করোনাভাইরাস শুধু আমাদের শ্বাসনালী ও ফুসফুসকেই আক্রমণ করে না, ভাইরাসটি শরীরের আরো কিছু অঙ্গ এবং টিস্যুকে সংক্রমিত করে। মানব মস্তিস্কে সংক্রমণ ঘটাতে পারলে তা ভয়ঙ্কর হয়। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে মাথা ব্যথা, বিভ্রান্তি, ভ্রম বা প্রলাপের মতো মানসিক উপসর্গ প্রদর্শনের মাধ্যমেও রোগ প্রকাশ পেতে পারে। আর এ থেকেই চিকিৎকেরা ধারণা করেন, করোনাভাইরাসটি হয়তো ব্রেইনের স্নায়ু কোষকেও সংক্রমণ করে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড ইউনিভার্সিটির সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম।
তিনি বলেন, মূলত শরীরের যেসব কোষে এসিই-২ রিসেপ্টর রয়েছে সে সব কোষ এবং কলা এই ভাইরাসটি দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে। আর এ কারণেই ফুসফুস ছাড়াও ভাইরাসটির সংক্রমণ দেখা যায় রক্তনালীর অ্যান্ডোথেলিয়াম, অন্ত্রের এপিথেলিয়াম এবং কিডনিতে।
ভাইরাস সংক্রমণের স্থান ভেদে কোভিড রোগের উপসর্গেও এ কারণে বেশ কিছুটা ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয় বলে উল্লেখ করেন ড. মেহেদী আকরাম। করোনাভাইরাসটি প্রধানত আক্রমণ করে ফুসফুসকে। তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই রোগটি শুরু হয় কাশি, গলাব্যথা, জ্বর এবং শ্বাসকষ্ট দিয়ে। আবার ভাইরাসটি যখন নাকের মিউকাস মেমব্রেনকে সংক্রমণ করে তখন রোগীদের ঘ্রানশক্তি লোপ পায়। অন্ত্রের কোষকে সংক্রমণ করলে শুরু হয় অন্ত্রের গোলযোগ এবং ডায়রিয়া।
ড. মেহেদী আকরাম বলেন, সম্প্রতি একদল ব্রিটিশ বিজ্ঞানী লন্ডনের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৪৩ জন কোভিড রোগীর উপর একটা গবেষণা চালান। রোগীদের ক্লিনিক্যাল ডাটা এবং ল্যাবরেটরি পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করে তারা দেখতে পান যে, এদের ভেতরে ১০ জনের অ্যানসেফালোপ্যাথি হয়েছিল এবং তারা ছিল অনেকটা বিকারগ্রস্ত। তবে তাদের ব্রেইনের এমআরআই এবং স্নায়ু রসের (সিএএসএফ) পরীক্ষায় কোনো প্রকার অস্বাভাবিকতা পাওয়া যায়নি।
অবশিষ্টদের মধ্যে ১২ জনের মস্তিষ্কে প্রদাহ বা অ্যানসেফালাইটিস এবং অ্যানসেফালোমায়েলাইটিস (এডিইএম) হয়েছিল। এদের মধ্যে পাঁচজনের ব্রেইনে রক্তক্ষরণ এবং এক জনের নেক্রোসিস পাওয়া যায়। এ ছাড়াও আট জনের মস্তিষ্কে রক্তনালিকা ব্লক হয়ে স্ট্রোক হয় এবং সাতজনের হয় গুলেইন-বেরি সিনড্রোমÑ যা এক ধরনের প্যারালাইসিস রোগ। এগুলো ছাড়াও রোগীদের বিভিন্ন ধরনের স্নায়োবিক উপসর্গ প্রকাশ পায়। তবে কোভিডে আক্রান্ত রোগীদের মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ এবং রক্তনালির অস্বাভাবিকতাই ছিল উল্লেখযোগ্য। আশ্চর্যজনক হলো, মস্তিষ্কের সমস্যা কোভিড রোগের তীব্রতার সাথে সম্পর্কিত ছিল না। অর্থাৎ অনেক মাইল্ড কোভিড রোগীও মস্তিষ্কের উপসর্গ প্রদর্শন করেছে।
করোনা ভাইরাস মস্তিষ্কে সরাসরি কতটুকু সংক্রমণ করে তা দেখতে হলে দরকার মস্তিষ্কের ব্যবচ্ছেদ। আর এ কাজটিই করেন ইতালির বিজ্ঞানীরা কোভিড রোগে মারা যাওয়া ১৮ জনের মস্তিস্ক অটোপ্সি করে। রোগীদের সবাই সিভিয়ার কোভিডে ভুগে হাসপাতালে ভর্তির দুই থেকে ৯ দিনের মধ্যে মারা যান। এদের ভেতরে কারো কারো নিউরোলজিক্যাল বা স্নায়ুতন্ত্রীয় উপসর্গও ছিল। মৃত্যুর পরে রোগীদের ব্রেইন টিস্যু নিয়ে করোনাভাইরাস শনাক্তের জন্য আরটি পিসিআর এবং ইমিউনোস্টেইনিং করা হয়।
ড. মেহেদী আকরাম বলেন, ইটালির ওই হাসপাতালের পিসিআর করে ১৮ জনের ভেতরে পাঁচজনের ব্রেইন টিস্যুতে সামান্য পরিমাণ করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। তবে ইমিউনোস্টেইনিং করে কোনো রোগীর ব্রেইন টিস্যুতে কোনো প্রকার ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। স্নায়ু কোষে ভাইরাস ইনফেকশন হলে কোষ বা কলার যে পরিবর্তন হয় সেই রকম পরিবর্তন কোনো রোগীর ব্রেইনেই পরিলক্ষিত হয়নি। তবে সব রোগীর ব্রেইন টিস্যুতেই মাইক্রোসকপিক ইস্কেমিয়া বা অক্সিজেনের ঘাটতিজনিত ইনজুরি দেখতে পাওয়া যায়।
এসব থেকে বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে উপনিত হন যে, করোনাভাইরাস মানুষের মস্তিষ্কে হয়তো সরাসরি সংক্রমণ করে না। ব্রেইন কোষে যে সামান্য পরিমাণ ভাইরাসের আলামত পাওয়া যায়, তা সম্ভত ব্রেইনের রক্তনালীকার ভেতরে ছিল। করোনাভাইরাস রক্তনালীর কোষকে সংক্রমণ করে। এই গবেষণাটি প্রকাশিত হয় নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে। এ দুটো গবেষণা থেকে এটা পরিষ্কার যে করোনাভাইরাস মস্তিষ্কে মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। কোভিড রোগীদের রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রে নিউরোলোজিক্যাল পরিক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে।