ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পর বাংলাদেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষক মিশন বাতিল করেছে এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশন (এনফ্রেল)। এনফ্রেল থেকে ৩২ জন পর্যবেক্ষক বাংলাদেশে আসার কথা ছিল, যা একাদশ জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আগ্রহ প্রকাশকারী বিদেশী পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে পরিচয়পত্র ও ভিসা না পাওয়ায় নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোর সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে এনফ্রেল। এই অবস্থায় সীমিতসংখ্যক বিদেশী পর্যবেক্ষকের উপস্থিতির কারণে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ ব্যাপারে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের উপমুখপাত্র রবার্ট প্যালাডিনি গতকাল শনিবার ওয়াশিংটন থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে বলেছেন, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে এনফ্রেলের অধিকাংশ পর্যবেক্ষককে প্রয়োজনীয় পরিচয়পত্র ও ভিসা দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের ব্যর্থতায় যুক্তরাষ্ট্র ুব্ধ। এর ফলে এনফ্রেল নির্বাচন পর্যবেক্ষক মিশন পাঠানোর সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে। ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ইনস্টিটিউটের (এনডিআই) মাধ্যমে এনফ্রেলকে অর্থায়ন করে থাকে যুক্তরাষ্ট্র।
বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মিশনের স্বল্পতা থাকবে। এ অবস্থায় স্থানীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোকে নিয়ে গঠিত ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের (ইডব্লিউজি) সবাইকে পরিচয়পত্র দেয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করাটা বাংলাদেশ সরকারের জন্য আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ইডব্লিউজির আওতাধীন অনেক এনজিওকে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা ইউএসএআইডি অর্থায়ন করে থাকে। নির্বাচন পর্যবেক্ষণে এ গ্রুপের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
প্যালাডিনি বলেন, যেকোনো নির্বাচন সামনে রেখে শান্তিপূর্ণভাবে মতপ্রকাশ ও সমাবেশ করা, নির্বাচনের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে স্বাধীন গণমাধ্যমের কাজ করা, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের তথ্য পাওয়ার অধিকার থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া কোনো রকম হয়রানি, ভয়ভীতি কিংবা সহিংসতার ঊর্ধ্বে গিয়ে অবশ্যই ভোটাধিকার চর্চার পরিবেশ থাকা প্রয়োজন।
এ দিকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে নাগরিক সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধা দেয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ব্রিটেনের এশিয়া-প্যাসিফিক বিষয়ক পররাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী মার্ক ফিল্ড।
গতকাল দেয়া এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে সহায়তা দেয়ার ক্ষেত্রে স্বাধীন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
ব্রিটিশ-মন্ত্রী সহিংসতা থেকে বিরত থেকে একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বশীল সংসদ গঠনের জন্য বাংলাদেশের সব পক্ষকে আহ্বান জানান।
এ ব্যাপারে নয়া দিগন্তের সাথে আলাপকালে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষকরা একটি স্বাধীন মতামত দিতে পারেন। এটা নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে সহায়ক হয়। তাদের প্রতিবেদনের মাধ্যমে নির্বাচনের সঠিক পরিবেশটা উঠে আসে। তিনি বলেন, নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিরূপণে পর্যবেক্ষকদের মতামতই একমাত্র নয়, তবে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। অন্য উপাদানটি হলো সংবাদমাধ্যম। এর মাধ্যমে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে নির্বাচনী পরিবেশ সম্পর্কে জানতে পারি। আর পর্যবেক্ষকদের প্রতিবেদন কিছুটা পরে প্রকাশিত হয়, যা আনুষ্ঠানিক হিসাবে গণ্য।