আনন্দমোহন কলেজের যে শিক্ষককে ৭০ বছর পরও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে জাপানিরা

AMC-Teacher রাধাবিনোদ পালবাংলার মাটিতে জন্ম নেওয়া একজন বিচারক, মৃত্যুর ৫০ বছর পর বাংলায় বিস্মৃত হলেও এখনো তাকে মনে রেখেছেন জাপানের মানুষ। তাকে উৎসর্গ করে জাপানের জাসুকুনি মন্দিরে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত এই বিচারকের জন্ম ১৮৮৬ সালে বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার সলিমপুর গ্রামে। ১৯০৫ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে এফএ পরীক্ষায় পাশ করে ভর্তি হয়েছিলেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। গণিতে স্নাতকোত্তর পাশ করেন তিনি। চাকরি নিয়েছিলেন ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে। শিক্ষকতা করার পাশাপাশি ময়মনসিংহ কোর্টে ওকালতির চর্চাও করেন তিনি।

স্মৃতিস্তম্ভে তার পরিচয় লেখা আছে ‘রাধাবিনোদ পাল, মিত্রবাহিনীর ১১ বিচারপতির মধ্যে একমাত্র বিচারক, যিনি টোকিও ট্রায়ালে জাপানের যুদ্ধকালীন শীর্ষ নেতাদের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন।’

তিনি চেয়েছিলেন আইন বিশারদ হতে। ১৯২০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে এলএলএম পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। ১৯২৪ সালে আইনে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পক্ষে বরাবরই তার দৃঢ় অবস্থান থাকা সত্ত্বেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের বিরুদ্ধে আনা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক মামলা ‘টোকিও ট্রায়ালস’-এর একমাত্র ভারতীয় বিচারক হিসেবে জায়গা পেয়েছিলেন তিনি। কেনো ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র রাধাবিনোদ পালকে বেছে নিয়েছিলেন— তা এখনো স্পষ্ট না।

টোকিও ট্রায়ালে অন্য বিচারপতিদের বিরোধিতা করে মতামত দিয়েছিলেন রাধাবিনোদ। বিচারে তিনি বলেছিলেন, জাপানই একমাত্র দেশ নয় যারা এই ধরনের অপরাধ করেছে বরং জাপানের বিচার করতে বসা মিত্রপক্ষের অনেকই যুদ্ধের সময় একই ধরনের অপরাধ করেছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগগুলো তিন ভাগে বিভক্ত ছিল— এ, বি ও সি। যুদ্ধের পর মিত্রবাহিনী ওই বিভাগগুলো বানিয়েছিলেন। পরে, ১১টি দেশের বিচারপতিরা ‘টোকিও ট্রায়ালে’র বিচারের জন্য বসেন।

জাপানের ২৫ শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে ‘এ শ্রেণি’র অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছিল, যেখানে আক্রমণাত্মক যুদ্ধ চালানো এবং শান্তি ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য তাদেরকে দায়ী করা হয়।

নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, এশিয়ার এই বিচারপতি অন্যান্য বিচারকদের চেয়ে ভিন্নভাবে ‘এ শ্রেণি’র যুদ্ধ অপরাধগুলো দেখেছিলেন। জাপানের বিরুদ্ধে শান্তি ও মানবতারবিরোধী অপরাধের অভিযোগকে ‘প্রতিশোধের তৃষ্ণার সন্তুষ্টির জন্য আইনি প্রক্রিয়ার লজ্জাজনক ব্যবহার’ বলে উল্লেখ করেন তিনি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের অপরাধ তিনি অস্বীকার করেননি। নানজিং গণহত্যাসহ জাপানের যুদ্ধের অত্যাচারকে পুরোপুরি স্বীকার করে তিনি জানান, ‘বি’ ও ‘সি শ্রেণি’ অভিযোগগুলো এক্ষেত্রে বৈধতা পাবে।

‘এ শ্রেণি’র অভিযোগে যে ২৫ জাপানি নেতাকে অন্য ১০ বিচারপতি দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন তাদের সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আনা অপরাধের প্রেক্ষিতে যে সব অভিযোগ আছে, সে অনুযায়ী তাদের সবাইকে একইভাবে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না। সবগুলো অভিযোগেই তাদেরকে খালাস দেওয়া উচিত।’

সাহসী এই বিচারক সেসময় হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলার কথা ট্রাইবুনালে স্মরণ করিয়ে দেন। ওই হামলাকে নাৎসি অপরাধের সঙ্গে তুলনা করে তিনি জোর গলায় বলেছিলেন, হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমা হামলাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে ভয়াবহ নৃশংসতা।

১৯৫২ সালে ‘টোকিও ট্রায়ালে’র বিচারের রায় মেনে নিয়ে সান ফ্রান্সিসকো শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে টোকিও। জাপানে মার্কিনীদের দখলের দিন শেষ হয়। সেসময় রাধাবিনোদ পালের ১ হাজার ২৩৫ পৃষ্ঠা রায় প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞাও প্রত্যাহার করা হয়।

