্টিক পট তৈরির কারখানায় কাজ নেন।

তিনি বলেন, ‘৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি শুরু হলেও ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন পেয়েছি। চাকরিকালীন সংসারে কিছুটা স্বচ্ছলতা ফিরে আসে। চাকরির সুবাদে সংশ্লিষ্ট ব্যবসার সাথে জড়িত অনেকের সাথে পরিচয় হয়। ২০১৪ সালে হঠাৎ মা মারা যান। মা মারা যাওয়ার সংবাদে বাড়িতে আসি। সব কাজ শেষে কর্মস্থলে ফিরে যাই। কিন্তু মালিক আর যোগদান করতে দেয়নি। বলল অনেক দেরি হয়ে গেছে এখন আর তোমাকে লাগবে না। ‘

আবারও বেকার হয়ে পড়েন। নতুন করে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। এখানে সেখানে কাজের সন্ধান করতে করতে একসময় নিজেই কিছু করার পরিকল্পনা করেন। চিন্তা মতে একটি উপায়ও পেয়ে যান।

তিনি বলেন, ‘তারপরে সামান্য পুঁজি দিয়ে কৌটা তৈরির একটি হ্যান্ড মেশিন ক্রয় করি। পরে ওই মেশিন দিয়ে মলম, জর্দাসহ বিভিন্ন প্রকার প্লাস্টিকের কৌটা তৈরি করে বিক্রি করতে থাকি। এক পর্যায়ে এসবিআরএম নামের রড ফ্যাক্টরির এক কর্মকর্তা আমার নিজের তৈরি প্লাস্টিকের বিভিন্ন ডিব্বা দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেন। ওই কর্মকর্তাই রডের মাথায় লাগানোর জন্য ছোট প্লাস্টিকের ক্যাপের অর্ডার দেন। নিজের পুঁজি না থাকায় তার কাছ থেকে অগ্রিম ৫০ হাজার টাকা নিয়ে অর্ডার নেই এবং কাজ শুরু করি। এক মাসেই দেড় লক্ষ টাকা আয় করি। ‘মায়ের দোয়া আব্দুল্লাহ প্লাস্টিক’ নামে একটি ট্রেড লাইসেন্স নেই। নিজে ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা করি। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি আমার। ‘

তিনি তৃপ্তি নিয়ে বললেন, ‘এখন লাগবাগে নিজের ফ্যাক্টরি হয়েছে। বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার উত্তর বাধালের নিজ গ্রামে বাড়ি হয়েছে। ধানের জমি কিনেছি। সব মিলিয়ে এখন ভালই আছি।

এভাবেই নিজের সাফল্যের কথা বলছিলেন দুলাল ফরাজী।

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ১০টি রড কোম্পানিতে রডের মাথায় ব্যবহৃত বিভিন্ন সাইজের প্লাস্টিকের ক্যাপ সরবরাহ করছি। ফ্যাক্টরিতে দুটি আধুনিক মেশিন রয়েছে। সেখানে ১৪ জন কর্মচারী কাজ করছেন। প্রতিমাসে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা বেতন দেই তাদের। করোনা পরিস্থিতির কারণে এ সময়ে মালের সরবরাহ কম। আশা করি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবারও ভাল অর্ডার পাব। ভাল ব্যবসা করতে পারব। ‘

দুলাল ফরাজীর স্ত্রী শাহিদা বেগম বলেন, ‘বিয়ের পরের দশ বছর অনেক কষ্ট করেছি। বর্তমানে দুই মেয়ে এক ছেলেকে নিয়ে খুব সুখে আছি। আমার স্বামী অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন শুধু আমাদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। তার পরিশ্রমের ফলে আজ আমাদের এই ফ্যাক্টরি, বাড়ি ও জমি হয়েছে। ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া করাতে পারছি। সব মিলিয়ে ভালই আছি। ‘

স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. আছাদুজ্জামান স্বপন বলেন, ‘দুলাল ফরাজীকে আমরা ছোট বেলা থেকেই চিনি। ৮ ভাই বোনের ছোট দুলাল মাত্র ৫ বছর বয়সেই তার বাবাকে হারান। তারপরে নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে জীবন কাটিয়েছে। স্থানীয়দের বাড়িতে কিষাণ দেওয়া, বাসের হেলপারি থেকে শুরু করে অনেক কিছু করেছে সে। শেষ পর্যন্ত ঢাকায় গিয়ে প্লাস্টিকের কারখানা করার মাধ্যমে তার ভাগ্যের পরিবর্তন আসে। আমরা মনে করি সচ্ছল হওয়ার ইচ্ছা শক্তিই দুলাল ফরাজীকে আজকের অবস্থানে এনেছে। ‘

Share this post

scroll to top