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনার কারণে এবারের নির্বাচনে সংবাদমাধ্যমের প্রচারণায় কিছু বাধা আসতে পারে। এ ছাড়া আসন্ন নির্বাচন নিয়ে দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষকদের মধ্যেও আগ্রহের কমতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় জনগণের মতামতের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। নির্বাচন পর্যবেক্ষণে বিদেশীরা এলো বা না এলো- তা নিয়ে সরকার খুব একটা চিন্তিত বলে মনে হয় না। বিদেশের কোনো পর্যবেক্ষক বাংলাদেশে আসতে চেয়ে বাধাগ্রস্ত হলে তার একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তবে তা কতটা নেতিবাচক হবে তা নির্বাচনের পরেই বোঝা যাবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বাংলাদেশের জনগণের কাছে নির্বাচনটা গ্রহণযোগ্য হতে হবে। নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু হলো তা সবচেয়ে ভালো বিচার করতে পারে স্থানীয় মানুষ, অর্থাৎ ভোটাররা।
সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আট শতাধিক বিদেশী পর্যবেক্ষক ও লক্ষাধিক দেশী পর্যবেক্ষক ছিল। তাদের ভিসা, বাংলাদেশে থাকার ব্যবস্থা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে নির্বাচন কমিশনের বেশ কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সেলের এ ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা ছিল। নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণেই বিদেশী পর্যবেক্ষকরা এসেছিল। তবে সেই সময়ের সাথে এই সময়ের তুলনা না করাই ভালো।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে ইইউ সবচেয়ে বড় পর্যবেক্ষক দল পাঠিয়েছিল। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইইউর ১৪৬ জনের পর্যবেক্ষক মিশন ছিল। এ মিশন দীর্ঘ, মধ্য ও স্বল্প মেয়াদে ভাগ হয়ে সারা দেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছিল। মিশনটি স্থানীয় পর্যবেক্ষকদেরও কাজে লাগিয়েছিল। পেশাদারিত্বের কারণে ইইউর পর্যবেক্ষক মিশনের প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বের সাথে নেয়া হয়। কিন্তু চলতি বছর বাংলাদেশে কোনো পর্যবেক্ষক দল পাঠাচ্ছে না ইইউ।
এবার ইইউ কেবল দু’জন নির্বাচন বিশেষজ্ঞ পাঠিয়েছে। এই বিশেষজ্ঞরা নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বিদেশী কূটনীতিকসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সাথে মতবিনিময় করছে। বিশেষজ্ঞারা তাদের প্রতিবেদন ব্রাসেলসে ইইউ সদর দফতরকে দেবে। প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও বাজেট স্বল্পতার কারণে এবার ইইউ পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক মিশন পাঠানো থেকে বিরত রয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
এ বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকেই সবচেয়ে বেশি বিদেশী পর্যবেক্ষক আসার কথা রয়েছে। ব্রিটেন ও সুইজারল্যান্ডের সহযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্র ১৫ হাজার স্থানীয় পর্যবেককে অর্থায়ন করবে বলে জানিয়েছে।
এ দিকে আসন্ন নির্বাচন পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশে অবস্থিত বিভিন্ন দেশের দূতাবাসগুলো প্রস্তুতি নিচ্ছে। নির্বাচনের দিন দূতাবাসের কর্মকর্তারা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনে যাবেন। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর ফল পেতে কোন দল কোন কেন্দ্র পরিদর্শন করবে তা সমন্বয়নের ভিত্তিতে ঠিক করা হবে। নির্বাচনী পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে দূতাবাসগুলো স্থানীয় পর্যবেক্ষকদের সহায়তা নেয়ার পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমের ওপরেও নজর রাখবে।
তবে দূতাবাসগুলোর ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন প্রচলিত অর্থে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নয়। নির্বাচনী প্রক্রিয়া সম্পর্কে তারা নিয়মিত পর্যবেক্ষকদের মতো প্রকাশ্যে কোনো প্রতিবেদন দেবে না। দূতাবাসগুলোর প্রতিবেদন যাবে নিজ নিজ দেশের সদর দফতরে। বাংলাদেশের পরবর্তী সরকারের সাথে সম্পর্কের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণের এসব প্রতিবেদন বিবেচনায় নেয়া হবে।