ওই পৃষ্ঠাগুলোই পরবর্তীতে জাপানে জাতীয়তাবাদীরা তাদের যুক্তির ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করে টোকিও ট্রায়ালকে ‘বানোয়াট’ বলে চিহ্নিত করে। প্রায়শই তার রায়কে বিকৃতভাবে ব্যাখ্যা করা হলেও নিঃসন্দেহে যুদ্ধ-পরবর্তী জাপানের জাতীয়তাবাদী নেতা ও চিন্তাবিদদের নায়ক ছিলেন রাধাবিনোদ পাল।

হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক পলিসি স্কুলের সহকারী অধ্যাপক তাকাশি নাকাজিমা জাপানের ইতিহাসে রাধাবিনোদ পালের অবদান নিয়ে ৩০৯ পৃষ্ঠার ‘বিচারক পাল’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন।

সেখানে তিনি লিখেছেন, জাপানের সমালোচকরা তার রায় থেকে নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী বাছাই করে কয়েকটি অংশ ব্যবহার করেছেন।

আরও বলেন, ‘বিচারক পাল জাপানের পক্ষে দৃঢ় ছিলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে খুব কড়া কথা বলেছেন। সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী শক্তিই তার কাছে একই ‘গ্যাং’-এর অংশ ছিল এবং তার এই মনোভাব কখনো পাল্টায়নি।’

যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে রাজনীতিবিদরা রাধাবিনোদ পালকে বেশ কয়েকবার জাপানে আমন্ত্রণ জানিয়ে সম্মান দেখিয়েছিলেন।

তার অন্যতম শক্তিশালী সমর্থক ছিলেন জাপানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের দাদা ও জাপানের রাজনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব নোবুসুক কিশি। ১৯৫০ দশকের শেষদিকে তিনি জাপানের প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি টোকিও ট্রায়ালের ‘এ শ্রেণি’তে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু কখনও তাকে আসামি হিসেবে প্রমাণ করা যায়নি।

রাধাবিনোদ পালের উত্তরাধিকার হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয় জাপান-ইন্ডিয়া গুডউইল অ্যাসোসিয়েশন। সংস্থাটির চেয়ারম্যান হিদাকি কাসে বলেন, ‘আমরা জজ পালের কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। এমন আর কোনো বিদেশি নেই যিনি এতো স্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে, জাপানই একমাত্র দেশ নয় যারা ওই ধরনের অপরাধ করেছে।’

তবে, নানজিং গণহত্যাসহ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিয়ে বিচারক পালের কিছু অংশের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন হিদাকি কাসে। এক সময় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইয়াসুহিরো নাকাসনের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন হিদাকি কাসে।

হার্ভার্ডের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ইতিহাসবিদ সুগত বোস নিউইয়র্ক টাইমসকে জানান, পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা একটি এশীয় দেশ জাপান প্রশংসার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। তবে তারা এশিয়ায় উপনিবেশিকরণের জন্যও চক্রান্ত করেছিল।

নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের এই উত্তরাধিকার জানান, জাপান যখন চীনকে আক্রমণ করে সুভাষ চন্দ্র বোস তখন সেটার সমালোচনা করলেও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জাপানের সঙ্গে জোট বেঁধেছিলেন।

তিনি আরও বলেন, ‘একজন ভারতীয় হিসেবে বিচারক পাল এ সব বিষয়ই জানতেন। হয়তো পরোক্ষভাবে এটা তার মতামতকে প্রভাবিত করেছে।’

২০০৭ সালে ভারত সফরের সময় জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে রাধাবিনোদকে স্মরণ করেন। নয়াদিল্লিতে ভারতের লোকসভায় ভাষণ দেওয়ার সময় তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন তিনি। এমনকি, ওই বিচারকের ৮১ বছর বয়সী ছেলের সঙ্গে দেখা করতে কলকাতায় এসেছিলেন আবে।

প্রতি বছর হিরোশিমা-নাগাসাকি দিবসে রাধাবিনোদ পালকে বিশেষভাবে স্মরণ করেন জাপানিরা। জাপানি টেলিভিশন চ্যানেল এনএইচকে তাকে নিয়ে একটি ৫৫ মিনিটের অনুষ্ঠান প্রচার করেছে।

নেটফ্লিক্স নির্মিত ‘টোকিও ট্রায়াল’ মিনিসিরিজের বদৌলতে অনেকেই ‘রাধাবিনোদ পাল’ নামটির সঙ্গে পরিচিত হলেও বাংলার এই সূর্য সন্তানের পরিচয় এখনো অধিকাংশ বাঙালির কাছে অবহেলায়ই থেকে গেছে।

Share this post

scroll to top